E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৭ বর্ষ ৪১ ও ৪২ সংখ্যা / ১৯ জুন ২০২০ / ৪ আষাঢ় ১৪২৭

বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যাঁদের আমরা হারালাম


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ বিধ্বংসী মারণ রোগ করোনা তথা কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ সংক্রমণের আবহে বিগত চার মাসে আমরা বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে হারিয়েছি। যাঁরা তাঁদের নিজস্ব অঙ্গনে বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আন্তরিক শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁদের স্মরণ করা হচ্ছে।

পি কে ব্যানার্জি

ভারতীয় ক্রীড়া জগতের অন্যতম উজ্জ্বল তারকা কিংবদন্তি ফুটবলার পি কে ব্যানার্জি গত ২০ মার্চ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নিউমোনিয়া, পারকিনসন সহ একাধিক রোগে তিনি ভুগছিলেন। প্রদীপকুমার ব্যানার্জি ক্রীড়াজগতে পি কে ব্যানার্জি নামে খ্যাত ছিলেন। তাঁর দীর্ঘ ফুটবলার জীবনে তিনি ভারতীয় দলের অধিনায়ক ‍‌হিসেবে অ‍‌লিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণ করেছেন। পরবর্তীকালে ভারতীয় দলের কোচিংয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের মতো দলের হয়ে যেমন বিপুল সফল্য এনে দিয়েছেন, তেমনি এই দুই দলের কোচও ছিলেন। এরিয়ান ক্লাবের হয়ে তাঁর ফুটবল জীবন শুরু। এরপর তিনি ইস্টার্ন রেলওয়ের হয়ে খেলেছেন।

১৯৩৬ সালে অবিভক্ত বাংলার ময়নাগুড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পি কে ব্যানার্জি ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য প্রথম অর্জুন পুরস্কার (১৯৬১), পদ্মশ্রী (১৯৯০) এবং ফিফা প্রদত্ত ‘অর্ডার অব মেরিট’ (২০০৪), ‘প্লেয়ার অব দ্য মিলেনিয়াম’ (২০০৫) উপাধি অর্জন করেছেন। এছাড়া অলিম্পিক কমিটি প্রদত্ত ‘ইন্টারন্যাশনাল ফেয়ার প্লে অ্যাওয়ার্ড’ পান।

পি কে ব্যানার্জির জীবনাবসানে ফুটবল জগৎসহ বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। শোকজ্ঞাপন করেছেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, রাজ্য বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রসহ বহু বিশিষ্ট মানুষ শোক প্রকাশ করেছেন।

অধ্যাপক মোহিত ভট্টাচার্য

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিশিষ্ট অধ্যাপক মোহিত ভট্টাচার্য-এর জীবনাবসান হয়েছে গত ৩ এপ্রিল কলকাতায়। বালিগঞ্জের জগবন্ধু ইনস্টিটিউশনে শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর দীর্ঘ শিক্ষক জীবনের শুরু। ইন্ডিয়া।ন ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে অধ্যাপনার পর তিনি দীর্ঘ সময় পড়িয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। জনপ্রশাসনের শতবার্ষিকী অধ্যাপক ছি‍‌লেন ‍‌তিনি। অধ্যাপক ভট্টাচার্য ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৬ বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসাবে কাজ করেছেন। বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানীয় ইনস্টিটিউশনের সাম্মানিক ফেলো ছিলেন। নগর সংক্রান্ত আলোচনায় আরবান স্টাডিজ সেন্টারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। অসংখ্য বইও তিনি লিখে গেছেন।

ডাঃ পল্লবকান্তি দাশগুপ্ত

করোনা আক্রান্ত হয়ে গত ২৫ এপ্রিল মধ্যরাতে কলকাতায় প্রথম মৃত্যু হয় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ পল্লবকান্তি দাশগুপ্তর। সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্সে এ ডি এইচ এস পদে কর্মরত ছিলেন তিনি। এক সময়ে কুষ্ঠ প্রকল্পেও কাজ করেছেন তিনি। অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাব‍‌লিক হেলথ থেকে জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা ছিল তাঁর। তিনি রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় স্বাস্থ্য কর্মীদের পিপিই, গ্লাভস, মাস্ক, ওষুধপত্র সুষ্ঠুভাবে সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর প্রয়াণে অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টরস সহ চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠন থেকে গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। ২৭ এপ্রিল বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসকরা তাঁর শ্রদ্ধা জানাতে ২ মিনিট নীরবতা পালন করেছেন।

এই ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পর ২৭ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে অস্থি শল্য চিকিৎসক ডাঃ শিশির মণ্ডলের।

