E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৭ বর্ষ ৪১ ও ৪২ সংখ্যা / ১৯ জুন ২০২০ / ৪ আষাঢ় ১৪২৭

‘আমরা করব জয়, নিশ্চয়’ – দৃষ্টান্ত কেরালা

বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়


ভারতে প্রথম করোনা সংক্রমিতের খোঁজ পাওয়া গেছিল কেরলে। ২০ বছর বয়সী এক যুবতীর। তারিখ ৩০ জানুয়ারি। দেশে প্রথম করোনা সংক্রমিতের মৃত্যু হয় কর্ণাটকে – ১০ মার্চ, মঙ্গলবার রাতে। কালবুরগিতে ৭৬ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ মারা যান। ১২ মার্চ, বৃহস্পতিবার রাতে কর্ণাটকের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বি শ্রীরামালু এক ট্যুইট বার্তায় সেকথা জানান।

বুধবার, ১৭ জুন, যখন এই লেখা লিখছি, মাঝখানে ১৩৭ দিন কেটে গেছে। দেশ সাক্ষী থেকেছে মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে ঘোষিত অপরিকল্পিত লকডাউনের। যে লকডাউনে সংক্রমণ কমেছে বা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। প্রশ্ন তোলাই যায় রাজ্যে রাজ্যে আটকে পরা পরিযায়ী শ্রমিক সহ দেশের কয়েক কোটি মানুষের সীমাহীন দুর্দশা এবং কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়েও। আপাতত সেই প্রশ্ন থাক।

আজ ১৭ জুন এই প্রতিবেদন লেখার সময়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রকের সকাল আটটার কোভিড-১৯ বুলেটিন প্রকাশিত হয়েছে। সে পরিসংখ্যান অনুসারে দেশে মোট সংক্রমিত ৩,৫৪,০৬৫ জন। অ্যাক্টিভ কেস ১,৫৫,২২৭। এখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১১,৯০৩ জনের। শেষ ২৪ ঘণ্টায় ২০০৩ জন মারা গেছেন এবং ১০,৯৭৪ জন সংক্রমিত হয়েছেন বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক।

আজকের পরিসংখ্যান অনুসারেই দেশের মধ্যে করোনা সংক্রমণে ১৮ তম স্থানে আছে কেরালা। মোট সংক্রমিত ২,৬২২ এবং অ্যাক্টিভ কেস ১,৩৬৬। এখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২০ জনের এবং শেষ ২৪ ঘণ্টায় ৭৯ জন সংক্রমিত হয়েছেন। এই তালিকার প্রথম পাঁচ রাজ্য হলো মহারাষ্ট্র (১,১৩,৪৪৫), তামিলনাড়ু (৪৮,০১৯), দিল্লি (৪৪,৬৮৮), গুজরাট (২৪,৫৭৭) এবং উত্তরপ্রদেশ (১৪,০৯১)। ওই পাঁচ রাজ্যে করোনা সংক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা যথাক্রমে ৫,৫৩৭, ৫২৮, ১,৮৩৭, ১,৫৩৩ এবং ৪১৭। পশ্চিমবঙ্গে মৃত্যু হয়েছে ৪৯৫ জনের এবং মধ্যপ্রদেশে ৪৭৬ জনের।

করোনায় আক্রান্ত থমাস (৯৩) ও মারিয়াম্মা (৮৮) সুস্থ হয়ে ফিরছেন কেরালার কোট্টায়াম জেলার সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে।

ভারতের করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি বোঝার জন্য এই পরিসংখ্যানটুকুই যথেষ্ট। বিস্তারিত জানার জন্য একাধিক ওয়েবসাইট, বিশেষজ্ঞরা তো আছেনই। ঠিক যেমন বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য আছে কিছু মিডিয়া এবং অবশ্যই করোনা পর্বে আবির্ভূত কিছু ভুঁইফোড় বিশেষজ্ঞ। যাঁরা মানুষকে সতর্ক করার বদলে আতঙ্কিত করতেই ব্যস্ত ছিলেন এবং আছেন। যাঁদের অনেকের কাছেই বিজ্ঞানসম্মতভাবে করোনা সংক্রমণ মোকাবিলা করার চেয়ে ‘থালা বাজানো’ ‘মোমবাতি জ্বালানো’ সহ নিত্য নতুন নিদান হাঁকাটাই মূল কাজ হয়ে উঠেছিল।

