E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৯ মার্চ, ২০২১ / ৫ চৈত্র, ১৪২৭

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এবং বিমা ক্ষেত্রে সর্বাত্মক ধর্মঘট


নিজস্ব প্রতিনিধিঃ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এবং বিমা ক্ষেত্রে সর্বাত্মক ধর্মঘটে দেশজুড়ে স্তব্ধ হলো সমস্ত পরিষেবা। কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাঙ্ক, বিমা বেসরকারিকরণের ঘোষণার বিরুদ্ধে ১৫ ও ১৬ মার্চ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, ১৭ মার্চ জেনারেল ইনসিওরেন্স এবং ১৮ মার্চ জীবন বিমার কর্মী-অফিসাররা ঐক্যবদ্ধভাবে ধর্মঘট ডেকেছিলেন। ব্যাঙ্ক কর্মী ও অফিসারদের ৯টি সংগঠনের মঞ্চ ইউনাইটেড ফোরাম অব ব্যাঙ্ক ইউনিয়নস’র নেতৃত্বে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে দু’দিনের এই ধর্মঘট সংগঠিত হয়। সারাদেশে প্রায় ১৩ লক্ষ ব্যাঙ্ক কর্মী, অফিসার এই ধর্মঘটে অংশ নেন। বিমা ক্ষেত্রে জেনারেল ইনসিওরেন্সে অল ইন্ডিয়া ইনসিওরেন্স এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন এবং জীবন বিমায় এলআইসি এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন এই ধর্মঘটের ডাক দেয়। কর্মী-অফিসারদের সাথে ফিল্ড ওয়ার্কার ও এজেন্টরাও এই ধর্মঘটে অংশ নেন।

দু’দিনের ব্যাঙ্ক ধর্মঘটে সারাদেশে এটিএম সহ সমস্ত লেনদেন ও চেক ক্লিয়ারেন্স বন্ধ ছিল। এই ধর্মঘটে গ্রামীণ, সমবায় ব্যাঙ্ক সহ বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাঙ্কের বহু কর্মচারী শামিল হন। ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার সাধারণ সম্পাদক দেবাশিস বসুচৌধুরি বলেছেন, নয়া-উদারবাদী নীতি চাপিয়ে দেওয়ার এই আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে আগামীদিনে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আমাদের আরও বড়ো সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। সাধারণ মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী কিছু মেনে নেওয়া যাবে না। সুতরাং, আগামীদিনে আরও বড়ো আন্দোলনে নামবেন ব্যাঙ্ককর্মীরা। অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক অফিসার্স কনফেডারেশনের রাজ্য সম্পাদক সঞ্জয় দাস জানিয়েছেন, ন্যাশনাল কনফেডারেশন অব অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন এই ধর্মঘটের প্রতি সম্পূর্ণ সংহতি জানিয়েছে। ১৬ মার্চ কলকাতায় ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার প্রশাসনিক ভবনের সামনে ইউনাইটেড ফোরাম অব ব্যাঙ্ক ইউনিয়নস’র সভা হয়। এই ব্যাঙ্ক ধর্মঘটের ফলে শুধু প্রথম দিনেই প্রায় ২ কোটি চেক ক্লিয়ারেন্স হয়নি, যার অর্থমূল্য প্রায় ১৬,৪০০ কোটি টাকা।

সাধারণ বিমা কর্মচারীরা কলকাতায় সংস্থার কেন্দ্রীয় দপ্তর ও চারটি আঞ্চলিক দপ্তরের সামনে প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন নিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। জীবন বিমা কর্মচারীরাও কলকাতায় বিভিন্ন দপ্তরের সামনে অবস্থান বিক্ষোভ করেন। সাধারণ বিমা কর্মচারী আন্দোলনের নেতা সঞ্জয় ঝা বলেছেন, চারটি সংস্থার কোনো একটিকে বেসরকারি হাতে তুলে দিতে চাইছে কেন্দ্র। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ৪৯ শতাংশ থেকে ৭৪ শতাংশে নিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে গ্রাহকদের স্বার্থ চূড়ান্ত বিঘ্নিত হবে। কর্মীদের কাজের নিরাপত্তা থাকবে না। ১ লক্ষ ৭৭ হাজার কোটি টাকার সম্পদ যেমন নয়ছয় করতে দেওয়া যাবে না, তেমনি ছিনিমিনি খেলা যাবে না সাধারণ বিমা সংস্থার ৫৪ হাজার কর্মীর ভবিষ্যৎ নিয়ে।

ব্যাঙ্ক ও বিমা কর্মচারীদের এই ধর্মঘটকে সমর্থন জানায় সিআইটিইউ, এআইটিইউসি, আইএনটিইউসি সহ সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশনসমূহ।

২০২১ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন আগামী অর্থবর্ষে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা বিলগ্নিকরণের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছেন। এই লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে আইডিবিআই, দু’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, একটি সাধারণ বিমা সংস্থা এবং জীবন বিমা কর্পোরেশনের বেসরকারিকরণ করা হবে। এই পরিকল্পনার কথা বাজেটেই বলা হয়েছে। বিমায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৪ শতাংশ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই বেসরকারিকরণের নীতির বিরুদ্ধেই ব্যাঙ্ক-বিমা কর্মচারী ও বিমা ফিল্ড ওয়ার্কাররা এই ধর্মঘটে শামিল হন। প্রসঙ্গত, সাধারণ বিমা ক্ষেত্রে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা আছে। এগুলি হলো - জেনারেল ইনসিওরেন্স, নিউ ইন্ডিয়া, ওরিয়েন্টাল এবং ইউনাইটেড ইনসিওরেন্স।