চুনী গোস্বামী

কিংবদন্তি ফুটবলার চুনী গোস্বামী প্রয়াত হয়েছেন গত ৩০ এপ্রিল। সুগার ও স্নায়ু রোগে ভুগছিলেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২। তিনি ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি পূর্ববঙ্গের কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। প্রকৃত নাম সুবিমল গোস্বামী হলেও তিনি ক্রীড়াজগতে পরিচিত ছিলেন চুনী গোস্বামী নামেই। তিনি শুধুমাত্র ফুটবল খেলায় অনন্য অবদান রাখেননি, বাংলা দলের হয়ে তিনি ক্রিকেটও খেলেছেন। এছাড়া তিনি টেনিসও খেলেছেন। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৬২ সালে এশিয়ান গেমসে সোনা জেতে ভারত। তিনি এশিয়ান গেমস এবং ১৯৬০ সালে অলিম্পিকে ফুটবলে ভারতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি অর্জুন, পদ্মশ্রী পুরস্কার অর্জন করেন। ক্লাব ফুটবলে তিনি আজীবন খেলেছেন মোহনবাগানের হয়েই। তিনি ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত টাটা ফুটবল আকাদেমির ডিরেক্টর পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কলকাতার শেরিফও হয়েছিলেন।

ইরফান খান

বিশিষ্ট চলচ্চিত্রাভিনেতা ইরফান খান গত ২৯ এপ্রিল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বিশেষ এক ধরনের ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন ভুগছিলেন তিনি। লন্ডনে চিকিৎসার পর ফিরে এসেছিলেন দেশে। তিনি হিন্দি চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ব্রিটিশ এবং আমেরিকান চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন। তিনি ১৯৬৭ সালের ৭ জানুয়ারি জয়পুরে জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি সি কে নাইডু ট্রফিতে ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি এম এ পড়াশোনার পাশাপাশি ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় পড়ার সুযোগ পান। তিনি দূরদর্শনে চন্দ্রকান্তা, ভারত এক খোঁজ প্রভৃতি সিরিয়ালে অভিনয় করেন। ‘লাল ঘাস পে নীল ঘোড়া’ সিরিয়ালে তিনি লেনিনের চরিত্রে অভিনয় করেন। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে সালাম বম্বে, মকবুল, পান সিং তোমর, পিকু, হায়দার, জুরাশিক ওয়ার্ল্ড, লাইফ অফ পাই, নেমসেক, হিন্দি মিডিয়াম, আংরেজি মিডিয়াম প্রভৃতি। ‍‌‍‌তিনি ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় বাংলা ছবি ‘ডুব’ ছবিতে অভিনয় করেন। তিনি ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার এবং পদ্মশ্রী পুরস্কার অর্জন করেছেন। তাঁর স্ত্রী ও দুই পুত্র বর্তমান। ইরফান খানের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী সহ বহু বিশিষ্ট মানুষ শোকজ্ঞাপন করেছেন। সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি তাঁর প্রয়াণে শোক প্রকাশ করে বলেছেন, শুধু ভারতীয় সিনেমা নয়, বিশ্বের চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেই ওর মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি।

অধ্যাপক প্রবুদ্ধনাথ রায়

অর্থনীতির বিশিষ্ট অধ্যাপক, গবেষক প্রবুদ্ধনাথ রায়ের জীবনাবসান হয়েছে ২২ মে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের ডিন ছাড়াও সহ উপাচার্য (‍শিক্ষা)-র দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি অধ্যাপনার পাশাপাশি বহু প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করেছেন। একই সঙ্গে নীতি নির্ধারণের কাজও করে গিয়েছেন। তিনি আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে রাজ্য যোজনা পর্ষদের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

তিনি ১৯৩৪ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যাল‌য় থেকে অর্থনী‍‌তিতে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হবার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এম আই টি থেকে এবিষয়ে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন। টাকি সরকারি কলেজ দিয়ে অধ্যাপনার শুরু। ১৯৭০ সালে তিনি পড়াতে চলে আসেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বোস্টনে নর্থ ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত অধ্যাপকও ছিলেন। ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রবুদ্ধনাথ রায় রাজ্য অর্থ কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি নিজের প্রকাশনার পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের গবেষণার কাজও সমান্তরালভাবে করে গেছেন।

অধ্যাপক প্রবুদ্ধনাথ রায়ের জীবনাবসানে রাজ্য বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।

বিমলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

রাজ্যের গ্রন্থাগার আন্দোলনের প্রবীণ নেতা বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদের সভাপতি বিমলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ৯ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। ১৯৪২ সালের ১৬ নভেম্বর পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার মাদারিপুরের খোলসাগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কর্মজীবনে তিনি আকাশবাণীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি দীর্ঘকাল পশ্চিমবঙ্গের গ্রন্থাগার আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি ইয়াসলিক, এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তিনি এক সময় নিখিল ভারত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন।

