৫৭ বর্ষ ৪১ ও ৪২ সংখ্যা / ১৯ জুন ২০২০ / ৪ আষাঢ় ১৪২৭
‘‘৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড’’
পল্লব সেনগুপ্ত
অনেকদিন আগে আফ্রো-আমেরিকানদের জীবনচর্যা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে একটু নিবিষ্টভাবে পড়াশুনো করার খেয়াল হয়েছিল। খেয়ালটা অবশ্য বৃথা যায়নি! পরে অনেক সময়েই লেখালিখি করবার সময়ে ওই পড়াটা কাজে লেগেছে। সেই সময়েই পড়া একটা রূপান্তরিত-মিথকথার বিন্যাস সাম্প্রতিক একটা মর্মান্তিক এবং ভয়ঙ্কর ঘটনার সূত্রে মনে পড়ে গেল—যা আমেরিকার সমাজবিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে চিরকালই একান্ত প্রাসঙ্গিক।
কয়েকদিন আগে মিনিয়াপোলিস শহরের প্রকাশ্য রাজপথের ওপর ডেরেক শভিন নামের একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মী নৃশংসভাবে জনৈক আফ্রো-আমেরিকান তথা কালোমানুষকে হত্যা করেছে, এক উড়ো অভিযোগের ছুতো করে। সেই নিহত মানুষটির নাম জর্জ ফ্লয়েড—যে নাম এখন শুধু মার্কিন দেশেই নয়, সমস্ত ‘সভ্য’ দেশেই পরিচিত গণমাধ্যমের সুবাদে। সারা মার্কিন মুল্লুক এই ঘটনার প্রতিবাদে রুখে উঠেছে। সে দেশের সমস্ত ছোটো এবং বড়ো শহরে কাতারে কাতারে ক্রুদ্ধ, বিক্ষুব্ধ, ক্ষিপ্ত মানুষ মিছিলে-মিছিলে পথ হেঁটে সমস্ত কিছু অচল করে দিচ্ছে—এমনকি, এমনই একটা বিশাল জনস্রোত যখন খাস হোয়াইট হাউসের দরজায় এসে আছড়ে পড়েছিল, তখন খোদ ডোনাল্ড ট্রাম্প সপরিবারে সেই প্রাসাদের নিচে যে বাঙ্কার (ভূগর্ভ কক্ষ) আছে, সেইখানে প্রাণের ভয়ে ‘যঃ পলায়তি, স জীবতি’ এই আপ্তবাক্যটিকে মেনে লুকিয়ে পড়েছিলেন! এমন আর একটিই ঘটনার হদিশ দেয় ইতিহাস : বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে নৃশংস বলে গণ্য যে নরঘাতক, ওইভাবেই মাটির তলার গর্তে প্রাণের ভয়ে সস্ত্রীক লুকিয়েছিল একদা। তার নাম ছিল অ্যাডলফ হিটলার।
হিটলার অবশ্য শেষ অবধি রেহাই পায়নি। সস্ত্রীক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় সে। তবে, ট্রাম্প কিন্তু নিজের দেশের মানুষের হুংকৃত প্রতিবাদেই তাঁর সাদা মুখ ভয়ে আরও সাদা করে ওভাবে ইঁদুরের গর্তে লুকিয়ে পড়ে। হিটলারের তবু ভয় ছিল বিজয়ী রুশী সৈন্যদেরকে—কিন্তু ট্রাম্প? নিজের দেশের নিরস্ত্র প্রতিবাদী মিছিল দেখেই ‘বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ’ বলে ঢক্কানন্দিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন দশা হলো কেন? আজ পর্যন্ত তাঁর আগে যে ৪৪ জন ওই দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কারুর তো এমন হাল হয়নি!