‘এই সময় রাজনীতি করবেন না’ বলেও কী পরিমাণ রাজনীতি গত ১৩৭ দিনে দেশে হয়েছে তার সাক্ষী তো ভারতবাসী। তবু অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক দূরে থাক। এই পরিস্থিতিতে আমরা না হয় বিজ্ঞানকেই সঙ্গী করি। একবার দেখে নেওয়া যাক, প্রথম করোনা সংক্রমিত রাজ্য হবার পরেও কী ভাবে কেরালা পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করল শুধুমাত্র সদিচ্ছা এবং সঠিক পরিকল্পনা দিয়ে। যে কারণে আজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও উচ্চপ্রশংসিত ‘কেরালা মডেল’। দৃষ্টান্ত।

জনস্বাস্থ্য বিষয়টাতে বরাবরই গুরুত্ব দিয়ে থাকে বামপন্থীরা। স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি বামপন্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি। যদিও বামপন্থীদের দাবির সঙ্গে দেশের বাস্তব মেলেনা। কিন্তু কেরালা করোনার ঝাপটা সামলে বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়ে নিলো জনস্বাস্থ্যে গুরুত্ব দিয়েই। যা স্বীকার করে নিয়েছে আইসিএমআর। কেরালার শক্তিশালী পাবলিক হেলথকেয়ার সিস্টেম এবং করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ভূয়সী প্রশংসা করে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিক্যাল রিসার্চ বা আইসিএমআর করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সবাইকে ‘কেরল রোল মডেল’ অনুসরণ করার কথাও জানিয়েছে।

গত মে মাসের প্রথম দিকে কেরালার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের ফেসবুক পেজে এক অনলাইন কথোপকথনে আইসিএমআরের এপিডেমিওলজি এবং কমিউনিকেবল ডিজিজ প্রধান ডঃ রামন আর গঙ্গাখেদকর বলেন : ‘‘করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কেরালা সবথেকে ভালো কৌশল অবলম্বন করেছে এবং এটি অতুলনীয়। করোনা-পরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আমরা কেরল মডেলের কথাই সর্বত্র তুলে ধরব এবং তা অনুসরণের কথা বলবো।’’

কেরালার এরনাকুলাম মেডিকেল কলেজে স্বাস্থ্যকর্মীরা কোভিড কিয়স্কে নমুনা সংগ্রহ করছেন।

কিন্তু কী এমন করেছিল কেরালা? যাতে বেঁধে ফেলা গেল করোনা ভাইরাসকে? এইপ্রসঙ্গে সংক্রামক রোগের বিশেষজ্ঞ ডাঃ শাহিদ জামিল জানিয়েছেন : কেরালা প্রথম থেকেই কড়া এবং মানবিক পদক্ষেপ নিয়েছিল। গত ১৪ এপ্রিল দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের এক নিবন্ধে বলা হয় – টেস্টিং বাড়ানো, চিহ্নিত করা, আইসোলেশন এবং চিকিৎসা – এতে গুরুত্ব দেবার কারণেই কেরালা দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকেই কেরালার সমস্ত বিমাবন্দরে কড়া স্ক্রিনিং-এর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। করোনা সন্দেহভাজন যাত্রীদের কোয়ারান্টাইনে পাঠানো হয়। এমনকি আইসোলেশনের সময় পূর্ণ না হওয়ায় একাধিক বিদেশি যাত্রীকে বিমান থেকে নামিয়ে ফের আইসোলেশনে পাঠিয়েছে কেরালা সরকার।

