৫৮ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ৬ ফাল্গুন, ১৪২৭
লকডাউন, ধনীমোহিনী বাজেট ও পরিযায়ী শ্রমিক
অমর বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিগত মার্চ মাসে লকডাউন ঘোষণা করেন। লকডাউন ঘোষণার পর থেকেই গোটা দেশ দেখেছে পরিযায়ী শ্রমিকরা কী নিদারুণ দুর্দশার শিকার হয়েছেন। কোনো আগাম জানান না দিয়ে মোদী সরকারের হঠাৎ লকডাউন ঘোষণায় শ্রমিকরা বাড়ি ফিরতে পারেননি। ফলে হাজার হাজার কিলোমিটার হেঁটে ছোটো ছোটো শিশু, বয়স্ক মানুষদের নিয়ে পদযাত্রার করুণ দৃশ্য সংবাদপত্রের পাতায় এবং টেলিভিশনে সেই সময় ভাইরাল হয়েছে। পথে মারা গেছেন ৩০০-রও বেশি পরিযায়ী শ্রমিক। ছেলে মেয়ে কাঁধে মা, মায়ের আঁচল ধরে খেলারত শিশু, ট্রলি ব্যাগের উপর ঘুমন্ত শিশুর চলমান দৃশ্য, মাথায় ভারি বোঝা নিয়ে বউ বাচ্চার হাত ধরে শত সহস্র পরিযায়ী শ্রমিকের শ্রান্ত-ক্লান্ত পথ চলা নিয়ে সাহিত্য রচনাও হয়েছে। এর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের পুলিশ বাহিনীর অত্যাচার, লাঠি তুলে ধাওয়া করার দৃশ্যও আমরা দেখেছি।
সরকারের কাছে এইসব প্রাণের মূল্য কতটুকু - তাদের ভূমিকায় প্রমাণ মেলে। সরকার বলতে পারেনি ঠিক কতজন পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। সংসদে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষ কুমার গাংগুয়ার দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য আমরা শুনেছি। তিনি স্পষ্ট বলেছেন যে, পরিযায়ী শ্রমিক কতজনের মৃত্যু হয়েছে সে সম্পর্কে সরকারের কাছে কোনো তথ্য নেই। মে মাসের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২৫ থেকে ৩০মে’র মধ্যে পথ দুর্ঘটনায় পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে ১৯৮জন এবং আহত হয়েছেন ১,৩৯০জন। অনেক পরে শ্রমিক সংগঠনগুলির দীর্ঘ আন্দোলন ও দাবির চাপের পর সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ট্রেনের ব্যবস্থা করে। বিরোধী দলগুলো ও আমাদের মতো আমজনতার প্রশ্ন, সরকার যদি লকডাউন ঘোষণার আগে ট্রেনের ব্যবস্থা করত তাহলে এতো পরিযায়ী শ্রমিক মারা যেতেন না।
মার্চ মাসে লকডাউন ঘোষণার পর থেকে আমাদের দেশে কাদের সম্পদ বেড়েছে? কারা হয়েছেন লাভবান? অক্সফ্যাম এ বিষয়ে যে তথ্য দিয়েছে তা প্রমাণ করছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশ সেবা করার জন্য কাদের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এখন দেশে এক নম্বর ধনকুবেরে মুকেশ আম্বানি লকডাউন চলাকালীন সময় প্রতি ঘণ্টায় ৯০ কোটি টাকা করে আয় করেছেন। এরপর মোদীজির ধনকুবের পেয়ারের বন্ধুরা যেমন গৌতম আদানি, সাইপ্রাস পুনাওয়ালা, উদয় কোটাক, রাধাকৃষ্ণ দামানি, আজিম প্রেমজি এবং লক্ষ্মী মিত্তালের মতো শিল্পপতিরা ফুলেফেঁপে লাভবান হয়েছেন এবং এই সময় এদের সম্পদ বেড়েছে ৩৫ শতাংশ - টাকার হিসেবে ১৩ লক্ষ কোটি টাকার মতো।
অথচ এই লকডাউন চলাকালীন সময় কাজ হারাতে হয়েছে ১২ কোটি ২০ লক্ষ মানুষের। এদের ৭৫ শতাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রে এবং সেই হিসাবে কর্মহীন হন ৯ কোটি ২০ লক্ষ অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। বিনা নোটিশে লকডাউন ঘোষণা করার ফলে এই সমস্ত শ্রমিক এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন হন। অক্সফ্যাম রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে, ভারতের শীর্ষ ১১ জন ধনকুবেরের যতটা সম্পদ এ সময় হয়েছে, সেই সম্পদ দিয়ে পরবর্তী ১০ বছর ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প চালানো যায়।
নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর কাছে এবছরের বাজেটে স্বাভাবিকভাবে সকলে প্রত্যাশা করেছিলেন যে, পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সরকার কিছু আর্থিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এটা স্বাভাবিক, মানুষের ভোটে নির্বাচিত সরকারের কাছে লকডাউনের সময় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষের জন্য কিছু আর্থিক সুযোগ-সুবিধা মানুষ প্রত্যাশা করতেই পারে, কিন্তু এই সরকার এতই অমানবিক, নির্লজ্জ এবং ধনকুবেরদের পা চাটা যে, তারা একটি পয়সাও বর্তমান বাজেটে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য খরচ করার প্রস্তাব রাখেনি।
