E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৭ বর্ষ ৪১ ও ৪২ সংখ্যা / ১৯ জুন ২০২০ / ৪ আষাঢ় ১৪২৭

অতিমারীর সময়ে সামাজিক সঙ্কট

গৌতম রায়


বিজেপি নেতা বিজয়শঙ্কর শাস্ত্রী দুই খণ্ডের বই লিখে প্রমাণ করতে চেয়েছেন, দলিত হিন্দুরা ইসলামের ভারত আগমনের আগে উচ্চবর্গীয় ছিল। মুসলমানদের জন্যেই নাকি তাঁরা নিম্নবর্গীয় হয়ে যান।

ব্রাহ্মণ্যবাদ বজায় রেখেও ‘বনবাসী কল্যাণ আশ্রমে’র ভিতর দিয়ে দলিত, আদিবাসী, তপশিলি জাতি-উপজাতিদের রাজনৈতিক হিন্দু করবার তাগিদে সঙ্ঘ যে উদ্যোগ নেয়, তার নগ্ন রূপ দেখা গেছে গুজরাট গণহত্যায়। গুজরাট গণহত্যার পর এদের সামাজিক প্রযুক্তি বজায় ছিল গোটা দেশেই জোরদারভাবে। কোভি‌ড-১৯ জনিত লকডাউন আর্থ-সামাজিক সঙ্কট তৈরি করেছে গোটা বিশ্বের মতোই আমাদের দেশেও। সেই সঙ্কটকে সঙ্ঘ-বিজেপি’র রাজনৈতিক অভিসন্ধি, সামাজিক বিভাজনের উদ্দেশে ব্যবহারের স্বার্থে বিজয়শঙ্কর শাস্ত্রীর দেওয়া তাত্ত্বিক অবস্থানকে ভয়ঙ্করভাবে ব্যবহার করা হয়েছে গত তিনমাস ধরে দেশজুড়ে।

বিজয়শঙ্করের এই উদ্ভট অনৈতিহাসিক তত্ত্বকেই কোভিড-১৯, লকডাউন ঘিরে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির নিরিখে গোটা বিষয়টাকে নিজেদের স্বার্থে রাজনৈতিক হিন্দুশিবির ব্যবহার করেছে। সেই ব্যবহারের তাগিদ থেকেই এই সঙ্কটকালে গোটা ভারতবাসীর সামাজিক জীবন অনেকখানিই পরিচালিত হয়েছে একপ্রকার বাধ্যবাধকতার ফলে। অপবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান হিসেবে উদ্ভূত যুক্তির সাহায্যে মানুষের সামনে তুলে ধরে, মানুষের মনোজগৎকে প্রভাবিত করবার যে মনস্তাত্ত্বিক পথ আরএসএস-বিজেপি বা তাদের সঙ্গীসাথীরা ব্যবহার করে, সেই পথ ধরেই লকডাউনের সময়ে সামাজিক বিভাজনের কাজটিকে জোরদারভাবে চালানো হয়েছে।

‘সামাজিক প্রযুক্তি’ সর্বশেষ পর্যায়ের প্রয়োগের সেই সাফল্যকে আরও সংহত করতে বিজয়শঙ্করের তত্ত্বকে প্রয়োগ করেছে সঙ্ঘ লকডাউনের সময়কালে। সেই তত্ত্বকে সামাজিক প্রযুক্তির ভিতর দিয়ে শক্তিশালী করেছে। এই বিষয়টিকে কিন্তু গোটা ধর্মনিরপেক্ষ শিবির কতটা সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেছে তা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের ভিতরে বিতর্কের পরিবেশ ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে।

অপরিকল্পিত লকডাউন যে অর্থনৈতিক সঙ্কট গোটা দেশজুড়ে তৈরি করবে, তার জেরে একটা বড়ো রকমের সামাজিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে— সঙ্ঘ এটা ভালোভাবেই বুঝেছিল। তাই মানুষের দুর্দশাকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনে রূপান্তরিত করতে, করোনা ঘিরে সঙ্কটের সম্ভাবনা আরম্ভ হতেই সঙ্ঘ তার সুনিবিড় সামাজিক প্রযুক্তির সাহায্যে দেশজুড়ে দিল্লির নিজামুদ্দিনে তবলিকে জামাত ঘিরে অসভ্যতামি শুরু করে দেয়। এই প্রচারটিকে এতো নিবিড় দক্ষতার সঙ্গে মানুষের সামনে মেলে ধরে সঙ্ঘ তার সামাজিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগায় যে, সাধারণ মানুষ, যাঁরা গভীরভাবে সাম্প্রদায়িক নন, তাঁদের ভিতরেও মুসলমান সমাজ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জন্ম নিতে শুরু করে। এই অংশের মানুষ হারিয়ে ফেলেন তাঁদের যাবতীয় বিচারবোধ, যুক্তির ধারা-উপধারাগুলি।