অধ্যাপক হরিশঙ্কর বাসুদেবন

করোনায় আক্রান্ত হয়ে জীবনাবসান হয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক হরিশঙ্কর বাসুদেবনের। তিনি ১০ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি কেরালার মানুষ হলেও জীবন অতিবাহিত করেছেন কলকাতায়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‍‌তিনি ইতিহাসে স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন। তিনি মূলত ইয়োরোপ ও রাশিয়ার ইতিহাস, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, শিল্পের ইতিহাস, সমসাময়িক ভারতের অর্থনীতি ‍‌ও পরিকল্পনার ইতিহাস প্রভৃতি বিষয় পড়াতেন। তিনি নিজেও রুশ ভাষা জানতেন। তিনি দেশের জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সহ রাশিয়াতর আকাদেমি অব সায়েন্সেস, কিয়েভ বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডনের কিংস বিশ্ববিদ্যালয়, ফ্রান্সের এমএসএইচ, সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়, চীনের ইউনান নর্ম্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণার কাজ করেছেন। তিনি কলকাতায় মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ-এর অধিকর্তা ছিলেন। অধ্যাপক বাসুদেবন একাধিক বই এবং অসংখ্য মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর জীবনাবসানে সিপিআই(এম)-র রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র গভীর শোকজ্ঞাপন করেছেন। বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন সহ পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের পক্ষ থেকেও শোক প্রকাশ করা হয়েছে।

ঋষি কাপুর

হিন্দি ছায়াছবির জনপ্রিয় অভিনেতা ঋষি কাপুর ৩০ এপ্রিল মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই ক্যান্সার রোগে ভুগছিলেন। তিনি ২০১৮ সালে নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন চিকিৎসা করাতে। ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের বিখ্যাত কাপুর পরিবারে ১৯৫২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা রাজকাপুর ছাড়াও দাদু পৃথ্বীরাজ কাপুর, কাকা শাম্মী কাপুর, শশী কাপুর এবং দাদা রণধীর কাপুরও চলচ্চিত্র জগতে প্রতিষ্ঠিত নাম।

তাঁর স্ত্রী নীতু সিং, ভাই রাজীব কাপুর অভিনয় জগতে যুক্ত ছিলেন। তাঁর পুত্র অভিনেতা রণবীর কাপুর।

বাবা রাজকাপুরের ছবি ‘মেরা নাম জোকার’-এ ‍‌শিশু শিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্র জগতে আত্মপ্রকাশ। ‘শ্রী ৪২০’-এও একটি গানের দৃশ্যে শিশু শিল্পী হিসেবে ছিলেন তিনি। ‘ববি’ ছবিতে নায়ক হিসেবে আবির্ভাব ঘটে তাঁর। এরপর প্রায় তিন দশক ধরে ববি, লায়লা মজনু, কর্জ, চাঁদনি, সাগর, অমর আকবর অ্যান্টনি, কভি কভি, খেল খেল মে, দো দুনি চার, আউরঙ্গজেব প্রভৃতি অসংখ্য ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনয়ের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘ফিল্মফেয়ার পুরস্কার’ পান।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

এই উপমহাদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, বাংলাদেশের ‘জাতীয় শিক্ষক’ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৪মে ঢাকায় সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তি যুদ্ধের সেনানী আনিসুজ্জামানের বয়স হয়েছিল ৮৩। এই অনন্য ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ শোকপ্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর মতো বিদগ্ধ ও জ্ঞানী মানুষের মৃত্যুতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তাঁর জীবনাবসানে রাজ্য বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, তিনি শুধু বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপকই ছিলেন না, সামাজিক বিন্যাস পরিবর্তনের লক্ষ্যেও তিনি ভূমিকা পালন করেছেন। ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা সোচ্চার ছিলেন এবং কলম ধরেছেন বার বার। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারও তাঁর প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছেন।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার বাড়ি ছিল উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটে। দেশভাগের পর তাঁরা চলে যান বাংলাদেশে। তিনি ছিলেন ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি শিক্ষক। তিনি ছিলেন বাংলা আকাদেমির সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাভাষা ও সাহিত্যের এমিরিটাস অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে স্মৃতিপটে সিরাজউদ্দিন হোসেন, শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ স্মারকগ্রন্থ, নারীর কথা, ওগুস্তের ওসাঁর বাংলা-ফরাসি শব্দ সংগ্রহ, আইন-শব্দকোষ, আঠারো শতকের বাংলা চিঠি ও কাল নিরবধি ইত্যাদি। ২০১৮ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘জাতীয় অধ্যাপক’-এর সম্মানে ভূষিত করে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে তাঁর গবেষণা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রবন্ধ গবেষণায় অবদানের জন্য ১৯৭০ সালে বাংলা আকাদেমি সাহিত্য পুরস্কার, শিক্ষায় অবদানের জন্য ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা একুশে পদক-এ ভূষিত করেন। শিক্ষা ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করে। ২০০৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ডি লিট’ ডিগ্রি দিয়ে সম্মান জানায়। এছাড়া সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করে।