প্রথমত, শহরের গরিবদের জন্য কোনো কাজের কথা নেই কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২১-২২-এ। দ্বিতীয়ত, পরিযায়ী শ্রমিক এবং বেকারদের জন্য কোনো কাজের নিশ্চয়তার কথা বলা নেই। অর্থমন্ত্রী কিছু পুরনো স্কিমের কথা উল্লেখ করেছেন, যেমন এক জাতি এক রেশন কার্ড, যাতে রেশন কার্ড দিয়ে যেখানেই কাজ করতে যাবেন, সেখানেই রেশন তোলার সুযোগ পাবেন। তৃতীয়ত, বাজেটে অর্থমন্ত্রী একটা পোর্টাল চালু করতে প্রস্তাব দিয়েছেন, যার মধ্যে বিশেষকরে নির্মাণ শিল্পের শ্রমিকদের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষিত থাকবে। এর ফলে এদের জন্য স্বাস্থ্য, বাসস্থান, দক্ষতা, ইন্সিওরেন্স, ঋণ পাওয়ার এবং খাদ্য প্রদানের জন্য উপায় নির্ধারণের সুবিধা হবে, কিন্তু অর্থমন্ত্রী সীতারামন মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট (মনরেগা) সম্পর্কে একটি কথাও বলেন নি। মনরেগা প্রকল্প কর্মহীন মানুষের জন্য করা হয়েছিল যাতে তাঁরা বছরে একশো দিন কমপক্ষে কাজ পান। এই কাজের নিশ্চয়তা কী অর্থমন্ত্রী দিয়েছেন! এই প্রশ্নের জবাব সময় দেবে। মনরেগা-তে যে কাজের নিশ্চয়তা ছিল সেই সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী একদম নীরব থেকেছেন। আসলে নির্মাণ শ্রমিকদের পোর্টাল চালু করার অছিলায় মনরেগা প্রকল্প তুলে দেওয়ার চক্রান্ত পরিষ্কার। চতুর্থত, বাজেট ডকুমেন্টে সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত একটি পয়সাও দেওয়া হয়নি। তাছাড়া, অতীতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের কাজের ক্ষেত্রে এবং ২০২০ সালের বাজেটে কাজের যে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল তা এ বছর নেই। পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকার অতীতে সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত স্কিমগুলোর ক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগ করতেন, কিন্তু এ বছরে এ বিষয়ে কোনো অর্থ বরাদ্দ হয়নি। তাছাড়া এক জাতি এক রাষ্ট্র ব্যবস্থা যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। যদি প্রয়োগ করার ব্যবস্থা হতো রাজ্যগুলো তাহলে ইতিমধ্যেই পরিচিত শ্রমিকদের নাম নথিভুক্ত করে ফেলত। এ বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান নেই।
কোভিড-১৯-র মারণব্যাধির আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিক। কমপক্ষে ৬০ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন এবং বেতন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বিগত মে মাস থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত যে হিসাব আমরা দেখেছি বিশেষত সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং সিভিল সোস্যাইটি গ্রুপ এমপ্লয়মেন্ট স্কিম নিয়ে যে কাজ করেছে সেখানে বলা হচ্ছে - কোভিড ১৯ চলাকালীন সময়ে বেকারত্ব এবং আন্ডার এমপ্লয়য়মেন্ট ব্যাপকহারে বেড়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় বাজেটে এদের জন্যে কিছুই বলা হয়নি। সরকারের উচিত ছিল মানুষের হাতে মাথাপিছু ৭,৫০০ টাকা তুলে দেওয়া (বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের মতে) যাতে অর্থনীতিতে চাহিদা বাড়তে পারত এবং অর্থনীতি সমৃদ্ধ হতো।
আসলে এ বাজেট ধনীমোহিনী বাজেট। দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেছেন শিল্পপতিরা। স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান দীনেশ খাড়া উল্লসিত আত্মনির্ভর ভারতের এই ব্লু প্রিন্ট দেখে। জিরদা-র কর্ণধার নীতিন কামাথ বাজেট প্রস্তাবে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ দেখে আনন্দিত, বেদান্ত-র কর্ণধার অনিল আগরওয়াল তো একে ঐতিহাসিক বাজেট বলে অভিহিত করেছেন। ডিলাইট-র প্রধান এন ভেনকাত্রম বলেছেন, এতদিন পর সত্যি বিনিয়োগ ও বেসরকারিকরণের পথ দেখিয়েছে এই বাজেট। এইভাবে একে একে শিল্পপতি ধনকুবেররা দু’হাত তুলে মোদীজি ও তাঁর অর্থমন্ত্রীকে আশীর্বাদ জানিয়েছেন। আর কিছু সচ্ছল মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী চুঁইয়ে-পড়া অর্থনীতির প্রসাদের জন্য মোদীজি-কে তোষামোদ করছেন এবং মিডিয়ার প্রায় সকলেই প্রশংসায় যুক্তি তর্কে মেতে উঠেছেন।
এই সব তোষামোদকারীরা মানুষকে ভুল বোঝানোর ও বিভ্রান্ত করার দায়িত্ব নিয়েছেন। এতে আখেরে ওদের নিজেদের লাভ হবে, কিন্তু আমজনতাকে বিভ্রান্ত করে সর্বস্বান্ত করার এই অপকৌশলকে আমাদের পরাস্ত করতে হবে। ওদের জানিয়ে দিতে হবে দেশ বিক্রি করার জন্য মানুষ কাউকে প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী করেননি।