।। দুই ।।
৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড—এই এতটা সময় ধরে ডেরেক শভিন জর্জ ফ্লয়েডকে পথের ওপর উপুড় করে ফেলে, তার ঘাড়ের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অংশ যেটি—পূর্ববঙ্গীয় উপভাষায় যাকে ‘ঘেঁটি’ বলে বোঝানো হয়—সেই হাড়টি যেখানে থাকে তার ওপর হাঁটু দিয়ে ঠেসে ধরে, দম বন্ধ করে দিয়ে খুন করেছে প্রকাশ্যে। আরও তিনজন ঊর্দিপরা নরশ্বাপদ তাকে সক্রিয় সাহায্য করেছে সেই ঘৃণ্য কাজে। রাস্তায় কিছু কিছু মানুষ তাদের মতো করে চেঁচিয়েছে এর প্রতিবাদে, কিন্তু ‘সুসভ্য’, ‘বিশ্বের স্বর্গরাজ্য’ বলে সদা-বিজ্ঞাপিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনরক্ষক পুলিশপুঙ্গববৃন্দ তাতে পাত্তা দেয়নি। ফ্লয়েড ছটফট করতে করতে ‘‘মা’’ বলে আর্তনাদ করেছেন, শান্তি-শৃঙ্খলার প্রহরীদের অনুনয় করে বলেছেন, ‘‘আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে’’- কিন্তু ট্রাম্পের বেতনভুক এই চারজন স্বদন্ত বার করে অট্টহাস্য করেছে—ছেড়েছে ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড পরে। পুরো এই পৌনে ৯ মিনিট ধরে একটা মানুষকে খুন করেছে ট্রাম্পের পুলিশ। এরই প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে ওদেশের মানুষ। এই ঘটনার প্রসঙ্গে পরে ফিরে আসছি। তার আগে যে কথার সূত্রে এই নিবন্ধের শুরু করেছি, ফিরি সেখানে। মিথকথার রূপান্তরণ কীভাবে ঘটে সেই নিয়ে এক সময়ে পড়াশুনো করতে গিয়ে ওলড টেস্টামেন্টের ‘বুক অব জেনেসিস’ খণ্ডের কেইন-আবেল কাহিনির একটি খুন তাৎপর্যপূর্ণভাবে অর্থান্তরিত পাঠের খোঁজ পেয়েছিলাম। মূল বাইবেল কাহিনিটা হয়তো অনেকেরই জানা। তবু একটু বলা যাক; আলোচনার সুবিধেই হবে তাতে!
মূল বাইবেল কাহিনিতে আছে : আদম এবং ইভের দুই ছেলে কেইন আর আবেল। ঈশ্বরের প্রীতিভাজন কে বেশি—এই নিয়ে দুজনের মধ্যে ঈর্ষা এবং দ্বন্দ্ব ছিল বাল্যকাল থেকেই। বয়স একটু বাড়ার পর থেকে সম্পর্কটা আরও বেশি তিক্ত হয়ে ওঠে। এবং দুজনের মধ্যে একদিন প্রবল ঝগড়াঝাঁটি শুরু হলে, হঠাৎই কেইন তার ছোট ভাই আবেলকে খুন করে ফেলে প্রবল রাগের বশে। তার পরেই সে পালাবার চেষ্টা করে বটে সেখান থেকে, কিন্তু ঠিক তখনই স্বয়ং ঈশ্বরের সামনে পড়ে যায় কেইন। তিনি তাকে শুধোন, তার ভাই কোথায়? কেইন কোনো উত্তর দিতে পারে না; বরং ভয়ে তার মুখ সাদা হয়ে যায়। ঈশ্বর তখন সমস্ত ব্যাপারটাই বুঝতে পেরে তাকে অভিশাপ দিয়ে নন্দনকানন থেকে বিতাড়িত করে দিলেন। তার নির্বাসন হলো সুদূর উত্তর দেশের হিমজর্জর অঞ্চলে।
বাইবেল অনুসারে এই হলো পৃথিবীতে প্রথম হত্যা এবং কেইন হলো পৃথিবীর প্রথম খুনি, প্রথম অপরাধী। সমাজবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ, বিশেষত সিএইচ হুক প্রমুখ মনে করেন এই কাহিনি প্রকৃতপক্ষে, পশুচারণজীবীদের সঙ্গে পরবর্তী আর্থ-সামাজিক শ্রেণি কৃষিজীবীদের দ্বন্দ্বের মিথীয় রূপক; এটা হলো কৃষিজীবীদের কাছে পশুচারণজীবীদের হেরে যাবার কাহিনি : কৃষক কেইনের হাতে পশুপালক আবেলের হত্যা হলো তারই প্রতীক। অর্থাৎ, নতুন অর্থনৈতিক শ্রেণি সুপ্রতিষ্ঠিত হলো।