দেবেশ রায়

বাংলা ভাষার অন্যতম বিশিষ্ট লেখক দেবেশ রায়-এর জীবনাবসান হয়েছে ১৪মে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার কারণে তাঁকে সেখানে ভরতি করা হয়েছিল। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। এই বিশিষ্ট সাহিত্যিকের জীবনাবসানে সি পি আই (এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র, সি পি আই’র রাজ্য সম্পাদক স্বপন ব্যানার্জি, সি পি আই (এম) দার্জিলিঙ জেলা কমিটির সম্পাদক জীবেশ সরকার সহ বহু বিশিষ্ট মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শোকজ্ঞাপন করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ-র পক্ষ থেকেও তাঁর প্রয়াণে শোকজ্ঞাপন করা হয়েছে।

বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলায় ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর দেবেশ রায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বেড়ে উঠেছেন উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়িতে। সেখানে ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৫ সালে তিনি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। তিনি দীর্ঘদিন সি পি আই জলপাইগুড়ি জেলার সহ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭০-এর দশকের গোড়ায় অল্প দিনের জন্য তিনি জেলা সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই সময় তিনি পার্টির রাজ্য পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি জলপাইগুড়ি ক‍‌লেজে অধ্যাপনা করেছেন। পরবর্তীকালে কলকাতায় সেন্টার ফর সোশাল স্টাডিজে শিক্ষকতা ও গবেষণার কাজে যুক্ত ছিলেন।

দেবেশ রায় সাহিত্যিক হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তি হলো, ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, ‘উদ্বাস্তু’, ‘নিরস্ত্রীকরণ কেন’ ‘কলকাতা ও গোপাল’ ‘সময় অসময়ের বৃত্তান্ত’ ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ ‘তিস্তাপুরান’ প্রভৃতি। এছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য গবেষণাধর্মী কাজ হলো ‘উপনিবেশে সমাজ ও বাংলা সাংবাদিক গদ্য’। ১৯৯০ সালে তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার অর্জন করেন।

বাসু চ্যাটার্জি

বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক বাসু চ্যাটার্জি ৪ জুন মুম্বাইয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। সাধারণ মধ্যবিত্তের জীবন ভিত্তিক ছবি তৈরি করে তিনি দর্শকদের হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন।

১৯২৭ সালে রাজস্থানের আজমেঢ়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ট্যাবলয়েডের কার্টুনিস্ট হিসেবে জীবন শুরু করে চিত্রনাট্যকার এবং পরে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে বাসু চ্যাটার্জি বলিউডে নিজের আসন প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বিখ্যাত চিত্র পরিচালক বাসু ভট্টাচার্য-র সহকারী হিসেবে রাজকাপুর-ওয়াহিদা রহমান অভিনীত ‘তিসরি কসম’-এ তাঁর চলচ্চিত্র জগতে কাজের সূচনা। ১৯৬৯ সালে মুক্তি পায় তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি ‘সারা আকাশ’। তিনি ‘পিয়াকা ঘর’ ‘উসপার’ ‘রজনীগন্ধা’ ‘ছোটি সি বাত’, ‘চিতচোর’ ‘স্বামী’ ‘খট্টা মিঠা’ ‘সফেদ ঝুট’ ‘বাঁতো বাঁ‍‌তো মে’ প্রভৃতি বিভিন্ন ছবির মধ্যদিয়ে বলিউডে নিজস্ব ঘরানা তৈরি করেন। বাসু চ্যাটার্জি ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ ‘টক ঝাল মিষ্টি’ এবং ‘হচ্ছে টা কি’ ইত্যাদি বাংলা ছবিও নির্মাণ করেন।

ছায়াছবির পাশাপাশি তিনি দূরদর্শনের জন্য ‘রজনি’ এবং ‘বোমকেশ বক্সি’ সিরিয়াল তৈরি করেছেন। বাসু চ্যাটার্জির জীবনাবসানে রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী-সহ চলচ্চিত্র জগতের বহু বিশিষ্ট মানুষ শোক জ্ঞাপন করেছেন।