৫৮ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৯ মার্চ, ২০২১ / ৫ চৈত্র, ১৪২৭
বাঁকুড়া জেলার মানুষ অপমান ও বঞ্চনার জবাব দিতেই জড়ো হচ্ছেন সংযুক্ত মোর্চার পাশে
মধুসূদন চ্যাটার্জি
রানীবাঁধ কেন্দ্রে প্রচারে সিপিআই(এম) প্রার্থী দেবলীনা হেমব্রম।
তখন সবে সকালের বাজার শুরু হচ্ছে। এরই মাঝে বাঁকুড়া শহরের লালবাজারের একটি ডেকোরেটারের দোকানের সামনে একটি মারুতি ভ্যান এসে দাঁড়াল। মাথার চারধারে খুর দিয়ে চাঁছা কানে দুল পরা এক যুবক গাড়ি থেকে নেমে ডেকোরেটারের দোকানে ঢুকে গেল। সামনেই মুড়ির বস্তা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এক মাঝ বয়সি ব্যক্তি। এলাকার মানুষজনের কাছে শ্যামদা হিসাবে তিনি পরিচিত। ওই গাড়িটিকে দেখেই শ্যামদার চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি বেরিয়ে এলো। জানান, এই এবার শুরু হবে। কী হবে? পাঁচ মিনিট দাঁড়ান দেখতে পাবেন। দেখা গেল ওই মারুতি ভ্যানের মাথার উপর চারধারে চারটি বড়ো আকারের বক্স ও মাঝের জায়গাগুলো লম্বা চোঙা বেঁধে দেওয়া হলো। মাথা কামানো কানে দুলপরা যুবকটি গাড়ির ভেতরে ঢুকেই চালিয়ে দিল চিপ। ভয়ঙ্কর শব্দে ছড়িয়ে পড়ল ‘‘খেলা হবে, খেলা হবে’’। রাস্তার কোনো কথা শোনা যাচ্ছেনা। শ্যামদা আর থাকতে না পেরে গাড়ির সামনে গিয়ে ছেলেটিকে একপ্রকার টেনে এনেই জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের এই খেলা হবে, খেলা হবে ছাড়া আর কিছু নেই? মুখের ভেতরে ঢোকানো তেরঙ্গার পিক রাস্তায় ফেলে ছেলেটি জানায়, এটাই আমাদের দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে দুপুর পর্যন্ত বাঁকুড়া শহর ও লাগোয়া গ্রামগুলোরে প্রচার করতে। এর জন্য দিনের শেষে মজুরি মিলবে ২০০টাকা। স্নাতক যুবকটিকে শ্যামদা বললেন, তুমি তো এই পাড়ারই ছেলে। তোমার কাজ নেই। নেতাদের বলতে পারছোনা, কাজ, কাজ হবে এরকম গানের চিপ ঢোকাতে। থমকে গেল যুবকটি। বলল কাজ কোথায় বলুন। বাবা ইস্ত্রি করে সংসার চালায়। মা পুকুরে লোকের কাপড় কাচে। সবই বুঝি কাকু, কী করব? কাজ নেই। তাই এই খেলা হবে, খেলা হবে প্রচার করে দুশো টাকা পাই। ভোটের পর তো সেটাও আর পাবনা। কোন্ অবস্থায় যুব সমাজ ধুঁকতে ধুঁকতে তাদের অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রেখে চলেছে এবারের নির্বাচন তার সাক্ষী। রাজ্যের শাসকদলের এখন একটাই প্রচার ‘‘খেলা হবে’’। কি খেলা হবে তা জানানোর সাহস নেই। নির্বাচন ঘোষণার আগেই এই কথা প্রচার করা হয়েছিল। এখন তৃণমূল কংগ্রেসের বাঁকুড়া জেলায় একটাই প্রচার খেলা হবে। এর বাইরে কিছু নেই। দেওয়ালেও প্রার্থীর নাম লেখার উপরে তারা দশবছরে কি করল তার কোনো তথ্য নেই। সকাল থেকে গাড়ির মাথায় ৮-১০টা বক্স মাইক চাপিয়ে জেলাজুড়ে এই খেলা হবের চিৎকার শুনিয়ে যাচ্ছে। তবে ঘটনা হলো আগে মানুষ সাহস করে তৃণমূলের লোকজনের কাছে এসব কথা জানতে চাইতনা, এখন চাইছে। সরাসরি বলছে এসব শব্দ যন্ত্রণার খেলা বন্ধ করো। রবিবার বেলিয়াতোড় এলাকায় সকালে এরকম যন্ত্রণাকর মাইক প্রচার এলাকার মানুষ সহ্য করতে না পেরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন। তৃণমূলের বাহিনী কোনো টুঁশব্দটি করতে সাহস পায়নি। এবারের নির্বাচনে বাঁকুড়া জেলার মানুষের কাছে সব চেয়ে বড়ো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে অপমানের সঠিক জবাব দেওয়া। