৫৮ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ৬ ফাল্গুন, ১৪২৭
কেন্দ্রের বাজেটের কয়েকটি অভিমুখ
বিশ্বম্ভর মণ্ডল
২০১৯-২০ অর্থবর্ষের শেষ ৩ মাসে অর্থাৎ কোভিড হানা দেবার ঠিক আগে দেশে আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৩.১ শতাংশ। দেশে বেকারত্বের হার ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ - প্রায় ৬.৫ শতাংশ, সরকারের হিসেব মতো বেকার ১ কোটি ২০ লক্ষ। এমন একটা সময়ে বাজেট পেশ করা হলো যখন দেশের প্রথম ৫০টি সংস্থার সম্পদের বহর বেড়েছে ৩ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। পৃথিবীজুড়ে দেশকে, দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করতে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ ছিল - চাহিদা বাড়াতে হবে। চাহিদা বাড়ানোর জন্য গরিব-নিম্নবিত্তদের হাতে টাকা তুলে দিতে হবে। সরকারকে জনকল্যাণে টাকা খরচ করতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রের বাজেটে স্বাস্থ্য, কৃষি, বীমা, রাজকোষের সংস্থান সহ কয়েকটি ক্ষেত্রের অভিমুখ নিয়ে আলোচনা করছি।
স্বাস্থ্যের সুরক্ষা অন্যতম মৌলিক অধিকার, অথচ এদেশে জিডিপি’র ২ শতাংশের কম খরচ করা হয় স্বাস্থ্যখাতে। গত অর্থবর্ষে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ছিল ৯৪ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বেড়ে হয়েছে ২ লক্ষ ৪৩ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। যদিও এর মধ্যে ঢুকে আছে টিকা বাবদ - ৩৫ হাজার কোটি টাকা, নতুন প্রকল্প “আত্মনির্ভর স্বাস্থ্য ভারত যোজনা” বাবদ আগামী ৬ বছরের জন্য মোট বরাদ্দ ৬৪ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। ২০২৫ সালের মধ্যে একটি জাতীয় পরিকাঠামো পাইপলাইনের আওতায় ৭৪০০ প্রকল্পকে নিয়ে আসা হবে। স্বাস্থ্য গবেষণার জন্য বরাদ্দ ২৬৬৩ কোটি টাকা, আয়ুষ প্রকল্পে ২৯৭০ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য পরিকাঠামো খাতে আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ বরাদ্দ বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ ১৩৭ শতাংশ বেড়েছে, কিন্তু জল সরবরাহ, নিকাশি, পুষ্টি ও অর্থ কমিশনের বরাদ্দ বাদ দিলে এই বৃদ্ধি মাত্র ১১ শতাংশ। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের জন্য এককালীন বরাদ্দ ৩৫,০০০ কোটি টাকা বাদ দিলে জিডিপি অনুপাতে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ প্রকৃতপক্ষে কমেছে।
কৃষির সাথে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ যুক্ত, জিডিপি’র ১৮ শতাংশ আসে খেত থেকে। কৃষি ঋণের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। কৃষি পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য বাজেটে এগ্রিকালচারাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেসের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে রাজ্য সরকারগুলোর আয় কমে যাবে কারণ, ডিউটি হিসেবে কেন্দ্র যে অর্থ সংগ্রহ করে, সেটা ভাগ করে নিতে হয় সব রাজ্যের মধ্যে। কিন্তু সেসে কোনো ভাগ রাজ্যকে দিতে হয় না। সেস আদায়ের কারণ জানানো হয়েছে যে, ওই সেসের টাকা নাকি কৃষি পরিকাঠামো তৈরির কাজে ব্যবহার করা হবে। যদিও সংগৃহীত সেস কোথায়, কীভাবে খরচ হবে, তার ন্যূনতম ইঙ্গিতও নেই বাজেটে। পেট্রোলের ওপর লিটার পিছু ২.৫ টাকা ও ডিজেলের ওপর লিটারে ৪ টাকা হারে এই সেস। সেস বসানো হয়েছে বেশ কিছু পণ্যের আমদানি করে - সোনা ও রুপো (২.৫ শতাংশ), অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় (১০০ শতাংশ), আপেল (৩৫ শতাংশ), কয়লা (১.৫ শতাংশ), সার (৫ শতাংশ), তুলোর (৫ শতাংশ) ওপরে। মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ কর্ম নিশ্চয়তা প্রকল্পে ৪২শতাংশ বাজেট ছাঁটা হয়েছে। ১,৬৬,০০০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৯৬,৭৭৩ কোটি টাকা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কিষান সম্মান নিধি প্রকল্পে বরাদ্দ ৭৫,০০০ কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে ৬৫,০০০ কোটি টাকা।
