৫৮ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৯ মার্চ, ২০২১ / ৫ চৈত্র, ১৪২৭
খেজুরি কেন্দ্রে লাল পতাকার সমারোহ নতুন সৃষ্টির ইঙ্গিত দিচ্ছে
সন্দীপ দে
খেজুরি কেন্দ্রে প্রচারে সংযুক্ত মোর্চার সিপিআই(এম) প্রার্থী হিমাংশু দাস।
দীর্ঘ সন্ত্রাস-অত্যাচারের নিদারুণ অভিজ্ঞতা-যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ক্রমশ জেগে উঠছে খেজুরি। এই কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চা মনোনীত সিপিআই(এম) প্রার্থী হিমাংশু দাসের প্রচারে সেই জেগে ওঠার লক্ষণ ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে। তৃণমূল-বিজেপি দু’দলেরই বিপুল অর্থের বৈভবের বিপরীতে চারপাশে লাল পতাকার সমারোহ জানান দিচ্ছে - এক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে। ২০০৯ সালে তৃণমূল কংগ্রেস হিংসাশ্রয়ী কার্যকলাপের মধ্যদিয়ে খেজুরির বুকে অন্ধকারের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারপর থেকে ক্রমাগত চলেছে ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুঠতরাজ, যথেচ্ছ জরিমানা আদায়ের মতো জঘন্য সব ঘটনা। এরপর ওরা পঞ্চায়েতের টাকা লুট করতে মেতে ওঠে। গরিব মানুষের ইন্দিরা আবাসের টাকা, বার্ধক্যভাতা, বিধবা ভাতার টাকা, মিড ডে মিল এবং আইসিডিএস প্রকল্পের টাকা কিছুই বাদ যায়নি।
শাসকদলের অমানবিকতার কুৎসিত নজির দেখা গেছে আমফান ঝড়ে বিপন্ন মানুষদের ত্রাণের টাকা লুটের ঘটনায়। সেই টাকা আত্মসাৎ করার ঘটনা চলে আসে প্রকাশ্যে। তা নিয়ে বিস্তর ক্ষোভ জমা হয় গরিব মানুষদের মধ্যে। তখন সিপিআই(এম)’র উদ্যোগে শুরু হয় বিক্ষোভ মিছিল, প্রশাসনের কাছে উপযুক্ত বিচারের দাবিতে ডেপুটেশন। পার্টির এই বিক্ষোভ-আন্দোলনের চাপে জেলাশাসক ত্রাণের টাকা প্রাপকদের তালিকা প্রকাশের নির্দেশ দেন। দেখা যায় অর্থ বণ্টনে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। শাসকদলের স্থানীয় নেতা-মাতব্বরদের ইচ্ছানুযায়ী তাদের আত্মীয় পরিজন, কাছের মানুষকে ঝড়ে বিধ্বস্ত ঘর মেরামতির জন্য ২০ হাজার টাকা, অল্প ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বরাদ্দ ১০ হাজার টাকা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ লক্ষ করা গেছে, পাকা বাড়ির মালিকও এই ত্রাণের টাকা জুটিয়ে নিয়েছে। এই চূড়ান্ত বেনিয়মের বিরুদ্ধে জেলাশাসক কড়া পদক্ষেপ নেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত নন এমন মানুষ যারা টাকা নিয়েছেন, তাদের টাকা ফেরতের নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে শাস্তির ভয়ে দলে দলে তৃণমূলীরা টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হন। জেলার মানুষ প্রত্যক্ষ করেন নির্লজ্জ শাসকদল কীভাবে গরিব অসহায় মানুষদের টাকা আত্মসাৎ করে নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত চরম বিপাকে পড়ে শাসকদল জেলাশাসককে অন্যত্র বদলি করে নিজেদের পেটোয়া লোককে এনে বসায়। ফলে গরিব মানুষের যেটুকু সুরাহা পাবার সম্ভাবনা ছিল তা বন্ধ হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে বিধ্বস্ত ঘরের ছবি, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা ইত্যাদি দিয়ে মামলা করা হয় হাইকোর্টে। এই মামলায় রায় হয় গরিব মানুষদের পক্ষেই।