।। তিন ।।
আড়াইশো-পৌনে তিনশো বছর ধরে আফ্রিকার বিভিন্ন পশ্চিম উপকূলবর্তী দেশ থেকে হাজার-হাজার মানুষকে বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিল ইয়োরোপ থেকে যাওয়া হিংস্র, অর্থলোলুপ শ্বেতাঙ্গ দাস-ব্যবসায়ীরা তাদের গুলি-বন্দুকের জোরে। অল্প সংখ্যায় নিজেদের দেশগুলিতে এবং বেশি—অনেক বেশি সংখ্যায় অতলান্তিকের ওপারে, আমেরিকা মহাদেশে। সেখানে তাঁরা বংশানুক্রমে ক্রীতদাসের জীবনযাপন করতে বাধ্য হন। খেতে, খামারে, ধনী উপনিবেশকারীদের ঘরে, শ্রম দিয়ে এবং ঘৃণা, অপমান, অত্যাচার সহ্য করে। বিভিন্ন আফ্রিকীদেশ থেকে-যাওয়া নানা এথনিক গোষ্ঠীর, নানা সংস্কৃতির, নানা ভাষার মানুষেরা সেখানে একে অন্যের, অন্যদের সাহচর্যে থাকতে থাকতে একটা নতুন ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ মানুষের গোষ্ঠী তৈরি হয়ে যায় ক্রমে ক্রমে। হাজার হাজার থেকে লক্ষ লক্ষ পৌঁছে গেছে তাঁদের সংখ্যা পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে। গড়ে উঠেছে একটা ‘ব্ল্যাক পিপলস’ কালচার। আফ্রো-আমেরিকানদের ভাষাটা ততদিনে ইংরেজিই, তবে তাঁদের নিজস্ব গণ্ডিতে বিশেষ ধরনের উচ্চারণ, বিশেষ ধরনের ঋদ্ধ এক শব্দভাণ্ডার, ইডিয়মের সমাহার। আর পিতৃপুরুষের ধর্মকেও তাঁরা ক্রিশ্চান মনিবদের চাপে ধরে রাখতে পারেন নি। এই মানুষগুলি তাঁদের প্রপিতৃপুরুষদের স্মৃতি এবং ঐতিহ্য—অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত। কিন্তু তাঁরা নিজেরা নতুন যে ঐতিহ্য গড়ে তুলেছেন, সেখানে মিথকথাও অবিরল। ‘‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এর ওই মিথটিও সেখানে প্রাপ্য। তবে নতুনতর ব্যাখ্যায়। বলি সেটা।
ঈশ্বরের দেওয়া নির্বাসনের দণ্ড—এই অবধি কাহিনির ঘটনা এবং ব্যাখ্যানে কোনো ফারাক নেই। তবে এর পরেই গল্পে একটা নতুন মাত্রা যুক্ত হলো : ঈশ্বর তিনবার কেইনকে শুধোলেন, তার ভাই কোথায়?আর ভয়ে প্রথমে তার মুখ ফ্যাকাশে এবং তারপরে আস্তে আস্তে সমস্ত শরীরটাই সাদাটে হয়ে গেল! এরপরই ঈশ্বরের চোখে পড়ল আবেলের মৃতদেহ, সেটা ততক্ষণে চড়া রোদে পড়ে থেকে থেকে প্রখর উত্তাপে পুড়ে পুড়ে কালো হয়ে গেছে! নির্বাসিত হয়ে কেইন চলে গেল হিমশীতল উত্তরে তার পরিবারবর্গদের নিয়ে—(অর্থাৎ, তারাই হলো ইয়োরোপের প্রথম মানুষ); আর আবেলের দেহটা নিয়ে তার পরিবার চলে গেল গ্রীষ্মজর্জর দক্ষিণে (অর্থাৎ, আফ্রিকায়) এবং তারাই হলো সেখানকার আদি বাসিন্দা। সেইজন্যেই উত্তরের সাদা মানুষদের ধমনীতে বইছে তাদের সেই খুনী পূর্বপুরুষদের রক্তধারা; আর তাই তারা আজও কালো মানুষদের খুন করে; উৎপীড়ন করে।
‘বুক অব জেনেসিস’-এর এই গল্পের ধর্মীয় অনুষঙ্গকে অতিক্রম করে ইয়োরো-আমেরিকান পণ্ডিতরা একভাবে তার সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন (হুকসের বলা কথাটা আবার মনে করা দরকার!), কিন্তু আমেরিকার উৎপীড়িত, শিকড় থেকে উচ্ছন্ন, বহু সহস্র যোজন দূর থেকে ধরে নিয়ে আসা অগণ্য কালো মানুষকে উৎপুরুষদের মনে যে রাগ এবং বিদ্বেষ জমে রয়েছে কয়েক শতক ধরে, সেটাই তো চুঁইয়ে-চুঁইয়ে পড়েছে মিথকথার এই নব ব্যাখ্যানে!
