৫৭ বর্ষ ৪১ ও ৪২ সংখ্যা / ১৯ জুন ২০২০ / ৪ আষাঢ় ১৪২৭
কৃষিব্যবস্থাকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেবার বিরুদ্ধে ২৭মে রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে
সুপ্রতীপ রায়
এমনিতেই কৃষিক্ষেত্রে সঙ্কট বৃদ্ধি পাচ্ছিল। লকডাউনের ফলে কৃষিক্ষেত্রে দুর্দশা আরও বেড়েছে। যদিও প্রতিরোধে গ্রামীণ মানুষ আন্দোলনমুখী। আবার কোভিড-১৯-এর মধ্য দিয়ে সঙ্কট বেড়েছে। কিন্তু এই সঙ্কট নয়া-উদারবাদী সংস্কারগুলোকে আরও দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর করার সুযোগ তৈরি করেছে বলে মনে করছে শাসক সম্প্রদায়। শ্রমবাজারের সংস্কার এবং কৃষিব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
অপরিকল্পিতভাবে লকডাউন চাপিয়ে দেওয়ার ফলে কৃষিকাজ ও কৃষিজ পণ্য বাজারজাত করার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে যে কৃষক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন তাঁদেরকে আরও বিপদের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। লকডাউন কিছুটা শিথিল হলে খেতের যেটুকু ফসল বেঁচেছে তা অভাবী-বিক্রয়ে কৃষক বাধ্য হচ্ছেন। ১০০ দিনের কাজে খেতমজুরেরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
‘সংস্কার’-এর নাম করে যা কিছু করা হচ্ছে তা কৃষক ও গরিবের স্বার্থের বিরুদ্ধে। বেসরকারি বাজারকে সুবিধা পাইয়ে দিতে কৃষিপণ্যের বাজার কমিটি (এমপিএমসি)-র আইনকে লঘু করার জন্য অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছে এবং খামার-পণ্যের বাজার থেকে সব নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মডেল ঠিকা চাষ আইন ২০১৮, মডেল প্রজাসত্ত্ব আইন, কৃষি জমি লিজ আইন কার্যকর করা হয়েছে। কর্পোরেটরা যাতে কৃষিজমি কবজা করতে পারে এবং একইসঙ্গে যাতে বিদ্যুৎক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ করা যায় তার জন্য ভূমিসংস্কার আইনকে উলটে দেওয়া হয়েছে।
লকডাউন শুরু হওয়ার অনেক পরে বিজেপি সরকার লোকদেখানো আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করলেও কৃষক ও খেতমজুরদের সমস্যাগুলি নিয়ে তাতে কোনো ঘোষণাই করা হয়নি।
কৃষক, খেতমজুর এবং আয়কর দিতে হয় না এমন গরিব মানুষদের জন্য মাসে ৭৫০০ টাকা করে দেওয়া, ঋণগ্রস্ত পরিবারগুলিকে রেহাই দেওয়ার জন্য ব্যাপকভাবে ঋণমকুব, সি-২+৫০% সূত্র অনুসারে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে সমস্ত ফসল কিনে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া এবং এমজিএনআরইজি-এ প্রকল্পে দিনপ্রতি ৩০০ টাকা মজুরিতে ২০০ দিনের কাজ, লকডাউন শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিনামূল্যে রেশন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেওয়ার দাবিগুলি উপেক্ষিত হয়েছে প্যাকেজে। ফসল নষ্ট হওয়ায় কাজ হারিয়ে কৃষক ও খেতমজুররা যে রোজগার হারিয়েছেন তার ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি।
কৃষিক্ষেত্রে আরও বেসরকারি বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে ব্যবস্থার জন্য খাদ্যমজুতের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দিয়ে অর্থমন্ত্রী ১৯৯৫ সালের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আইন সংশোধনের ঘোষণা করেছেন। এর ফলে খাদ্যমজুত করাকেই মদত দেওয়া হবে। সরকারের পক্ষে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।