আরও আশ্চর্যের বিষয়, আমফান ঝড়ে বিধ্বস্ত মানুষদের ত্রাণের টাকা সুযোগমতো লুট করেছে বিজেপি-ও। যেখানে যেখানে ওদের সুযোগ মিলেছে এই টাকা যথেচ্ছভাবে আত্মসাৎ করেছে। আবার অনেক পঞ্চায়েতে তৃণমূল-বিজেপি নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করেই এই লুটের কারবার চালিয়েছে। তৃণমূল-বিজেপি’র এই অপকীর্তির বিরুদ্ধে সর্বত্র প্রতিবাদে মানুষ পথে নেমেছেন। করোনা বিপর্যয় ও আমফান ঝড়ের তাণ্ডবে বিপর্যস্ত মানুষের চরম অসহায়ত্বের মুহূর্তে তৃণমূল-বিজেপি দু’দলই হয় হাত গুটিয়ে বসে থেকেছে, না হয় ত্রাণসামগ্রী ও সাহায্যের টাকা লুট করেছে। মানুষ দেখেছেন এই সময়ে পাশে ছিলেন একমাত্র বামপন্থীরাই। করোনা মহামারীর ভয়াবহ প্রকোপকে যথাসাধ্য মোকাবিলা করা, অসহায় মানুষদের খাবারের ব্যবস্থা করা, আমফান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করা ইত্যাদি নানা উদ্যোগে সামনের সারিতে ছিলেন সিপিআই(এম) নেতা হিমাংশু দাস। তখন কোনো সরকারি সাহায্য ছিল না। কোনো দিক থেকেই আসেনি কোনো ত্রাণ সাহায্য। এমনই এক বিপন্ন মুহূর্তে পার্টি কর্মীরা দুর্গত মানুষদের সাহায্যে পথে নেমেছিলেন। অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এই অসামান্য উদ্যোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন হিমাংশু দাস। করোনা মহামারী পর্বে লকডাউনের ফলে কাজ হারানো এবং উপার্জনহীন মানুষদের খাবারের সংস্থান সহ নানা সাহায্য করা এবং আমফানের প্রকোপে ক্ষতিগ্রস্ত-বিপন্ন মানুষদের সাহায্যে পার্টির উদ্যোগে ধারাবাহিকভাবে সাহায্য করা, ত্রাণসামগ্রী প্রদান ইত্যাদি কর্মকাণ্ড চলেছে। এই সময়ে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ লক্ষ টাকার ত্রাণ সাহায্য নিয়ে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছে পার্টি। এই অভিযানে অন্যতম নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন হিমাংশু দাস। এই দু’টি বড়ো বিপর্যয়ের সময়ে এই অঞ্চল, সামগ্রিকভাবে জেলার মানুষ অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন প্রকৃত বন্ধু কারা। পাশাপাশি মানুষের চরম বিপন্নতার সময়ে শাসকদল কীভাবে মানুষের ক্ষতি করতে পারে, গরিব মানুষের টাকা ও ত্রাণসামগ্রী লুট করতে পারে সেটাও দেখেছেন মানুষ। তাই বামপন্থীদের প্রতি মানুষের ভরসা-আস্থা বেড়েছে। তারই অনুষঙ্গে হিমাংশু দাসকেও কাছের মানুষ, উপকারী বন্ধু হিসাবে চিনেছেন।
পঞ্চায়েতের বিভিন্ন স্তরে নানা উন্নয়নের কাজেও দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে হিমাংশু দাসের। প্রথমে গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য, তারপর ভূমি কর্মাধ্যক্ষ ও পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি, পরবর্তীতে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি এবং জেলা পরিষদের সদস্য হিসেবে তাঁর নানা উন্নয়নের কাজে ভূমিকা কেবল খেজুরি অঞ্চলেই নয়, গোটা পূর্ব মেদিনীপুর জেলাজুড়েই সুবিদিত। তাঁর নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বিভিন্ন স্তরে প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষ করে খেজুরি ১নং ব্লককে নির্মল ব্লক হিসাবে রূপদানের জন্য রাষ্ট্রপতির পুরস্কারও অর্জন করেছেন তিনি। তাঁর সময়েই খেজুরি ব্লকের গ্রাম-গঞ্জে উন্নয়নের কাজ পর্যবেক্ষণ করতে এসেছিলেন পৃথিবীর ৩৬টি দেশের প্রতিনিধিরা। এর মধ্য দিয়ে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতাও সম্যকভাবেই