২০২০ সালের ২০ নভেম্বর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ইন্টারন্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ সুপারিশ করে, কর্পোরেট ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাউসগুলিকে ব্যাঙ্ক খুলতে অনুমতি দেওয়া হোক। পাঁচ সদস্যের এই কমিটি দশ জন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে এই সুপারিশ করে। এই দশ জনের মধ্যে চারজন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রক্তন ডেপুটি গর্ভনর এবং বাকি ছয়জন বেসরকারি ব্যাঙ্ক ও সংস্থার প্রধান। এদের মধ্যে নয়জনই এই অবস্থানের পক্ষে ছিলেন।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গর্ভনর রঘুরাম রাজনও ধর্মঘটী ইউনিয়নগুলির মতোই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির বেসরকারিকরণের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে যদি সত্যিই কর্পোরেট সংস্থার কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়, তা হলে সেটা হবে বিরাট একটা ভুল। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও ব্যাঙ্ক ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ব্যাঙ্ক কর্মীরা আজ ধান্দার কর্পোরেটদের হাতে দেশের সম্পদ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক তুলে দেওয়ার প্রতিবাদে ধর্মঘটে নেমেছেন। মোদী সরকার আসলে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মুনাফার বেসরকারিকরণ করছে। আর বেসরকারি সংস্থার লোকসানের রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করছে। এটাই তাদের নীতি। ধান্দার কর্পোরেট স্বার্থে মোদী সরকার চলছে।

১৯৬৯ সালের ১৯ জুলাই ১৪টি এবং ১৯৮০ সালের ১৫ মার্চ ৬ টি বৃহৎ বেসরকারি ব্যাঙ্ককে জাতীয়করণ করা হয়। এর আগে স্বাধীনতার পরপরই ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং ১৯৫৫ সালের ১ জুলাই ইম্পেরিয়াল ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়াকে জাতীয়করণ করে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ায় পরিণত করা হয়। এসবিআই (সাবসিডিয়ারি ব্যাঙ্ক) অ্যাক্ট ১৯৫৯ মধ্য দিয়ে পূর্বতন করদ রাজ্যগুলির ৮টি ব্যাঙ্ককে জাতীয়করণ করা হয়। সংযুক্তিকরণ ও অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে ২৭টি রাষ্টায়ত্ত ব্যাঙ্ক কমে হয় ১২। আবার বিজেপি সরকারের ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের মধ্য দিয়ে বর্তমানে রাষ্টায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংখ্যা কমে হয়েছে ৫। স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার সাথে সহযোগী ৮টি ব্যাঙ্ককে সংযুক্ত করা হয়েছিল। পরে সংযুক্তি ঘটানো হয়েছে ১০টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সাথে ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্ক অব কর্মাস ও ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার সংযুক্তি ঘটানো হয়েছে। কানাডা ব্যাঙ্কের সঙ্গে সংযুক্তি ঘটেছে সিন্ডিকেট ব্যাঙ্কের। ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্ধ্র ব্যাঙ্ক ও কর্পোরেশন ব্যাঙ্ককে। ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক। অন্যদিকে ১৯৫৬ সালে লাইফ ইনসিওরেন্স কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠা হয়। সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলি জাতীয়করণ হয় ১৯৭৩ সালে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে মোট আমানতের পরিমাণ ১৪৬ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। আর জীবন বিমা কর্পোরেশনে আমানতের পরিমাণ প্রায় ৩২ লক্ষ কোটি টাকা। তহবিলের পরিমাণ ১ লক্ষ ৭৭ হাজার কোটি টাকা। ৪০ কোটি গ্রাহক এই আমানত ও তহবিল গড়ে তুলেছে। ২০২০ সালে রাষ্টায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি মুনাফা করেছে ১ লক্ষ ৭৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা ‘মন্দঋণ’ থাকায় ২৬ হাজার কোটি টাকার মতো ক্ষতির মুখে পড়েছে ব্যাঙ্কগুলি। এই ঋণ আম্বানি-আদানিদের মতো শিল্পপতিরা নিয়েছেন। এখন তাদের হাতেই ব্যাঙ্ক তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে কেন্দ্র।

জাতীয়করণের আগে ব্যাঙ্কের শাখা সংখ্যা ছিল ৮,২৬১। সেটাই বর্তমানে বেড়ে প্রায় ১ লক্ষ হয়েছে। গ্রামেও ব্যাঙ্ক পরিষেবা সম্প্রসারিত হয়েছে। ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ হলে ব্যাঙ্কের শাখা সংখ্যা কমবে, কোপ পড়বে গ্রামীণ পরিষেবায়। প্রসঙ্গত, জাতীয়করণের পরবর্তী ৫১ বছরে ৩৮টি বেসরকারি ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়েছে। কিন্তু একটাও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়নি। ২০০৮ সালে বিশ্বজুড়ে যে আর্থিক মন্দা দেখা দিয়েছিল আমাদের দেশ তা থেকে অনেকটা মুক্ত থাকতে পেরেছিল শুধুমাত্র ব্যাঙ্ক ও বিমা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল বলেই।