বিভিন্ন কৃষিজপণ্য সহ খাদ্যশস্যের দামের বিনিয়ন্ত্রণ ও মজুরদের সীমা তুলে দেওয়ার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যের সঙ্কট দেখা দেবে। কৃষকরা কোনো সুবিধা পাবেন না। এক দেশ, এক বাজার স্লোগানের মধ্যদিয়ে অবাধ বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিজেপি সরকারের নীতির ফলে অনাহার, দুর্দশা ও অসহায় অবস্থার মধ্যে থাকা কৃষকসমাজ ও গ্রামীণ গরিব মানুষের উপর আক্রমণ তীব্র হবে।
এই অবস্থায় সারা ভারত কৃষক সভা দাবি জানিয়েছে—লকডাউনের ফলে শস্য ও আয়ের যে ক্ষতি হয়েছে তা সরকারকে মেটাতে হবে; যাঁরা আয়কর দেন না তাঁদের সবাইকে মাসে কমপক্ষে ৭৫০০ টাকা করে দিতে হবে; ভূমিহীন ছোট ও মাঝারি কৃষিজীবী, ভাগচাষি এবং খেত মজুরদের ঋণ অবিলম্বে মকুব করতে হবে; প্রধানমন্ত্রী কিষান যোজনার মূল্য বাড়িয়ে বছরে ১৮ হাজার টাকা করতে হবে এবং সমস্ত ভাগচাষি ও আদিবাসী কৃষককে এর আওতায় আনতে হবে, লকডাউন-পর্বে বিক্রি করতে দেরি হওয়ার কারণে এবং রবিচাষে যে ক্ষতি হয়েছে তার পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
আরও দাবি জানানো হয়েছে—এমজিএনআরইজিএ-র কাজে বেকারভাতার ধারা অনুসারে সমস্ত খেতমজুরকে দিন প্রতি ৩০০ টাকা অথবা রাজ্যের ন্যূনতম মজুরির মধ্যে যেটা বেশি হবে সেটাই দিতে হবে। রেশন দোকান থেকে সবাইকে খাদ্যশস্য ছাড়াও রান্না তেল, চিনি, ডাল, চা, নুন, মশলাপাতি ইত্যাদির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস দিতে হবে। মাথাপিছু কমপক্ষে ১০ কেজি করে চাল বা আটা এবং পরিবার পিছু ৫ কেজি করে ডাল দিতে হবে।
উপরিউক্ত দাবিগুলির ভিত্তিতে ভারতজুড়ে আন্দোলন গড়ে উঠছে। ১৬ মে সারা ভারত কৃষক সংঘর্ষ কো-অর্ডিনেশন কমিটির নেতৃত্বে ২৫০ টির বেশি সংগঠন দেশব্যাপী প্রতিবাদ জানিয়েছে। ২৭ মে সারা ভারত কৃষক সভার কেন্দ্রীয় কমিটির ডাকে সারা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবাংলাতেও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে।
২৭মে হাওড়া জেলার শ্যামপুর ১, শ্যামপুর ২, বাগনান ২, আমতা ১, আমতা ২, উলুবেড়িয়া ২, উদয়নারায়ণপুর, ডোমজুর, সাঁকরাইল, জগৎবল্লভপুর ব্লক অফিস, বাগনান ব্লকের কল্যাণপুর, হাটুরিয়া, বাকসী, উলুবেড়িয়া ১ নং ব্লকের তপনা গ্রাম পঞ্চায়েতে কৃষকরা বিক্ষোভ দেখান ও ডেপুটেশন দেন। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন ব্লকে, খড়্গপুর মহকুমা দপ্তরে বিক্ষোভ ও ডেপুটেশন হয়। দাঁতন ১, দাঁতন ২, ডেবরা, খড়্গপুর গ্রামীণ ব্লক, কেশপুর বাজার, ক্ষীরপাই, চন্দ্রকোনা, গড়বেতা, গোয়ালতোড়, চন্দ্রকোনা রোড, কেশিয়ারি, মাদপুর, নারায়ণগড়ে কৃষকরা বিক্ষোভ দেখান।
এদিন নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর ১ নং ব্লক, কৃষ্ণগঞ্জ, ধুবুলিয়া, নবদ্বীপ, শান্তিপুর, নাকাশিপাড়া, বেথুয়াডহরি, দেবগ্রাম, কালিগঞ্জ, পলাশী, পলাশীপাড়া, বার্ণিয়া, তেহট্ট, নাজিরপুর, করিমপুর, চাকদহ, মদনপুর, হবিবপুর, হাঁসখালি, হরিনঘাটা, নোকাড়ি সহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ অবস্থান হয়। এদিন হুগলী জেলার ৬০টি জায়গায় শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুররা অবস্থান ও বিক্ষোভ দেখান। মশাট, চণ্ডিতলা ১, সিঙ্গুর বাজার, বলরামবাটি, আরামবাগ বাসস্ট্যান্ড, বৈচিপোঁতা, বেড়াবেড়ি, হরিপাল, নালিকুল, জাঙ্গিপাড়া, ডানকুনি, চন্দননগর স্টেশন, বাঁশবেড়িয়া, কোন্ননগর, হিন্দমোটর, উত্তরপাড়া, রিষড়া, চণ্ডীতলা, চুঁচুড়া ঘড়ির মোড়, পিপুলপাতি, খানাকুল ১নং ব্লক, শ্রীরামপুর প্রভৃতি স্থানে বিক্ষোভ-অবস্থান হয়। পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাট, হলদিয়া সহ ১৯টি ব্লক, ২টি মহকুমা ও তমলুকে জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ সভা অনুষ্ঠিত হয়।