৫৭ বর্ষ ৪১ ও ৪২ সংখ্যা / ১৯ জুন ২০২০ / ৪ আষাঢ় ১৪২৭
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বামপন্থীদের কাজ
বিমান বসু
পুঁজিবাদ সমস্যার সমাধা করতে পারেনা এটা বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি দেখিয়ে দিচ্ছে। করোনা ভাইরাসের জেরে বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে। ভিয়েতনাম,কিউবা,চীন সহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি এই রোগের মোকাবিলা করতে পারছে সাফল্যের সঙ্গেই। আমাদের দেশের মানুষ যখন সবরকম বিপদের মধ্যে, তখন বর্ণবিদ্বেষবাদী নীতি নিয়ে চলা ট্রাম্প-এর সঙ্গে মনুবাদী নীতিনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করছেন। এদিকে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প-এর বিরুদ্ধে মার্কিন পুলিশের দ্বারা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ জর্জ ফ্লয়েড-এর হত্যার প্রেক্ষিতে গোটা আমেরিকা উত্তাল। প্রতিবাদ সর্বত্র। এই সামগ্রিক পরিস্থিতিতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কোন্ পথ বামপন্থীদের। কমিউনিস্টদের কোন্ পথ বেছে নেওয়া উচিত। সেই পথই তারা বেছে নেবে, যে পথে জনগণের সার্বিক কল্যাণকর নীতিগুলি কার্যকর করা সম্ভব। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বুভুক্ষু এবং করোনা আক্রান্ত মানুষের স্বার্থে বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি ও আন্দোলন-সংগ্রামের পথে চলতে হবে। বামপন্থী শক্তির বিকাশ ঘটাতে কমিউনিস্ট এবং বামপন্থীদের মিলিত উদ্যোগে এবং কংগ্রেসের সহযোগিতায় তীব্র আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ১২ জুন সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বামপন্থীদের কাজ’ শীর্ষক ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তায় একথা বলেন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য এবং রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু।
২৫ মে আমেরিকার মিনিয়াপোলিস মিনেসোটায় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার বিরুদ্ধে কলকাতার মার্কিন কেন্দ্রের সামনে লক ডাউনের বিধিনিষেধ মেনে বামফ্রন্ট সহ ষোল দলের পক্ষ থেকে ১২ জুন একটি বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বর্ণবিদ্বেষ এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্লোগান এবং বক্তব্য পরিবেশিত হয়। এই বিক্ষোভ কর্মসূচির উল্লেখ করে বিমান বসু বলেন,এটা অত্যন্ত মর্মন্তুদ ঘটনা। জর্জ ফ্লয়েড যেখানে বারবার বলছেন আমি শ্বাস নিতে পারছি না, তবু শেষ পর্যন্ত তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করলো মার্কিন পুলিশ। এটা আব্রাহাম লিঙ্কনের সেই আমেরিকা, যেখানে গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে গনতন্ত্রের কথা বলা হয়। সেখানে নৃশংস ভাবে বর্বরোচিত কায়দায় জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যা করা হয়। তার প্রতিবাদে সারা পৃথিবীর মানুষ উত্তাল তরঙ্গ তৈরি করেছেন। শুধু কৃষ্ণাঙ্গরাই নন, আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ মানুষ, বিশেষত তরুণরাও বিক্ষোভ সংগঠিত করছেন সর্বত্র। হোয়াইট হাউস, পেন্টাগন-এর সামনে বিশাল জনতা। বাল্টিমোর থেকে বিশাল মিছিল এসে যোগ দিয়েছে সেই জমায়েতে। এই বিক্ষোভের মুখে ট্রাম্পকে আশ্রয় নিতে হলো সুরক্ষা টানেলে। করোনা সংক্রমণে এক নম্বর সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর পালের গোদা এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন কাতারে কাতারে মানুষ মারা যাচ্ছেন, গণ কবর দেওয়া হচ্ছে। তাই পুঁজিবাদ যে সমস্যার সমাধান করতে পারেনা এই সব ঘটনা বারবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