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমা এলাকায় কোনো ভোট হতে দেয়নি তৃণমূলবাহিনী। বাঁকুড়া মহকুমা ও খাতড়ায় আংশিক ভোট হয়েছে। তাও ভোটের দিনে মানুষ ভোট দিতে পারেননি। লাঠি, বোমা হাতে মাথায় ঘাসফুলের ফেট্টিবেঁধে রাস্তায় উন্নয়ন (!) দাঁড়িয়েছিল। মানুষ এর জবাব চাইছেন। সরাসরি তৃণমূলবাহিনীর চোখে চোখ রেখে বাঁকুড়া জেলার মানুষ বলছেন, যা কীর্তি করেছ তার জবাব দাও। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরই জেলার একাধিক জায়গায় রক্তের স্রোত বইয়ে দেওয়ার পাশাপাশি পাইকারি হারে জরিমানা আদায় করেছিল কয়েক কোটি টাকা। মানুষ সেটা ভোলেননি। রাস্তায় তৃণমূলীদের কলার ধরে সেই টাকা আদায় করছে। সমবায়গুলিতে যে দুর্নীতি করে রেখেছে সেখানে গিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন মানুষ। আওয়াজ একটাই কাটমানির টাকা ফেরত দাও। তাই গ্রামে গ্রামে তৃণমূল খালি ওই মাইক প্রচারই চালাচ্ছে। দল বেঁধে মানুষকে নিয়ে গ্রাম, শহরের পাড়ায় সভা করার সাহস দেখাচ্ছে না। বাঁকুড়া কেন্দ্রে চলচ্চিত্র জগতের এক অভিনেত্রীকে প্রার্থী করে চেষ্টা করছে মানুষের মন ঘোরানোর। পারছে না। কারণ, মানুষ একবার সাংসদ হিসাবে মুনমুন সেনকে জিতিয়েছিলেন। সেটা কতবড়ো যে ভুল হয়েছিল তা বাঁকুড়ার মানুষ এখন সকাল সন্ধ্যা বলে চলেছেন। মানুষের এই উপলব্ধি থেকেই এবারের প্রার্থী মানুষের কাছ থেকে কী রকম সাড়া পাচ্ছেন তা সহজেই অনুমান করা যায়।
প্রচারে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীরা।
এবারের নির্বাচনে জেলার মানুষের কাছে অন্যতম প্রধান ইস্যুই হলো কাজ। কাজ নেই জেলায়। সরকারি হিসাবে জেলা থেকে বাইরে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে গেছেন ২৪হাজার মানুষ। আসলে এই সংখ্যাটা ৫০হাজারের বেশি। আমাদের ছেলেরা এই জন্মভূমিতে কাজ পেলে কী বাইরে কাজ করতে যেত? রাতে ঘুম আসেনা। ঘুম ভেঙে দেখি পাশে শুয়ে থাকা আমার অন্তঃসত্ত্বা বৌমা কাঁদছে। ছেলেটা গোয়ায় চলে গেছে কাজ করতে। যন্ত্রণাকাতর মুখ নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাগুলো শোনালেন ইন্দপুর থানার ভেদুয়াশোল গ্রামের পরিযায়ী শ্রমিক সুশান্ত বাউরির মা বৃদ্ধা আশালতা বাউরি। তিনি জানান, লকডাউনের সময় হাজার মাইল হেঁটে ঘরে ফিরেছিল। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন পরিযায়ী শ্রমিকদের একলাখ করে টাকা দেওয়া হয়েছে। মিথ্যা কথা। কেন আমাদের নিয়ে এরকম ঠাট্টা, তামাশা করা হয়? এখানে কাজ খুঁজেছিল, পায়নি। ফের তাকে চলে যেতে হয়েছে। আমাদের পেটের ভাতের জন্য ছেলেটাকে বাইরে জীবনকে বাজি রেখে গতর পিষতে হচ্ছে। কোন্ মুখে তৃণমূল আমাদের কাছে ভোট চাইতে আসবে? জেলাজুড়ে পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের মানুষজন আজ সোচ্চারে এই আওয়াজ তুলছেন।
বাঁকুড়া জেলার জঙ্গলমহলের মানুষের জীবিকার অন্যতম প্রধান উৎসই হলো কেন্দুপাতা সংগ্রহ, তার বিক্রি। এর এসবটাই করত সরকারি আদিবাসী সমবায় সমিতি ল্যামপস। বামফ্রন্টের আমলে এগুলি জঙ্গল এলাকায় সচল ছিল। এই কেন্দুপাতার কাজের সঙ্গে বাঁকুড়া জেলার ৫০হাজার মানুষ যুক্ত। এখন ল্যামপসগুলিতে তালা ঝুলছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জঙ্গলে এসে পাতা সংগ্রহ করে। তাদের ইচ্ছামতো কাজ করতে হয় শ্রমিকদের। কমে গেছে তাঁদের কাজ। জঙ্গলমহলের বেশিরভাগ স্কুল হোস্টেল বন্ধ। মাঝপথে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়েছে বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীকে। পরিণতিতে