৫৭ বর্ষ ৪১ ও ৪২ সংখ্যা / ১৯ জুন ২০২০ / ৪ আষাঢ় ১৪২৭
ঘূর্ণিঝড় আমফানের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত দক্ষিণবঙ্গ
দুর্গত মানুষদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের লড়াই জারি
আমফানের তাণ্ডবে চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক মানুষের বাড়ি। দক্ষিণ বনহুগলীর হোগোলকুরিয়ায়।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আমফানের ভয়ঙ্কর তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় কলকাতা, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা সহ দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতার মধ্যে এদিন আমফানের আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে যায় গ্রামবাংলা। এর আঘাতে সুন্দরবনের সাগরদ্বীপ, কাকদ্বীপ, নামখানা, কুলতলি, বাসন্তী, পাথরপ্রতিমা বিপর্যস্ত হয়ে যায়। বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে, অসংখ্য গাছ ভেঙেছে, কাকদ্বীপ-কচুবেড়িয়ায় জেটির একাংশ ঝড়ের দাপটে ভেঙে পড়েছে। এরপর ঝড়ের দাপট দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে ছড়িয়ে পড়ে উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকায়। পূর্ব মেদিনীপুর জেলায়ওছ অসংখ্য কাঁচা বাড়ি ভেঙে পড়ে। এছাড়া এই ঝড়ের দাপটে হাওড়া, হুগলি, পশ্চিম মেদিনীপুর, নদীয়া জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই সমস্ত জেলায় অসংখ্য ঘর-বাড়ি ভেঙে পড়েছে। সুন্দরবন অঞ্চলে নদীবাঁধও ভেঙেছে প্রচুর। এছাড়া ভেঙেছে অসংখ্য গাছপালা। এই ঝড়ের দাপটে অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি চাষবাসের বিপুল ক্ষতি হয়েছে, মাঠের ফসল নষ্ট হয়েছে। কলকাতায়ও অসংখ্য গাছপালা, বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙেছে। কলকাতা সহ রাজ্যের বহু এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। আয়লা, বুলবুল কিংবা ফণী- কোনো ঘূর্ণিঝড়ই এত মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারেনি। এই ঝড়ের দাপটে রাজ্যে অন্তত ৮০ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে।
দিল্লির মৌসম ভবন থেকে আমফান ঝড়ের আগাম সতর্কবার্তা ছিলই। তা সত্ত্বেও এই বিপর্যয়ের মোকাবিলায় রাজ্য সরকার ও প্রশাসন বিভ্রান্ত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। ঝড়ের তাণ্ডবে বিপন্ন মানুষদের ত্রাণ ও উদ্ধারে রাজ্য প্রশাসন ও পঞ্চায়েতকে দেখা যায়নি। এ নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে মানুষের মনে। পানীয় জল, খাবার বিশেষ করে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় চূড়ান্ত ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে মানুষকে। কলকাতা শহর সহ রাজ্যের বহু এলাকায় ঝড়ের ৭২ ঘণ্টা পরেও বিদ্যুৎ আসেনি এবং রাস্তা থেকে ভাঙা গাছ সরানো হয়নি। অবশেষে ওডিশা থেকে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী এসে রাস্তায় পড়ে থাকা গাছ সরিয়ে দেয়। শেষপর্যন্ত উপায়হীন হয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর সাহায্য নেওয়া হয়। এদিকে মুখ্যমন্ত্রী ও কলকাতা কর্পোরেশনের প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান ফিরহাদ হাকিম প্রথমদিকে অনেক আশারবাণী শোনালেও তাঁদের উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। বিদ্যুৎ ও জলের ভয়ঙ্কর সমস্যায় জর্জরিত হয়েছে কলকাতা ও শহরতলী। কিন্তু কর্পোরেশনকে দেখেনি মানুষ। বিদ্যুৎ নিয়ে সিইএসসি এবং কর্পোরেশন পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেখিয়ে দায় সেরেছে। কলকাতাসহ বিভিন্ন জায়গায় অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় থাকা মানুষ উপায়হীন হয়ে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। আবার এই বিক্ষোভরত মানুষদের উপর লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ। এমনকি কিছু জায়গায় তৃণমূল কর্মীরাও প্রশাসন, পুলিশ এবং সিইএসসি-র বিরুদ্ধে বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন।
ভেঙে গেছে নদী বাঁধ। রায়দিঘিতে গ্রামবাসীদের সঙ্গে মেরামতিতে কান্তি গাঙ্গুলি।
এদিকে আমফানে বিধ্বস্ত মানুষদের জন্য প্রথম থেকেই সাধ্যমতো ত্রাণ ও পূনর্বাসনে উদ্যোগী হন বামপন্থীরা।। সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র আমফানের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য আবেদন জানান।