বিমান বসু বলেন, খোদ আমেরিকাতেই এখন এ কথা বলা শুরু হয়েছে যে, আমাদের জনপরিষেবা ব্যবস্থা যা আমরা তুলে দিয়েছি, সেটা সবটা তুলে দেওয়া ঠিক হয়নি। এটা শুরু হয়েছিল যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিজয় বৈজয়ন্তী সর্বত্র উড্ডীন। তখন বাধ্য হয়ে পরিষেবা মূলক কাজে সামান্য কিছু বিষয় যুক্ত করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পুঁজিবাদী দেশগুলো। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যা একেবারেই প্রত্যাহার করা হয়।
অন্যদিকে নিউইয়র্ক এর পুলিশের বড় কর্তা যেখানে জর্জ ফ্লয়েড-এর হত্যার ঘটনাটি সম্পর্কে বলেছেন, আমাদেরকে দেখতে হবে গণতন্ত্র কার্যকর রয়েছে কিনা। সংবিধান রক্ষিত হচ্ছে কিনা। সংবিধানের স্বার্থে আমাদের কাজ করতে হবে, কোন ব্যক্তির স্বার্থে নয়। বিমান বসু বলেন, এই ধরনের যে পরিবেশ-পরিস্থিতি পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বর্ণবিদ্বেষবাদ যার একটা বড় উদাহরণ। তার সঙ্গে আমাদের ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং মিস্টার ট্রাম্প তারা জিগরি দোস্ত হবার চেষ্টা করছেন। ট্রাম্পের বর্ণবিদ্বেষী নীতি এবং মোদীজির মনুবাদী নীতি। বর্ণবিদ্বেষ নীতি ভেদাভেদ তৈরি করে, আর মনুবাদী নীতিতে ধর্ম-বর্ণ-জাত বৈষম্য-সবটাই যুক্ত থাকে। এহেন ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলার জন্য প্রধানমন্ত্রী একটা স্যুট বানালেন যার দাম ১০ লক্ষ টাকা। কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী? ভারতের! যেখানে মানুষ বুভুক্ষু, অসাম্য মানুষে মানুষে,যেখানে বহু সমস্যা। মানুষ অনাহারে মৃত্যু, অপুষ্টির শিকার। সব ধরনের নেতিবাচক জিনিসগুলি যা যা হতে পারে সবই আমাদের ভারতে রয়েছে।
এই ধরনের একটা পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের দেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ কোভিড নাইন্টিন-এর শিকার হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি এই রোগকে মোকাবিলা করতে পারছে, যেখানে মৃত্যুসংখ্যা খুব সামান্য। ভিয়েতনামে মৃত্যুসংবাদ এখনো পাওয়া যায়নি। কিউবাতে সামান্য সংখ্যক মৃত্যু হয়েছে। আর চিনে একটা প্রদেশের ভেতরে যেভাবে রোগটা দেখা দিয়েছিল তাকে তারা ছড়াতে দেয়নি। চীনের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালু হয়েছে। যদিও আবার করোনার আক্রমণ হয়েছে, সেইসব এলাকায় তারা সাবধান হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে এর একটা সম্পর্ক রয়েছে। যে সমাজে স্বাস্থ্যপরিষেবা রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে সেখানে মানুষের মৃত্যুর হার কম, আক্রান্তের হার কম আর রোগমুক্তির হার বেশি। ফলে সামগ্রিকভাবে প্রশ্ন এসে দেখা দিয়েছে কোন্ পথ বামপন্থীদের। কমিউনিস্টদের কোন্ পথ বেছে নেওয়া উচিত। সেই পথ কমিউনিস্টরা বামপন্থীরা বেছে নেবে যে পথে জনগণের সার্বিক কল্যাণকর নীতিগুলি কার্যকর করা সম্ভব। সেই দিকে লক্ষ্য রেখে পথ চলতে হবে।
বিমান বসু বলেন, আমরা আমাদের পার্টির রাজ্য কমিটির সভায় মিলিত হয়েছিলাম। রাজ্য কমিটির সভা থেকে স্থির করা হয়েছে আমাদের কিছু আন্দোলনের কর্মসূচি নিতে হবে। কোন আন্দোলনের কর্মসূচি? কোন্ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে পশ্চিমবাংলা? পশ্চিমবাংলায় করোনা ভাইরাসের উপদ্রব আছে যা মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। আর সরকার এই করোনা ভাইরাসের আক্রমণকে হালকা চালে নিয়ে আত্মসন্তুষ্টির শিকার হয়েছিল। এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-কে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন আমি আর পারছি না মোকাবিলা করতে। আপনারা মোকাবিলা করুন। বিমান বসু মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের নেতৃত্বে একটা সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা নির্বাচিত। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিভাবে নাক গলাতে পারেন?
