৫৭ বর্ষ ৪১ ও ৪২ সংখ্যা / ১৯ জুন ২০২০ / ৪ আষাঢ় ১৪২৭
অনেক কিছুই করার বাকি
তপন মিশ্র
মাত্র ১ গ্রাম ভাইরাসে কাবু সারা দুনিয়া। পৃথিবীতে এমন কোনো রাসায়নিক বা বিস্ফোরক নেই যা কিনা এতো কম পরিমাণে পৃথিবীর হৃৎকম্পন করাতে পারে। পৃথিবীর অর্ধেক মানুষও যদি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন তবুও সমস্ত ভাইরাসকে এক সঙ্গে করে তার ওজন করলে ১-১.৫ গ্রাম হবে। এতোটাই ক্ষুদ্র এই পদার্থ। পদার্থই বলা ভালো কারণ ভাইরাস না খাবার খায়, না তার শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রিয়া চলে বা না তার অন্য বিপাক ক্রিয়া আছে। জীবনের একটি গুণই তার মধ্যে বর্তমান তা হলো সংখ্যায় বৃদ্ধি। এই গুণটা সে পেয়েছে কেবল আরএনএ’র উপস্থিতির কারণে। পৃথিবীর বুকে যে কোটি কোটি জৈব রাসায়নিক অণু রয়েছে তার মধ্যে কেবল নিউক্লিক অ্যাসিডই নিজের প্রতিলিপি তৈরির মাধ্যমে সংখ্যায় বৃদ্ধি হতে পারে। নিউক্লিক অ্যাসিড হয় ডিএনএ কিংবা আরএনএ এই দু’রকমের হয়। ভাইরাসও দু’রকমেরই হয়। কিন্তু অধিকাংশ প্রাণীনির্ভর ভাইরাসই আরএনএ ভাইরাস।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মূলত চারটি দেশকে করোনা মোকাবিলায় তাদের বিধি অমান্য করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। এর মধ্যে আছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রাজিল এবং রুশ। এর মধ্যে প্রথম তিনটি দেশের শাসক করোনার আবহে যেন আরও শক্তিশালী স্বৈরাচারী শাসক হয়ে উঠেছে। কয়েকটি বিষয় এদের মধ্যে সাধারণ। কেবল হু’র গাইডলাইন অমান্য করা নয় নিজেদের দেশের বিশেষজ্ঞদের কথাও অমান্য করেছেন। মানুষ যখন এই সময়ে গৃহবন্দি তখন নানান ধরনের ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও এরা একইভাবে তৎপর। এরাই করোনার নিদান ঠিক করছেন। সমাজবিজ্ঞান থেকে শুরু করে প্রকৃতিবিজ্ঞানের সমস্ত নিয়মকানুন অস্বীকার করার প্রবণতা এদের সহজাত।
বিজ্ঞান গবেষণার সংহতি এক গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা
কোভিড-১৯-এর ভাইরাস নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরে মুকুট পরা এই ভাইরাসসমূহকে করোনা ভাইরাস বলা হয়। ভাইরাসের প্রকৃতি পরিবর্তন একটি সাধারণ ঘটনা। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের আরএনএ’র মিউটেশন অর্থাৎ গঠনের হঠাৎ পরিবর্তন বেশ কয়েকবার ঘটার ফলে SARS (Severe Acute Respiratory Syndrome) এবং MERS (Middle East Respiratory Syndrome)-এর করোনা ভাইরাস তৈরি হয়েছে। বর্তমানের করোনা ভাইরাসও এভাবেই আত্মপ্রকাশ করে। কেবল চীনের ইউহান শহরে নয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভাইরোলোজি গবেষণাগারগুলিতে এই ধরনের ভাইরাস নিয়ে গবেষণা চলছে।
PubMed পত্রিকায় ২০১১ সালে আমেরিকার নামভিলের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা করোনা গোত্রের ভাইরাসের আরএনএ’র প্রতিলিপি তৈরির দাবি করে। ইউহানে করোনা আক্রমণের পর বিশ্বে প্রথম এই সংক্রান্ত গবেষণার মধ্য দিয়ে বর্তমানের করোনা ভাইরাসের চরিত্র নির্ধারণ করে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন চীনের বিজ্ঞানীরা। ২৪ জানুয়ারি The Lancet (একটি বিশ্ববিখ্যাত প্রাচীন চিকিৎসাবিজ্ঞানের পত্রিকা)-এ যে প্রবন্ধটি ওরা লেখেন সেটি হলো Clinical features of patients Infected with 2019 novel corona virus in Wuhan, China। এখানের ভাইরাসের আরএনএ’র গঠন এবং রোগ সম্পর্কে বিশদ তথ্য প্রকাশিত হয়। নিরাময়ের উপায়, প্রতিরোধের পদ্ধতি তৈরি করতে হলে প্রথমে যা চাই সেটাই ওরা করে দেখান। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে গবেষণার জন্য চীনের সরকারি সংস্থাগুলি এমনকি বেজিং মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলও অর্থ বরাদ্দ করে। এমযন ঘটনা আমাদের দেশে এমনকি মার্কিন মুলুকেও ভাবা দুষ্কর।