সারণি-১
কৃষিতে বরাদ্দ | |
২০২০-২১ (বাজেট বরাদ্দ) | ২০২১-২২ (বাজেট বরাদ্দ) |
১,৩৪,৩৪৯ কোটি টাকা | ১,২২,৯৬১ কোটি টাকা |
বীমা ক্ষেত্র বিগত ৬০-৬৫ বছর ধরে দেশের উন্নয়নে স্তম্ভের কাজ করেছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে এলআইসি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । দেশে ৩২ কোটি এলআইসি’র গ্রাহক। এলআইসি’র বর্তমান সম্পদের পরিমাণ ৩৬ লক্ষ কোটি টাকা। বিমা ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির সীমা ৪৯ শতাংশ থেকে ৭৪ শতাংশ করা হলো। দেশের সাধারণ মানুষের ভবিষ্যৎ ও ভরসা শিকেয় তুলে রেখে লাভজনক জীবন বিমা নিগমের শেয়ার বেচার সিদ্ধান্ত অবাক করেছে। এটা মধ্যবিত্তের মনে উদ্বেগ আনছে। এতদিন বিলগ্নিকরণের কথা বলা হয়েছে, এবারে সরাসরি বেসরকারিকরণের কথা বলা হলো। দেশের অর্থনীতি যেদিকে এগোচ্ছে তাতে বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীরাই সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করবে বলে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
সারণি-২
- | ২০২০-২১ (বাজেট বরাদ্দ) |
২০২০-২১ প্রকৃত খরচ (কোভিড পরিস্থিতির জন্য) |
২০২১-২২ (বাজেট বরাদ্দ) |
১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে | ৬১,৫০০ কোটি টাকা | ১,১১,৫০০ কোটি টাকা | ৭৩,০০০ কোটি টাকা |
জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা | ৭৮,০০০ কোটি টাকা | ৩,৪৪,০৭৭ কোটি টাকা | ২,০২,৬১৬ কোটি টাকা |
প্রধানমন্ত্রী কিষান প্রকল্প | ৭৫,০০০ কোটি টাকা | ৬৫,০০০ কোটি টাকা | ৬৫,০০০ কোটি টাকা |
রাজকোষের সংস্থান করতে বিলগ্নিকরণই যে সরকারের অন্যতম প্রধান ভরসা সেটা বাজেটে চোখ বোলালেই বোঝা যাবে। লকডাউনের ধাক্কায় রাজস্ব আদায় কমে গেছে সরকারের। এর জন্য রাজকোষ ভরতি করতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাতে সরকারের অংশীদারী বিক্রি, বেসরকারিকরণ, সম্পদ ভাড়া দিতে বা বিক্রি করতে সরকার উদ্যোগী হবে। নানা কায়দায় রাষ্ট্রের সম্পদ বিক্রি করার নিদান দেওয়া হয়েছে বাজেটে। অর্থমন্ত্রী জানান, ২০২১-২২ অর্থবর্ষের মধ্যেই বিক্রি করা হবে আইডিবিআই ব্যাঙ্ক, বিপিসিএল, শিপিং কর্পোরেশন, নীলাচল ইস্পাত নিগম লিমিটেড, পবন হংস, এয়ার ইন্ডিয়া, দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, একটি সাধারণ বীমা সংস্থা। ৭টি বন্দরে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারীর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অধিগৃহীত সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণে যেসব রাজ্য সরকার অগ্রাধিকার দেবে অর্থ বরাদ্দে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের বিশেষ সুবিধা দেবে। এও বলা হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, সরকারি মন্ত্রক ও দপ্তরের পড়ে থাকা জমিও বেঁচে দেওয়া হবে। এছাড়া কয়েকটি ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দের তুলনামূলক ছবি সারণি আকারে দেওয়া হলোঃ
সারণি-৩
২০২০-২১ (বাজেট বরাদ্দ) | ২০২১-২২ (বাজেট বরাদ্দ) | |
প্রাণীপালন | ২,৬৩০ কোটি টাকা | ৩,০৫৭ কোটি টাকা |
মা ও শিশুদের প্রকল্প আইসিডিএস | ২৮,৫৫৭.৩৮ কোটি টাকা | ২০,১০৫ কোটি টাকা |