।। চার ।।
‘৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড’ এই কথাটা এই ক-দিনেই একটা প্রতীকী তাৎপর্য অর্জন করেছে। ওই সময়টুকুর পরিমিতি এখন মাত্র ৫২৬ সেকেন্ড নয়, কয়েক শতাব্দীর বর্ণবিদ্বেষের করুণ, নির্মম ইতিহাস ব্যঞ্জিত হচ্ছে এখন ওই চারটি শব্দের মাধ্যমে। ‘রেসিজম’ তথা ‘জাতিবিদ্বেষ’ শব্দটার যত ধরনের তাৎপর্য আছে অভিধানে, তারও ওপরে নূতন একটি অর্থব্যাপ্তি সংযোজিত হচ্ছে বিশ্ববিখ্যাত ‘মেরিয়াম ওয়েবস্টার ডিকশ্যনারি’-তে। এতদিন ধরে সেখানে ওই শব্দটির তিনটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়ে আসছিল। কেনেডি মিচাম নাম্নী এক তরুণী—যিনি আইন, সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে খুব সম্প্রতি উপাধি অর্জন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, চতুর্থ একটি ব্যাখ্যার্থ সংযুক্ত করতে অনুরোধ করেছেন ঐতিহ্যবাহী ওই অভিধানের বর্তমানে যাঁরা সম্পাদনার দায়িত্বে, তাঁদেরকে। মিচাম যে নতুন ব্যাখ্যাটি দিয়েছেন তা হলো : ‘‘সিস্টেমেটিক অপ্রেশ্যন অব সার্টেন গ্রুপ অব পিপ্ল’’—‘সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিমাফিক গোষ্ঠী বিশেষকে উৎপীড়ন করা’...
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই শুধু নয়, ওই জঘন্য জাতিবিদ্বেষটা বিশ্বের অন্যত্রও আছে, তবে মার্কিন দেশে ওটা অনেক ক্ষেত্রে বহুজন সমর্থিত। (এই ব্যাপারটাকে অবশ্য আরও ব্যাপ্ত করে বলা যায় : শুধু জাতি বা গায়ের রং নয়, বহু সময়েই ভাষা এবং বিশেষত ধর্মের ক্ষেত্রেও ওই ‘সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিমাফিক গোষ্ঠীবিশেষকে উৎপীড়ন’ করতে দেখা গেছে অজস্রবার, অসংখ্য দেশে—এখনও দেখা যায়। এমনকি আমাদের এই ‘‘মেরা ভারত মহান’’ — এখানেও!)
হ্যারিয়েট বিচার স্টো-র ‘আঙ্কল টম’স ক্যাবিন’ থেকে অ্যালেক্স হেলির ‘রটস’ অবধি এবং তার পরেও—অদ্যাবধি অজস্র সাহিত্য নিদর্শনে সেই ‘‘সিস্টেমেটিক অপ্রেশ্যন অব সার্টেন গ্রুপ অব পিপল’’—মর্মান্তিকভাবে চিহ্নিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের একটি গানে আছে ‘‘শাদা-কালোর দ্বন্দ্বে যে ঐ ছন্দে নানান রঙ জাগে’’—কিন্তু সে তো দ্বান্দ্বিক বিচারে নন্দন তত্ত্বের বিশ্লেষণ! তার গুরুত্ব বিশেষভাবেই দার্শনিক অনুভূতির মধ্যে। কিন্তু সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ‘‘শাদা-কালোর দ্বন্দ্বে’’ নানান নয়, একটিই ‘‘রঙ লাগে’’ — সে রঙ, লাল : রক্তের রঙ। আর সেখানে যে ‘‘ছন্দ’’, তা কবির নয় : মৃত্যুর, উৎপীড়নের। সেই ছন্দ তো ওই ‘‘সিস্টেমেটিক অপ্রেশ্যনের’’, যেটা তরুণী আফ্রো-আমেরিকান আইনজীবী কেনেডি মিচাম বলেছেন ‘মেরিয়াম ওয়েবস্টার ডিকশ্যনারি’-র সম্পাদকমণ্ডলীর কাছে, ‘রেসিজম’ কথাটার চতুর্থ ব্যাখ্যা হিসেবে।
।। পাঁচ ।।
এর পরেও অবশ্য মহামহিম ট্রাম্প মহোদয় আদৌ কুণ্ঠিত বা লজ্জিত হন নি। উনি তো যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র মিলিটারি নামিয়ে লক্ষ লক্ষ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সাদা-কালো-বাদামি বর্ণের মানুষের এই প্রতিবাদকে রাইফেল দেখিয়ে দমিয়ে দেবার হুঙ্কার দিচ্ছেন! উনি বুঝেই নিয়েছেন যে, কিছু ‘গাত্রবর্ণ-উন্নাসিক’ (কমপ্লেক্সন-শভিনিস্ট’ শব্দটা খুব সম্প্রতি তৈরি হয়েছে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মার্কিন সাংবাদিকদের হাতে) সাদা মানুষরা ছাড়া (অর্থাৎ, যারা কেইনের উত্তরাধিকারী) তাঁর পিছনে আর কেউ দাঁড়াবে না, কেউ না! সুতরাং আগের বারে ‘জালিয়াতি’ ভোটে জিতলেও এবারে আর সেটা সম্ভব নয় (মানুষ সচেতন হয়ে গেছে বলে) বুঝেই তিনি ডেমোক্র্যাসির মুখোশ খুলে, নির্লজ্জ এক ডিক্টেটরের মতোই মুখ ব্যাদান করে দেখাচ্ছেন!