যখন কোভিড-১৯-এর জন্য চীনের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির চেষ্টা হচ্ছে তখন পৃথিবীর বিভিন্ন বিজ্ঞান পত্রিকায় এই সমস্ত বিদ্বেষ বন্ধ করে যৌথ গবেষণার উপর জোর দেওয়া হয়। Nature Medicine পত্রিকা বিশ্বের প্রায় ১২৫টি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের স্বাক্ষর সহ একটি আবেদন প্রকাশ করে। এখানে তথ্যের আদানপ্রদান প্রক্রিয়াকে দৃঢ় করা এবং জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের কাছে বিজ্ঞানের সাফল্য পৌঁছে দেওয়ার আবেদন করা হয়। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি The Lancet আরও একটি একই ধরনের আবেদন প্রকাশ করে। সেখানেও বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠিত জীবপ্রযুক্তি বিজ্ঞানী ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এক আবেদনে বলেন : ‘‘We sign this statement in solidarity with all scientists and health professionals in China who continue to save lives and protect global health during the challenge of COVID-19 outbreak’’। বিজ্ঞানের এই যৌথ আবেদন উল্লেখিত রাষ্ট্রনায়কদের চক্ষুশূল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে বয়কট
এই অতিচালাক, স্বৈরাচারী শাসকদের কিছু সাধারণ চরিত্র আছে। যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তখন League of Nations থেকে এক এক করে জার্মানি, ইতালি, জাপান ইত্যাদি দেশ সরে দাঁড়ায়। আসল উদ্দেশ্য হলো বিপদের মুখে (বিশ্বায়িত মন্দার বিপদ) বিশ্ব সংহতিকে দুর্বল করা। তার কিছুদিন আগেই সোভিয়েত লিগে যোগদান করেছে কিন্তু আমেরিকা কোনদিনই লিগের সদস্য হয়নি। যখন বিশ্বজোড়া উষ্ণায়নের বিপদ নেমে আসছে তখন ১৯৯৭ সালের কিয়োটো চুক্তিতে আমেরিকা ও তার দোসররা স্বাক্ষর করেনি। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে সই করলেও ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছেন। আর ২০২০ সালে যখন কোভিড-এর আতঙ্কে সারা বিশ্ব কাঁপছে তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে যায় মার্কিন প্রশাসন। আমরা চুপ থাকি।
এই নিরিখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টাইম লাইন অর্থাৎ পর পর নেওয়া পদক্ষেপগুলি একবার দেখে নিন। গত ৩১ ডিসেম্বর চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে এক ভয়ঙ্কর নিউমোনিয়ার কথা জানায়। ১ জানুয়ারি তাদের Incident Management Support Team (গবেষক ও চিকিৎসকদের বিশেষ দল)-কে তথ্য সংগ্রহের কাজে লাগায়। ৪ এবং ৫ জানুয়ারি চীন এই মারণ রোগ সম্পর্কে বিশ্বের সমস্ত দেশকে অবহিত করে। ১০ জানুয়ারি প্রাথমিকভাবে এই রোগ থেকে দূরে থাকার পথ নির্দেশ জারি করে। ১২ জানুয়ারি চীন কোভিড-১৯ ভাইরাসের গঠন এবং জিনের সজ্জারিত (Genetic Sequence) বিশ্ববাসীকে জানায়। এই সিকোয়েনশই হলো ভাইরাসের আসল পরিচয়। তারপর চীনে হু’র বিশেষজ্ঞ দল গিয়ে রোগের চরিত্র নিয়ে অনুসন্ধান করে। ১৬-২৪ জানুয়ারি বিশ্বের প্রায় ৭টি দেশের বিশেষজ্ঞরা ‘হু’র নেতৃত্বে ইউহান পরিদর্শন করেন। এই দেশগুলির মধ্যে কানাডা, জার্মানিসহ আমেরিকার সিডিসি (Centre for Disease control and Prevention) অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং এই সমস্ত ঘটনার পর বিশ্বব্যাপী মহামারীর ঘোষণা হয়।
এই যে ঘটনাক্রম তার মধ্যে আমেরিকা বা ভারত সরকার তৎপরতা এবং বিশেষ করে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা, দেশের মানুষকে সচেতন করার ব্যবস্থার কোনো ধরনের গতি আনার চেষ্টা করেনি। এমনকি সেই সময়ে অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি ভারতে ট্রাম্পের সফর নিয়ে উন্মাদনায় দেশকে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করে দেশের সরকার। অবশেষে ১১ মার্চ ‘হু’ Pandemic (অতিমারী) ঘোষণা করে। আমাদের দেশে হঠাৎ লকডাউনের ঘোষণা করা হয় ২৪ মার্চ।
এই ভাইরাসের চ্যালেঞ্জটা কোথায়
