E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৭ বর্ষ ৪১ ও ৪২ সংখ্যা / ১৯ জুন ২০২০ / ৪ আষাঢ় ১৪২৭

আরোগ্যসেতুর কী হেতু?

দেবেশ দাস


রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। আপনার স্মার্ট মোবাইলে আরোগ্যসেতুর অ্যাপের সাহায্যে হয়তো দেখতে পেলেন যে আপনার কাছাকাছি ২ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো করোনা রোগী আছে। এর সাথে আরেকটা খবরও অবশ্য আপনি বুঝে নিতে পারেন, ২ কিলোমিটারের মধ্যে ওই রোগীর স্মার্ট মোবাইল আছে ও তাতে আরোগ্যসেতু অ্যাপ ডাউনলোড করা আছে, নইলে আপনি খবরটাই পেতেন না। এই কথা থেকে বুঝতেই পারছেন, আরও অনেক সত্যি আপনার কাছে নেই। হয়তো যেখান দিয়ে হাঁটছেন, দু কিলোমিটার দুরের কথা, তার ৫০ মিটারের মধ্যেই কোনো করোনা পজিটিভ রোগী আছে, যার স্মার্ট ফোন নেই, বা থাকলেও তাতে আরোগ্য সেতু অ্যাপ ডাউনলোড করা নেই, ফলে আপনার মোবাইলে তার হদিশ থাকবে না।

একটা মাত্র জায়গা আছে, যেখানে সকলেরই হাতে স্মার্ট ফোন, আর সব মোবাইলে আরোগ্যসেতু। সেটা হচ্ছে আপনি যদি এরোপ্লেনে চড়েন। আরোগ্যসেতু অ্যাপ ছাড়া এয়ারপোর্টে ঢোকা এখন নিষিদ্ধ। চড়তে চড়তে আপনি আপনার মোবাইলে আরোগ্য সেতু অ্যাপে দেখতে পাবেন, আপনার ধারে পাশে কোনো করোনা রোগী নেই। ভাবতেই পারেন, আপনার সহযাত্রীরা সব সুস্থ সবল, তারা কেউ কোয়ারান্টাইনে ছিল না, কোনো করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসেনি। কারণ তা না হলে তো কেউ প্লেনে চড়তেই পারবে না। এই সব তথ্য যাত্রীকে বলতে হয়, আরোগ্যসেতু অ্যাপে এই তথ্য দিতে হয়। আপনার সেই ভাবনাতেও গণ্ডগোল, কারণ সবাই এসব তথ্য ভরেছে নিজে নিজে, সেখানে প্লেনে চড়ার জন্য কেউ ভুল তথ্য দিতেই পারে, আবার না জেনেও কেউ ভুল তথ্য দিতে পারে। কিছুদিন আগে, একটা খবর দেখলাম যে, প্লেন ছেড়ে যাওয়ার পর, খবর এসেছে যে পাইলটের করোনা পজিটিভ, প্লেন ফিরিয়ে এনে যাত্রী, বিমানসেবিকাদের পাঠানো হলো কোয়ারান্টাইনে, পাইলটের মোবাইলে তো আরোগ্যসেতু অ্যাপ অবশ্যই ছিল। ফলে ‘আরোগ্যসেতু’-র খবর দেখে আপনার নিশ্চিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

আরোগ্যসেতু অ্যাপে, কিছু তথ্য দিতে হয় সরকারকে। আপনার কি কাশি, জ্বর বা শ্বাসকষ্ট আছে? ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, ফুসফুসের রোগ, হৃদরোগ আছে বা ছিল? কিছুদিন আগে বিদেশে ছিলেন? করোনা আক্রান্ত কোনো রোগীর সংস্পর্শে এসেছিলেন?, ইত্যাদি। এই সমস্ত তথ্য থেকে অ্যাপ আপনাকে এটাও জানিয়ে দেয় যে আপনার কতটা ঝুঁকি আছে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার। যেমন কিছুই না থাকলে, আপনাকে বলে দিচ্ছে যে আপনি নিরাপদ। এটা জানাতে মোবাইল অ্যাপের দরকার পড়ে না্‌, এরকম একটা সফটওয়ার সহজেই বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায় ইন্টারনেটে, তাতে ডেটা ঢোকালেই তা আপনার ঝুঁকির পরিমাণ জানিয়ে দিতে পারে। আবার আপনার পাশের লোকটির মোবাইলে আরোগ্যসেতু আপ দেখাচ্ছে, সে নিরাপদ। তার মানে কি আপনি নিরাপদ? কারণ ওই পাশের লোকটা যে ডেটা ঢুকিয়েছে, তার ভিত্তিতে সে নিরাপদ।