কিন্তু ‘ভবি’ বোধহয় এত সহজে ভুলবে না এবারে! ট্রাম্পের হয়ে কিংবা পরোক্ষভাবেও ‘কমপ্লেক্সন শভিনিজম’-এর কোলে ঝোল টেনে যদি কিছু কিঞ্চিৎ কথা লেখা বেরিয়ে যায় আমেরিকার প্রভাবশালী বড়ো বড়ো সব সংবাদপত্রে, তাহলে যে সব সাংবাদিকের প্রশ্রয়ে সেইসব লেখা প্রকাশিত হয়, নিজেদের অন্য সহকর্মীদের চাপেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হতে হয়েছে তাঁদেরকে! বৈদ্যুতিন মাধ্যমে তো রোজই দেখছি মার্কিন দেশের বড়ো বড়ো শহরে কাস্তে-হাতুড়ি আঁকা লাল পতাকার মিছিল! প্রতিদিনই তো কলকাতার কাগজে দেখতে পাচ্ছি আমেরিকা-প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে কেউ-না-কেউ ওদেশের ‘‘দিকে দিকে ‘ওঠা’ অবাধ্যতার ঢেউ’’ (সুকান্ত ভট্টাচার্য) কীভাবে সজোরে আছড়ে পড়ছে মহানগরগুলোর রাজপথে, তার ধারাবিবরণী দিয়ে যাচ্ছেন। প্রথমদিকে অবশ্য ট্রাম্পের খন্তা-বেলচারা আন্দোলনটাকে ‘হতচ্ছাড়া কমিনিস্টি’-দের উসকানি বলে ‘ঘেউ-মিউ’ ডাক ছাড়ছিলেন বটে, কিন্তু এখন সবাই স্পিকটি নট! কেবল ট্রাম্পই সোচ্চারে হ্রেষাধ্বনি করছেন মিলিটারি গার্ডদের নিশ্চিন্ত করা পাহারার আড়াল থেকে! আব্রাহাম লিংকন থেকে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র অবধি যাঁরাই কালো মানুষদের হয়ে কিছু করেছেন—তাঁরাই শহিদ হয়েছেন।
তবু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সমস্ত মানুষ—অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবীরা, শিল্পী-সাহিত্যিকরা এবং যুব-ছাত্র-শ্রমিকসহ আপনার-আমার মতো আমজনতার অন্তর্ভুক্ত যাঁরা, কেউই কিন্তু আন্দোলনকে সক্রিয় বা নৈতিকভাবে সমর্থন করতে বিরত হচ্ছেন না! সারা পৃথিবীতেই শুধু বিখ্যাত কৃষ্ণদেহী মানুষেরাই নন, সর্ববর্গের, সবস্তরের লোকেই ওই ‘৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড’-এর ঘটনাকে ইতিহাসের দিকসংকেত বলেই মনে করছেন এবং সেই ভাবনাটা খুবই সোচ্চার। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র পরিচালকদেরও অনেকে সেই প্রতিবাদের কোরাসে কণ্ঠ দিয়েছেন।
ব্যতিক্রম শুধু আমাদের ‘‘নমস্তে ট্রাম্প’’-বলা ৫৬ ইঞ্চির ১০ লাখি কোটের সেই তিনি!! হায়, জননী ভারতবর্ষ!