প্রশ্ন হতেই পারে যে ভাইরাসের গঠন ইত্যাদির জটিল জেনে আমাদের কি কাজ। সমাজবিজ্ঞানের কিছু বিষয়ের মতোই প্রকৃতিবিজ্ঞানের কিছু বিষয় না বুঝতে পারলে প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি আমাদের কাছে রহস্যময় হয়ে থাকবে। এখানে যে রহস্য তৈরি করা হচ্ছে তা হলো, মিউটেশনের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। এটি নেহাতই অনুমান।
সমস্ত জীবজগতে কোষের মধ্যে জিনের হঠাৎ পরিবর্তন নিরন্তর চলতে থাকে। ভাইরাসের ক্ষেত্রেও তাই। সমস্ত রকমের মিউটেশন যে অর্থবহ হবে তাও নয়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা হানিকারক বা উপকারী হতে পারে। এটি নির্ভর করে প্রাকৃতিক নির্বাচনের উপর। কিন্তু আরএনএ ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই হঠাৎ পরিবর্তন বা মিউটেশন পদ্ধতিটি সামান্য ভিন্ন। ভাইরাস যখন কোষে প্রবেশ করে তখন সে কোষের প্রোটিন তৈরির সমস্ত ব্যবস্থাকে দখল করে নেয়। তখন তার একমাত্র কাজ হয় কম সময়ের মধ্যে নিজের আরএনএ-র মতো আরও আরএনও তৈরি করা। এই প্রোটিন আবরণে লাইপোপ্রোটিন অর্থাৎ ফ্যাট যুক্ত প্রোটিন থাকায় সাবান বেশ কাজে দেয়। কিন্তু আসল ভিলেন হলো আরএনএ। একটি আরএনএ তন্তু যখন ২টি বা ২টি থেকে ৪টি হতে থাকে তখন ‘প্রুফ রিডিং’-এর ব্যবস্থা থাকে। ডিএনএ প্রতিলিপি তৈরির সময়ও এই ‘প্রুফ রিডিং’-এর ব্যবস্থা থাকে। প্রুফ রিডিং না হলে যেমন অনেক ভুল ভ্রান্তি থেকে যায় এক্ষেত্রেও তাই হয়। এই ভুলভ্রান্তিগুলিই আসলে মিউটেশন।
অন্য একটি বিষয় সম্পর্কেও আমাদের সচেতন হওয়া দরকার। তা হলো বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং ক্রমবর্ধমান দূষণ। এগুলি মিউটেশন প্রক্রিয়াকে শতগুণ বৃদ্ধি করে। এনিয়ে অনেক গবেষণা চলছে। মিউটেশনসমূহের গতিপ্রকৃতি এবং সেগুলি নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি সম্পর্কে অনেক কিছুই আমাদের জানা বাকি। অজ্ঞতা থেকে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এখনকার কয়েকজন রাষ্ট্রনেতার ভূষণ। জ্ঞান কখনও এককের হয় না। জ্ঞান হলো সম্মিলিত প্রয়াসের ফল। একবার ভাবুন ট্রাম্প সাহেব হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন সম্পর্কে এতোটা উত্তক্ত হলেন কেন? ট্রাম্প নিজেও এই ম্যালেরিয়ার ওষুধটি সেবন করেন কারণ তাঁর মনে হয়েছে করোনা থেকে এই মহৌষধীটি তাঁকে রক্ষা করবে। বিশ্বের ১৫০০০ কোভিড রোগীর উপর এই ওষুধ প্রয়োগ করে কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি বলে একটি গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তবুও ট্রাম্পকে কে রুখবে। আমেরিকার বিভিন্ন সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সিডিসি’র ইতিবাচক ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও করোনা দমনের ক্ষেত্রে সিডিসি’র বিজ্ঞানী ও তাদের দক্ষতা এখনও ব্যবহার করছে না ট্রাম্প সরকার।
এদেশেও আইসিএমআর (Indian Council of Medical Research) কোভিড মোকাবিলায় সম্পূর্ণ ব্রাত্য। কোভিড নিয়ন্ত্রণে ভারতে তৈরি আইসিএমআর এবং অন্য বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত টাস্ক ফোর্স-এর পরামর্শ বার বার অবজ্ঞা করেছে মোদী সরকার। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে রোগটি সম্পর্কে দেওয়া সাবধানবাণী যেমন অস্বীকার করেছে তেমন লকডাউনের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে কোনো পরামর্শই সরকার নেয়নি।
ব্রাজিলের বলসোনারো সরকার কোভিড প্যানডেমিক ঘোষণার পর দু’বার স্বাস্থ্যমন্ত্রী পালটেছে। গত এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ডাঃ লুইজ মান্ডেটাকে বরখাস্ত করা হয়। দেশের বয়স্কদের এবং আদিবাসীদের অন্যান্য নাগরিকের সঙ্গে সমান সুযোগ দেওয়ার দোষে দুষ্ট হয়েছেন এরা।
এই প্যানডেমিক বিপদের সময় যেমন ভাইরাস শত্রুকে জানতে হবে তেমনই জানতে হবে সমাজের এই শত্রুদের। মহামারী তো নিশ্চয়ই কেটে যাবে কিন্তু এই ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রনায়কদের যোগ্য জবাব না দিতে পারলে মানবতার মুক্তি নেই।