সরকার বলছে যে, এই সমস্ত তথ্য নেওয়া হচ্ছে, বর্তমান স্বাস্থ্য সঙ্কট মনিটরিং ও গবেষণার জন্য। হ্যাঁ, আরোগ্যসেতু অ্যাপ যে স্মার্টফোনওয়ালারা ব্যবহার করছে, তাদের মধ্যে কয়েকজন যদি কোনো অঞ্চলে নিজেদের করোনায় আক্রান্ত বলে ঘোষণা করে, তবে সে জায়গাটা হটস্পট হবে, এ তথ্য মনিটরিং-এ কাজে লাগবে। করোনায় নিশ্চয়ই শুধুমাত্র স্মার্টফোনওয়ালারা আক্রান্ত হয় না। বরং গরিব মানুষগুলো যাদের স্মার্টফোন কেনার পয়সা নেই তারাই বেশি আক্রান্ত এখন। ফলে হটস্পট তো আরও অনেক আছে।

আবার আরোগ্যসেতু থেকে পাওয়া তথ্যে কী কী রোগ থাকলে আক্রান্ত বেশি হচ্ছে, তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। কিন্তু, কটা রোগীর খবর আরোগ্যসেতু দিচ্ছে? কতজন এই অ্যাপ ডাউনলোড করেছে সেই সম্বন্ধে শেষ যা জানা গিয়েছিল তা হচ্ছে, নীতি আয়োগের চেয়ারম্যান জানিয়েছিলেন যে গত ১৩ মে পর্যন্ত ১০ কোটি লোক আরোগ্যসেতু অ্যাপ মোবাইলে ডাউনলোড করেছে। যদি এই দিনটাই উদাহরণ হিসাবে ধরি, ঐদিন পর্যন্ত ৭৮০০৩ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল, আরোগ্যসেতুতে সবাই যদি ঠিকঠাক তথ্য দেয়, তবে লোকসংখ্যা অনুপাতে অ্যাপ ডাউনলোডকারীর মধ্যে ৫৬৫২ জনের করোনা আক্রান্ত থাকার কথা। অল্প কিছু তথ্য নিয়ে গবেষণা করা হয় তখন, যখন সব তথ্য পাওয়া সম্ভব হয় না, বা সব তথ্য জোগাড় করা অসম্ভব কাজ, বা পেলেও তা নিয়ে বিশ্লেষণ করা অসম্ভব। এখানে তা নয়। করোনায় আক্রান্ত ওই ৭৮০০৩ জনের কাছ থেকে তো আরও তথ্য পাওয়া সম্ভব। ৭৮০০৩ জনের যখন আরও বেশি তথ্য আছে, সেখানে মাত্র ৫৬৫২ জনের তথ্য নিয়ে গবেষণা করতে যাব কেন? ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বা ‘হু’ প্রতিটি করোনা রোগী সম্বন্ধে অনেক তথ্য নিতে উপদেশ দিয়েছে, তা হু-র ওয়েবসাইটে আছে। সেই তথ্য আরও নির্ভরযোগ্য ও আরও ব্যাপক, গবেষণা করার ইচ্ছা থাকলে তা গবেষণায় ব্যাপক সাহায্য করতে পারে। বেশি বেশি তথ্য নিয়ে কম্পিউটারের সাহায্যে তা প্রোসেস করার প্রযুক্তি খুব কঠিন কাজ নয়, আমাদের দেশে তা সম্ভব। ডাক্তাররা হয়তো নানা তথ্য নিচ্ছেনও, চাইলে রোগীর কাছ থেকে আরও তথ্য নেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারত। ফলে আরোগ্যসেতুতে মনিটরিং বা গবেষণায় খুব বাড়তি সুবিধা হয়েছে তা বলা যাচ্ছে না।