মা ও শিশুদের সবচেয়ে বড়ো প্রকল্প আইসিডিএস’র (প্রকল্পটির নাম পাল্টে হয়েছে সক্ষম অঙ্গনওয়াড়ি এবং পোষ্ণ-২.০) বাজেটে এবছর বরাদ্দ গত বাজেটের তুলনায় ৩০ শতাংশ কমেছে। স্কুলের ছেলেমেয়েদের মিড ডে মিল প্রকল্পে ১,৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ কমেছে।
২০,০০০ কোটি টাকার মূলধন নিয়ে পরিকাঠামো ক্ষেত্রের বিকাশে অর্থ জোগানোর জন্য তৈরি করা হবে একটি জাতীয় ব্যাঙ্ক। আগামী অর্থবর্ষে (২০২১-২২) সরকারের প্রস্তাবিত খরচের পরিমাণ ৩৪.৮৩ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২০-২১’র সংশোধিত হিসাবের সাথে ২০২১-২২’র বাজেটের তুলনা করে দেখা গেল যে, মূলধনী ব্যয় ২৬ শতাংশ বাড়বে।
আর্ন্তজাতিক অর্থ ভাণ্ডারের সম্প্রতি প্রকাশিত দুটি তথ্য গুরুত্বপূর্ণ - (১) জি-২০ গোষ্ঠীর দেশগুলির মধ্যে ভারতেই সরকার সব থেকে কম ব্যয় করেছে। (২) ২০০৮ সালের আর্থিক সঙ্কটের পর থেকে উন্নত দেশগুলোতে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র ক্রমশ আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অথচ এ দেশের সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণের বেগ বাড়িয়েই চলেছে।
মুখে আত্মনির্ভরতার কথা বলে জাতীয় সম্পদ বেচে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে বাজেটে। আমাদের জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার নেগেটিভ, তাই সেই হার যাতে আরও নিম্নমুখী না হয়, সেদিকে আরও যত্নবান হবার দরকার ছিল । লকডাউনে লাখে লাখে শ্রমিক চাকরি হারাল, শুধু “এক দেশ এক রেশন”-এর গালভরা প্রতিশ্রুতি ছাড়া তাদের নিয়ে কোনো দিশার সন্ধান পাওয়া গেল না। লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয় পর্যটন, হোটেল, পরিবহণ ইত্যাদি শিল্পে। পরিষেবা ক্ষেত্র আঘাতপ্রাপ্ত। লকডাউনে আঘাতপ্রাপ্ত এই ক্ষেত্রগুলিকে কিভাবে পুনরুজ্জীবিত করে তোলা যায় তার কোনো পরিকল্পনার আভাস মেলেনি বাজেটে। এছাড়াও মধ্যবিত্ত, চাকুরিজীবীদের আয়করে ছাড় দেওয়া যেতে পারত। কিন্তু সরকার এ পরামর্শে কান দেয়নি। ধনকুবেরদের উপরে করের বোঝা কী একটুও চাপানো যেত না, এই অতিমারীর সময়ে যাদের সম্পদ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে যখন দেশে রাজকোষ ঘাটতি সাড়ে ৯ শতাংশ।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন - এই বাজেট গ্রাম আর কৃষকদের জন্য। কৃষকদের আয় বাড়াতে অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যদিও একথার প্রতিফলন বাজেটে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বরং মনরেগা হোক বা কৃষি প্রতিটি ক্ষেত্রেই গতবারের থেকে বাজেট বরাদ্দ কমে গেছে। মনরেগাতে কমেছে ৩৪ শতাংশ, কৃষিতে কমেছে ৮ শতাংশ। অনেকেই বলছেন, এই বাজেট মুষ্ঠিমেয় কিছু বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর আর শিল্পপতিদের জন্য, সাধারণের জন্য নয়। মানুষ কাজ ও আয় হারিয়েছে, সঞ্চয়টুকু শেষ অনেকের, ঋণগ্রস্ত হয়ে গেছেন অনেকে। গরিব ও প্রান্তিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সবথেকে বেশি। আর বাজেটে তাদের কথা না ভেবে উচ্চবিত্ত ও ব্যবসায়ী শ্রেণির জন্য কিছু প্রত্যক্ষ করে সুবিধা দেওয়া হলো। যদিও অতীতে একাধিকবার কর্পোরেট ক্ষেত্রকে বিপুল কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাতে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায়নি। ভয়ংকর বেকারত্ব, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও দারিদ্র্যের প্রেক্ষাপটে উচিত ছিল সম্পদ বিতরণের ব্যবস্থা করা। সাথে সাথে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। কিন্তু বাস্তবে কর্মসংস্থানের প্রতিক্ষেত্রেই বাজেট বরাদ্দ কমে গেছে এবারের বাজেটে।