তিনি বলেন, এর সাথে যুক্ত একটা বড় সমস্যা আমফান সুপার সাইক্লোন। কিন্তু আমফান ঝড়ে যেভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাঁর মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েও মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন, সফল তাঁরা। অদ্ভুত ব্যাপার! নিজের স্বঘোষিত সাফল্যের কথা বলছেন।
দিল্লির সরকার সিদ্ধান্ত করেছে টাকা আসছে ক্ষয়ক্ষতি পূরণের। সেই টাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা বিডিও’র কাছ থেকে যখন রিলিজ হচ্ছে সেখানে এমনও দেখা গেছে যে ভাঙ্গা কুঁড়ে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একজন ছবি তুলে আবেদন করেছেন যার নিজের পাকা দোতলা বাড়ি আছে। তিনি তৃণমূলের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব—এটাই তার যোগ্যতা। সাংঘাতিক ব্যাপার! এখন সমস্ত বিডিও অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখানো উচিত। যে তালিকা জমা পড়েছে তা খতিয়ে দেখার জন্য কমিটি করার দাবি তোলা উচিত। কমিটি চেক করে দেখবে তালিকাটা ভুয়ো না সত্যিকারের। এটা মিলিয়ে দেখতে হবে। তাই সাব্যস্ত হয়েছে আমাদের রাজ্যে যে পরিবেশ-পরিস্থিতি চলছে তার জেরে খাদ্য সংকটের দিকে আমাদের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। ভবিষ্যৎ কি হবে বলা খুব মুশকিল। আবার একটা বড়ো খাদ্য আন্দোলনের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। কারণ খাদ্য সংকট তীব্র হবে। কারণ চাল-গম সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস অসাধু ব্যবসায়ীদের খপ্পরে চলে যাবে। তখন তারা কৃত্রিম ভাবে মানুষের মধ্যে অভাব তৈরি করার চেষ্টা করবে। বাজারে এখন যেমন তেমন মূল্যে জিনিসপত্র বিক্রি করার চেষ্টা হচ্ছে। রাজ্য সরকারের যে টাস্কফোর্স আছে তারা কোথাও যায় না, পরীক্ষাও করে না। তৃণমূল সুপার সাইক্লোন ত্রাণের কাজেও সাহায্য করেনি। তারা ত্রিপল সরবরাহ করা, খাদ্য সরবরাহ করার কাজে, সবজি পৌঁছে দেবার কাজেও সাহায্য করছে না। তারা শুধু নিজেদের স্বার্থ গোছাচ্ছে।
বিমান বসু দাবি করেন, এই সামগ্রিক পরিবেশ পরিস্থিতিতে দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার আমফানের বিপর্যয়কে জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা করার দাবিতে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করার প্রশ্নে সাহায্য করতে হবে এবং আয়কর দেন না এমন প্রতিটি পরিবারের ক্ষেত্রে ছ’মাস ৭৫০০ টাকা করে দিতে হবে। প্রত্যেকটি বাড়িতে মাসে ৩৫ কেজি চাল সরবরাহ করতে হবে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, মানুষের হাতে এখন টাকা দিতে হবে। একথা নোবেল বিজয়ী সহ বহু অর্থনীতিবিদ বলছেন। টাকা না থাকলে রিজার্ভ ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ছাপিয়ে মানুষের হাতে দিতে হবে। তাতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেবে না, অসুবিধা হবে না। মানুষ যদি এখন কিনতে না পারে তাহলে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি দেখা দেবে। তাই সামগ্রিক বিচারে একথা বলা যায় যে পরিবেশের মধ্যে আমরা আছি তা পরিবর্তনের জন্য দিল্লির বিজেপি সরকার তারা যেভাবে মানুষের ভেতরে বিরোধ বিভেদ তৈরি করতে চাইছে ধর্মের-জাতের-বর্ণের বিভাজনের কথা বলে, তার মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।
বিমান বসু বলেন,বলার চেষ্টা হচ্ছে যে তৃণমূলকে ঠেকাতে হলে বিজেপি'র সাহায্য দরকার হবে। এটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার। তৃণমূল দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ধারক-বাহক। আর পাকাপোক্ত দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রতিভূ বিজেপি। স্বাভাবিকভাবেই তৃণমূলকে সরাতে তাদের আরেক শরিক যারা এই নীতি পরিচালনা করে বিজেপি তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নয়, বামপন্থী শক্তির বিকাশ ঘটাতে কমিউনিস্ট এবং বামপন্থীদের মিলিত উদ্যোগে প্রয়োজনে সমস্ত ধরনের বামপন্থী ও কমিউনিস্ট এবং কংগ্রেসের সহযোগিতায় তীব্র আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর দিকে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে এবং জেলায় জেলায় অসংখ্য কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষের কাছে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরতে হবে। বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচির মাধ্যমে পথ চলতে হবে। তাই সময় থাকতে এগিয়ে আসুন যুক্ত হন আন্দোলন-সংগ্রামে।