প্রশ্ন হচ্ছে, ৫৬৫২ জন করোনা রোগীর খবর নিতে গিয়ে কেন বাকি ৯,৯৯,৯৪,৩৪৮ জনের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে খবরাখবর নেওয়া? এখানেই অভিযোগ উঠছে যে, আরোগ্যসেতুর নামে সরকার আসলে নজরদারি চালাচ্ছে। স্মার্ট ফোনওয়ালাদের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত খবরাখবর নিয়ে সরকার কী করবে? সাধারণ মানুষের চিকিৎসার দায়িত্ব তো এদেশে সরকার নেয় না। চিকিৎসা যেদেশে ব্যবসার ক্ষেত্র, সেখানে মানুষের ব্যক্তিগত এই তথ্য পণ্য, তা কেনার লোক আছে। স্মার্টফোনওয়ালাদের একটা বড়ো অংশ তো মধ্যবিত্ত, তাদের প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসার প্রতি ঝোঁক বেশি। আরোগ্যসেতু অ্যাপের তথ্য চুরি বা ফাঁস হয়ে প্রাইভেট হাসপাতালের হাতে পড়লে, সাধারণ মধ্যবিত্ত আরও বেশি করে স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে যেতে পারে। আরোগ্যসেতুর তথ্যের গোপনীয়তা নিয়ে গ্যারান্টি কী? আরোগ্যসেতু নিয়ে কোনো সহায়ক আইন সরকারের নেই।

চীনের ন্যাশনাল সেন্টার ফর এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের ডিরেক্টর ও সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনে এইডসের প্রধান বিশেষজ্ঞ ভাইরোলজিস্ট ডঃ সাও জিমিং (Shao Yiming) বলেছেন, চীনে করোনা আক্রান্ত কোনো রোগীকে জিজ্ঞাসা করা হয় নি। সে কোথায় কোথায় ঘুরেছে, তার মোবাইলের নম্বর থেকে জিপিএস দেখে জেনে নেওয়া হয়েছে সে কোথায় কোথায় ছিল, সেখান থেকে তার কাছাকাছি কাদের মোবাইল ছিল, তার সংস্পর্শে কারা এসেছে তাদের অনুসরণ করা হয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ভালো প্রয়োগ। চীনে কোনো করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের অনুসরণ করতে সময় ধার্য হয়েছিল মাত্র ২৪ ঘণ্টা। সারা দেশে কি হয়েছে জানি না, আমাদের রাজ্যে তো কখনো কখনো করোনা টেস্টিং-এর রিপোর্ট আসতেই কয়েকদিন লেগে গেছে। সাও জিমিং-র বক্তব্যেই জানলাম, চীনে সাধারণ মানুষের মোবাইলে থাকে হেলথ কার্ড, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো করোনা রোগীর সংস্পর্শে এসে থাকে, তবে হেলথ কার্ড আপনা আপনিই সবুজ থেকে লাল বা হলুদ হয়ে যায়। ট্রেনে বা প্লেনে করে কোনো স্টেশন বা এয়ারপোর্টে পৌঁছলে সেখানে দেখাতে হবে কার্ডের রং সবুজ আছে কিনা।

চীনের মতো অতটা না করতে পারলেও, আমরা অন্তত করোনা রোগীর মোবাইল (স্মার্ট মোবাইল হওয়ার দরকার নেই) থেকে সে কোথায় কোথায় গিয়েছিল, সেটুকু সংগ্রহ করার প্রযুক্তি কাজে লাগাতে পারতাম। এইটুকু কাজ করা আমাদের দেশে প্রযুক্তিগত দিক থেকে সম্ভব, সাধারণ মোবাইলের ক্ষেত্রে শুধু টাওয়ার লোকেশন পাওয়া যেত। শুধু করোনা রোগীদের উপর এই নজরদারি স্বাগত। ডিজিটাল প্রযুক্তি অবশ্যই চাই, তবে তা দেশের পরিস্থিতি উপযোগী, চিকিৎসার উন্নতির জন্যও কাজের হতে হবে। আরোগ্যসেতু তার কোনোটাই হতে পারেনি। ফলে নজরদারির অভিযোগ ওঠাটা স্বাভাবিক।