কেন গত বছরের ডিসেম্বর থেকে আন্তর্জাতিকস্তরের বিভিন্ন সংগঠন, এমনকি রাষ্ট্রসঙ্ঘ এই অতিমারী ঘিরে যাবতীয় সতর্কতা উচ্চারণ করা সত্ত্বেও ভারত সরকার ন্যূনতম সতর্কতা অবলম্বন করেনি — এই প্রশ্নকে ছাপিয়ে যায় তবলিকের জামাতে অংশ নেওয়া মুসলিমদের ঘিরে অপপ্রচার। প্রগতিশীল বলে সমাজের বুকে পরিচয় দিতে তৎপর একাংশের মানুষও বলতে থাকেন, তাঁদের এলাকায় করোনা রোগী আগে ছিল না। দিল্লির নিজামুদ্দিন থেকে আসা লোকেদের ফলেই তাঁদের অঞ্চলে এই মারণব্যাধি ছড়াচ্ছে।

একটিবারের জন্যেও এই যুক্তিবোধ উঠে আসেনি যে, লক ডাউনের আগে অনুষ্ঠিত ওই ধর্মসভায় অংশ নেওয়া মানুষদের থেকে যদি মারণব্যাধি ছড়ানোর অভিযোগ তোলা হয়, তাহলে সেই ধর্মসভা করবার অনুমতি কি করে ভারত সরকার দিলেন? আন্তর্জাতিকস্তরে করোনা ঘিরে সতর্কতা উচ্চারিত হওয়ার পরও কি করে মার্কিন রাষ্ট্রপতির ওই রাজকীয় সংবর্ধনার আয়োজন গুজরাটে খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্যোগে নেওয়া হতে পারে? তবলিকে জামাত নিয়ে মুসলমানদের ঘিরে নোংরা প্রচার চলে সঙ্ঘ এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি’র বিভাজনের রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে। আর ট্রাম্পের সংবর্ধনা বা কেন কেন্দ্রীয় সরকার আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবা অনেক আগে বন্ধ করেনি— এই প্রসঙ্গগুলি ঘিরে হুইসপার ক্যাম্পেনিং হয় না, কারণ, এই বিষয়গুলি বিজেপি’র ইমেজ ড্যামেজ করে, তাই!

একশো বছরেরও কম সময় আগে প্রতিষ্ঠিত (১৯২৬) তবলিকি তরিকা ঘিরে রাজনৈতিক হিন্দুদের অনৈতিহাসিক প্রচারের মোকাবিলাতে প্রগতিশীল সমাজের যে দ্বিধাগ্রস্ততাও এই সময়কালে উঠে এসেছে তাকে যেমন অতিমারীকালীন সামাজিক সঙ্কটের একটা ভয়ঙ্কর দিক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, তেমনিই আগামীদিনের পক্ষে মৌলবাদী শক্তির কাছে একপ্রকার আত্মসমর্পণের ইঙ্গিতবাহী ঘটনা হিসেবেও একে অভিহিত করা যায়। মওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস প্রবর্তিত এই তবলিকি ভাবধারাতে গোটা দুনিয়ার কতজন মুসলমান নিজেদের যুক্ত করেছেন?— এই যুক্তিগ্রহ্য প্রচার কিন্তু করোনাজনিত সময়ে উঠে আসা বিতর্কে একবারে বড় হয়ে ওঠেনি।

ভারতে ইসলামের বিকাশে সুফি ভাবধারাই সবথেকে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছিল। এই ভাবধারার প্রথম এবং প্রধান লক্ষণ ছিল প্রেম আর ভালোবাসা। সেখানে অস্ত্রের কোনো ঝনঝনানি ছিল না। তবলিকপন্থীরা কিন্তু সুফি, পীরবাদকে সমর্থন করে না। বিরোধিতাই করে। তাই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ইসলামের ভারতে প্রবাহিত মরমিয়া ধারাকে অস্বীকার করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। আরএসএস তাদের ‘কোরান আর কৃপাণ’ তত্ত্বকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা দেওয়ার লক্ষ্যেই সুফি ভাবধারার সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন, পীরবাদের বিরোধী তবলিকপন্থীদের ঘিরে করোনা নিয়ে প্রচার করে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছে।