গত ২১ এপ্রিল দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার এক নিবন্ধে বলা হয় – কেরালা করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিয়েছিল জানুয়ারি থেকেই। বহু মানুষকে কোয়ারান্টাইনে পাঠানো হয়েছিল। দেশে লকডাউন শুরুর আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল স্কুল। মিড ডে মিলের খাবার ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। ধর্মস্থানে জমায়েত নিষিদ্ধ ছিল। নিয়ম ভাঙলে গ্রেপ্তার এবং এর পাশাপাশি কেরালার পিনারাই বিজয়ন সরকারের উদ্যোগে চালানো হয় জনসচেতনতা মূলক প্রচার ‘ব্রেক দ্য চেইন’।

এপ্রিল মাসে COVID-19 পরীক্ষার জন্য মানুষের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে দক্ষিণ কোরিয়ার মডেল - কিয়স্ক (kiosks) চালু করে কেরালার বাম সরকার। এরনাকুলামের সরকারি মেডিকেল কলেজে এ জাতীয় নমুনা সংগ্রহের কেবিন বসানো হয়। যার নাম দেওয়া হয় ওয়াক-ইন স্যাম্পল কিয়স্ক। যে কিয়স্কে নমুনা সংগ্রহকারী স্বাস্থ্যকর্মীরা সুরক্ষিত থাকেন। এর পাশাপাশি ১৪ সরকারি ল্যাবে এবং ৬ বেসরকারি ল্যাবে পরীক্ষা, নমুনা পরীক্ষার জন্য ৪৬৬টি পিসিআর মেশিন, সোয়াব সংগ্রহের জন্য ৬৫,০০০ উপকরণ, ৪৫,০০০ পিসিআর এজেন্ট কিট ও ৩৮,০০০ আরএনএস এক্সট্রাকশন কিটের ব্যবস্থা করা হয়। যে কারণে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে কেরলে সংক্রমণ মুক্ত হয়ে ওঠার হার ছিল শতকরা ৯৩.৮ শতাংশ।একইসঙ্গে কেরালা পাশে দাঁড়িয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদেরও। এই সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের অভিহিত করেছে ‘অতিথি শ্রমিক’ নামে। আচমকা লকডাউনে কার্যত পথে বাসরত পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য রীতিমত ক্যাম্প করে থাকার ব্যবস্থা, খাবার ব্যবস্থা হয়েছে রাজ্যের বাম সরকারের উদ্যোগেই।

অথচ এই লড়াইটা কেরালাকে লড়তে হয়েছে নিজের শক্তিতেই। কেন্দ্রীয় সাহায্য যতটা পাবার তার কিছুই পাওয়া যায়নি। সীতারাম ইয়েচুরি গত ৭ এপ্রিল এই প্রসঙ্গে এক ট্যুইট বার্তায় জানিয়েছিলেন– কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টে বলেছে দেশে ২২,৫৬৭টা সরকারি রিলিফ ক্যাম্প এবং শেল্টার চলছে। যার মধ্যে শুধু কেরালাতেই ১৫,৫৪১টা ক্যাম্প। অর্থাৎ সমস্ত ক্যাম্পের ৬৮.৮শতাংশ। আর কেন্দ্র স্টেট ডিজাস্টার রেসপন্স ফান্ডে সারা দেশের জন্য ১১,০৯২ কোটি টাকা মঞ্জুর করলেও কেরালার জন্য এসডিআরএফ-এ মঞ্জুর করেছে ১৫৭ কোটি টাকা। মাত্র ১.৪ শতাংশ। বঞ্চনার ছবিটা এখান থেকেই স্পষ্ট।

করোনা সংক্রমণজনিত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কেরালার বাম সরকারের ভূমিকা এত অল্প কথায় বলা সম্ভব নয়। ঠিক যেভাবে বাম সরকারের প্রতি রাজ্যের সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন, রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক, পুলিশের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। সঠিক পরিকল্পনায় রাজ্যের মানুষকে পাশে নিয়ে কেরালার বাম-গণতান্ত্রিক সরকারের এই লড়াই অবশ্যই ঐতিহাসিক। ‘কেরল মডেল’ আজ বিশ্ববন্দিত।