ঘূর্ণিঝড় আমফানের বিপুল ক্ষয়ক্ষতিকে অবিলম্বে জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে ঘোষণার দাবি জানায় সিপিআই(এম) সহ ১৬টি বাম ও সহযোগী দল। ২২ মে ১৬টি বামপন্থী দলের পক্ষে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আমফান রাজ্যের দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অংশে ধ্বংসলীলা চালিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সূচনা করেছে। কলকাতাসহ দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ধ্বংসলীলা সংগঠিত হয়েছে। হাজার হাজার মাটির বাড়ি মাটিতে মিশে গেছে। শুধু কাঁচাবাড়ি নয়, পাকা বাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আংশিকভাবে ভেঙেও পড়েছে। গ্রামবাংলায় মাঠের সব ধরনের সবজি ও ফসল নষ্ট হয়েছে। লক্ষ লক্ষ গাছ ভেঙে পড়েছে। বোটানিক্যাল গার্ডেনের ঐতিহাসিক প্রাচীন বটগাছের প্রচুর ডাল-পালা ভেঙেছে ও কয়েকশত গাছ নষ্ট হয়েছে। বিদ্যুৎব্যবস্থা বিপর্যস্ত, বিভিন্ন এলাকা জলমগ্ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয় মোকাবিলা এবং পুনর্গঠন, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ এককভাবে কোনো রাজ্য সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে পশ্চিমবঙ্গের এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে অবিলম্বে জাতীয় বিপর্যয় হিসাবে ঘোষণা করা এবং এই বিপর্যয় মোকাবিলায় পুনর্গঠনের কাজে সবরকমের সাহায্য সহযোগিতা করার আবেদন জানায় ১৬টি বাম ও সহযোগী দল।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০০৯ সালের ‘আয়লা’ ঘূর্ণিঝড়ের সময় রাজ্য সরকার যাতে পুনর্গঠনের টাকা না পায় তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিয়েছিলেন তৃণমূলের নেতা ও সাংসদরা। এর আগে ২০০১ সালে রাজ্যের ভয়াবহ বন্যাকে ‘ম্যানমেড’ বন্যা বলে অভিহিত করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তৃণমূল দল এবারের ঘূর্ণিঝড়ে বিপন্ন মানুষদের ত্রাণে বিন্দুমাত্র সাহায্য করেনি। উলটে মুখ্যমন্ত্রী দুর্গত মানুষদের কোনো সংগঠন যাতে ত্রাণ না দেয় সেই নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এরা এতটাই নির্লজ্জ যে, দুর্গত অঞ্চলে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের ত্রাণবিলির ছবি দেখিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ত্রাণ বিলির বিজ্ঞাপন করে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় পেরিয়ে যাবার দু’দিন পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়কে সঙ্গে নিয়ে আকাশপথে দুর্গত এলাকা ঘুরে দেখেন। বসিরহাটে প্রশাসনিক বৈঠক করেন এবং আমফানের বিপর্যয় মোকাবিলায় এক হাজার কোটি টাকা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যে পরিমাণ অর্থ সাহায্যের কথা বলেন, সে তুলনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। এপ্রসঙ্গে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেন, প্রধানমন্ত্রী অন্তত গৃহহীন মানুষের ঘর মেরামতির জন্য বরাদ্দ, যে মানুষ কাজ হারিয়েছেন তাঁদের একশো দিনের কাজ দিতে বরাদ্দবৃদ্ধি, প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার জন্য বার্ষিক বরাদ্দের মধ্যে আগামী তিন মাসের টাকা মঞ্জুর করা ইত্যাদি কাজ করতে পারতেন। তা করলেন না, বরং গুজরাটে ট্রাম্পকে স্বাগত জানাতে যা খরচ করেছিলেন তার চেয়েও কম গুরুত্ব দিলেন বাংলাকে।
এদিকে করোনা অতিমারী, লকডাউন ও ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত জনজীবনের প্রতি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের অবহেলার প্রতিবাদে ২৮ মে ১৬টি বামপন্থী ও সহযোগী দল রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে শামিল হয়।
গত ৬ জুন বামফ্রন্ট পরিষদীয় দলের পক্ষ থেকে ঘূর্ণিঝড় আমফানের ক্ষয়ক্ষতি দেখতে আসা কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিপর্যস্ত মানুষের স্বার্থে ক্ষয়ক্ষতি পর্যালোচনা করে দ্রুত ত্রাণ ও পুনর্গঠনের জন্য অর্থ বরাদ্দের দাবি জানানো হয়। বাম পরিষদীয় দলের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে এই দাবিও করা হয়েছে যে, বাস্তবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের হাতেই যাতে ত্রাণ ও অন্যান্য সুবিধা পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।