তাদের হাতে আজ উঠে এসেছে গোরু চরানোর লাঠি, বা পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে বাইরে চলে যাওয়া। আদিবাসী শিল্পীদের নানা ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে তাঁদের শিল্পসত্তাকে গ্রাস করা হচ্ছে। যে কোনো অনুষ্ঠানে একপ্রকার জোর করে তাদের নিয়ে গিয়ে নাচানো, গাওয়ানো হয়। অপমানিত বোধ করছেন তাঁরা। আদিবাসী মানুষজন এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন আজ। জঙ্গলমহল এলাকার মানুষের বক্তব্য কী পেলাম আমরা? নতুন কিছু চাইনি, যা ছিল তাও কেড়ে নিল এই সরকার। তৃণমূলের উপর মানুষের এই ক্ষোভকে সামাল দিতে ঝান্ডা বদলে পদ্মফুলের ঝান্ডা হাতে তুলে নিয়েছে কিছু মানুষ। বিজেপি’রও কোনো প্রচার সেই অর্থে নেই। বাঁকুড়া জেলার পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের মানুষজন জানেন বিজেপি সরকার তাঁদের ছেলেদের উপর কী অন্যায়, অবিচার করেছে। শালতোড়ার সালমা এলাকায় বিজেপি প্রচারে যাওয়ার সময় তাদের নেতাদের ঘিরে ধরে মানুষ জানতে চান পনেরদিন আগেও তো তোমরা ঘাসফুলের ঝান্ডা হাতে নিয়ে কাটমানি খেয়েছ। একটা বাড়ির জন্য আধারকার্ড, পাসপোর্ট ছবির সঙ্গে কারুর কাছে ২০, আবার কারুর কাছে ২৫হাজার টাকাও নিয়েছ। এখন তোমরা পদ্মফুলের ঝান্ডা ধরে সাধু হয়ে গেলে। কেন পঞ্চায়েত ভোট করতে দাওনি - এসব আগে জানাও তারপর এবারের ভোটের কথা বলবে। কোনো উত্তর দিতে না পেরে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে বিজেপি’র দল।
সংযুক্ত মোর্চাকে নতুন করে কিছু করতে হচ্ছেনা। সারাবছরই বাঁকুড়া জেলার কৃষকদের পাশে থেকেছে লালঝান্ডা। কৃষকের ধানের দাম, সরকারি মান্ডিতে তা নেওয়া, খেতমজুরের কাজ এই সব কিছু নিয়ে লালঝান্ডার সরব উপস্থিতি মানুষ দেখেছেন। এই লড়াই করার সময় একদিকে তৃণমূলবাহিনী ও অন্যদিকে পুলিশের হাতে আক্রান্ত হতে হয়েছে লালঝান্ডার কর্মীদের। শতাধিক মিথ্যা মামলা চলছে লালঝান্ডার কর্মী, নেতাদের নামে। এই অত্যাচার সত্ত্বেও মাথানত করেননি তাঁরা। পরিযায়ী শ্রমিকদের এলাকায় রাখা, তাঁদের আস্তানায় এই লালঝান্ডার কর্মীরাই প্রশাসনের সঙ্গে লড়াই করে খাবার পৌঁছে দিয়েছে। তাঁদের কাজের জন্য প্রতিটি ব্লকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে। জঙ্গলমহলে কেন্দুপাতায় ল্যামপসের কাজ খোলা, বন্ধ থাকা হোস্টেল খোলা - এসব নিয়ে লালঝান্ডাই ধারাবাহিক আন্দোলন সংগঠিত করেছে। মানুষ তা দেখেছেন। জড়তা কাটিয়ে সঙ্গে এসেছেন। নির্বাচনী প্রচারেও মানুষ সেই কথা স্মরণ করে এগিয়ে আসছেন। সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী-কর্মীরা এই মুহূর্তে জেলার এমন কোনো পাড়া, এলাকা নেই যেখানে প্রচারে যাননি। চলছে ছোটো, ছোটো বৈঠক, পথসভা। বক্তব্য একটাই - লাখ লাখ মানুষ বেকার। এক একটা প্রজন্মের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে। কারখানা নতুন করে হচ্ছেনা, যা ছিল তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানুষগুলো বাঁচবে কী হাততালি দিয়ে? তাই কাজ চাই। আর এই কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে সংযুক্ত মোর্চাই। মানুষ আজ থেকে দশ বছর আগেও এলাকায় এসএসসি, প্রাথমিক, সরকারি দপ্তরে যুবক যুবতীর প্রতিবছর চাকরি পাওয়া দৃশ্য স্মরণ এবং বর্তমান সময়ে চাকরি প্রার্থীযোগ্য যুবক-যুবতীদের বঞ্চনা ও প্রতিবাদ স্মরণ করে এগিয়ে আসছেন সংযুক্ত মোর্চার সঙ্গেই।