মুসলমান সংখ্যাধিক্যকে তবলিকের সঙ্গে গুলিয়ে দিয়ে, উপমহাদেশের মুসলমানেরা সুফিদের প্রেমের ধর্ম মানেন না— এটাকেও প্রমাণ করতে নিজামুদ্দিনের জামাতকে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক হিন্দুরা। কারণ, ইসলাম প্রেমের দ্বারা নয়, অস্ত্রের দ্বারা ভারত জয় করেছিল — এটাকে করোনার সঙ্কটের সময়েও মানুষের ভিতরে গেঁথে দিতে পারলে মুসলমানদের সম্পর্কে অপপ্রচার, বিভ্রান্তি ছড়ানোর ক্ষেত্রটি রাজনৈতিক হিন্দুদের পক্ষে অনেক বেশি সুবিধাজনক হয়।

নিজামুদ্দিনে তবলিকের জামাতে অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের থেকেই করোনা ভারতে বেশি বিস্তার লাভ করতে পেরেছে— এই ডাহা মিথ্যে প্রচারের ভিতর দিয়ে আরএসএস-বিজেপি গত কয়েকমাসে মুসলমানদের সম্পর্কে ঘৃণা ছড়াবার ক্ষেত্রে যতখানি সাফল্য পায়নি, লকডাউনেরকালে তার থেকে বেশ কয়েকগুণ বেশি সাফল্য পেয়ে গেল। এটা হলো লকডাউনকালে রাজনৈতিক হিন্দুদের স্বল্পমেয়াদি লাভ। এই লাভের ফসল তারা আগামী এক বছরের ভিতরে পশ্চিমবঙ্গ, আসামের মতো সীমান্তবর্তী যে রাজ্যগুলিতে ভোট আসছে, সেখান থেকে তুলতে ব্যবহার করবে।

আর মুসলমান মানেই তবলিক জামাতের লোক। জামাত, অর্থাৎ সমাবেশ, এই আরবি, বিশেষ্য পদের শব্দটির সঙ্গে মৌলবাদী ‘জামায়াতে ইসলাম’কে সম্পৃক্ত করে দিয়ে, মুসলমান মাত্রেই মৌলবাদী এবং তাঁরা মরমিয়া সাধনার সমর্থক নয়, উগ্রতার সমর্থক, সেই কারণেই ‘সন্ত্রাসী’— এই দীর্ঘমেয়াদি প্রচারকে এগিয়ে দিয়ে তার সুফল ঘরে তুলতে চায় রাজনৈতিক হিন্দুরা এই করোনা মহামারীজনিত ভয়ঙ্কর সঙ্কটের ভিতরেও। অপরিকল্পিত লকডাউন ঘিরে সাধারণ মানুষের যে ভয়াবহ সমস্যা, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষদের সঙ্কট, পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা, ব্যাপক ছাঁটাই, সব কিছু ছাপিয়ে আন্তর্জাতিকস্তরে ভয়াবহ খাদ্য সঙ্কটের আশঙ্কা—এসব ঘিরে সাধারণ মানুষের মনে ওঠা প্রশ্নকে হিন্দু-মুসলমানে পর্যবসিত করে এভাবেই নিজেদের মুখ লুকাতে চাইছে শাসক। এই প্রবণতায় কেন্দ্র আর রাজ্যের শাসক একে অপরের পরিপূরক। কেন্দ্রের শাসকদের সামাজিক বিভাজনের লক্ষ্যে নিজামুদ্দিন ঘিরে অসভ্যতা নিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস সম্পূর্ণ নীরব। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পেট্রাপোল দিয়ে লকডাউনের একটা পর্যায়ে বাংলাদেশের সঙ্গে পরীক্ষামূলক বাণিজ্য চালুর প্রশ্নে মন্তব্য করেছেন, জেহাদিরা সুযোগ পাবে। অর্থাৎ, নিজেকে ছদ্ম সংখ্যালঘু মসিহা দেখাবার মুখোশটা নিজেই টেনে খুলে ফেলেছেন মমতা। এই সঙ্কটকালেও মুসলমানদের সম্পর্কে, প্রতিবেশী বাংলাদেশ এবং সেখানকার নাগরিকদের সম্পর্কে তাঁর নিজের কি অভিমত, সেটিকে আর গোপন রাখতে পারেননি মমতা!