প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৭ সালের শুরু থেকে নন্দীগ্রামে তৃণমূলের ধারাবাহিক অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস, হত্যা ইত্যাদির আঁচ এসে পড়েছে খেজুরিতেও। তারপর ২০০৯ সাল থেকে তৃণমূলের হিংস্র সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত হয় খেজুরিসহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চল। অন্যান্য পার্টি নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি হিমাংশু দাসকেও ২৫টির বেশি মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়। ২০১১ সালে তৃণমূল সরকার আসার পর পাঁচ বছরেরও বেশি সময় রাজ্য ছেড়ে তাঁকে ভিন্ রাজ্যে আত্মগোপনে যেতে হয়। পরবর্তীকালে প্রায় তিন মাস জেলজীবন কাটাতে হয়েছে তাঁকে। তারপর জামিন হলেও প্রায় ১ বছর তিনি আদালতের নির্দেশে জেলায় যেতে পারেন নি। অবশেষে আদালতের অনুমতি নিয়েই জেলায় প্রবেশ করে গণআন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তিনি পার্টির অন্যতম নেতা এবং খেতমজুর ইউনিয়নেরও শীর্ষ নেতৃত্বের ভূমিকায় ধারাবাহিকভাবে আন্দোলনের প্রবাহে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। এই লড়াই-আন্দোলনের প্রবহমানতাই তাঁকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক পরিচিতিও এনে দিয়েছে। খেতমজুরদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি, কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম, বেকারদের কাজের দাবিসহ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী-গণতন্ত্রবিরোধী নীতি এবং বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে জেলায় আন্দোলনকে সংহত রূপ দিতে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি তিনিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে খেজুরি, হেড়িয়া, কলাগেছিয়া, কুঞ্জপুর, জনকা, হলুদবাড়ি প্রভৃতি বিভিন্ন জায়গায় শাসকদলের দুর্বৃত্তদের দ্বারা দখল হওয়া পার্টি দপ্তরগুলি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। সেই দপ্তরগুলিকে কেন্দ্র করে এখন পার্টির নির্বাচনী সংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে।
বর্তমানে বিজেপি’র আশ্রয়ে গিয়ে নিজের পাহাড় প্রমাণ অপরাধ থেকে মুক্ত হতে চাওয়া একদা তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারী এই অঞ্চলে এসে হুঙ্কার ছেড়েছিলেন, একটাও লাল পতাকা উড়তে দেওয়া যাবেনা। আজ সেখানে সর্বত্র চোখে পড়ছে লাল পতাকার দীপ্ত আভা। খেজুরির প্রতিটি প্রান্তে প্রার্থী হিসেবে হিমাংশু দাসের উপস্থিতিতে বিভিন্ন কর্মসূচিতে এলাকার মানুষ বিশেষকরে যুবকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এক নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত বয়ে আনছে। সেই সঙ্গে মানুষের নানা সমস্যায় বিপদের মুহূর্তে পাশে থাকা এবং মানুষের স্বার্থে প্রতিটি লড়াই-আন্দোলনের বাঁক-মোড়ে নেতৃত্বের ভূমিকায় হিমাংশু দাসের উপস্থিতি তাঁকে যে বিশেষ পরিচিতি দিয়েছে, তা ভোটের প্রচারে বিশেষ মাত্রা এনে দিচ্ছে। এলাকার শান্তি-সুস্থিতি ও নিরাপত্তার জন্য, রুটি-রুজির সংস্থানের জন্য লালঝান্ডার দলের উপরই যে ভরসা করা যায় এবং দলের অন্যতম নেতা ও এই কেন্দ্রের প্রার্থী হিমাংশু দাস যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য - তা যেন প্রতি মুহূর্তে প্রতিভাত হচ্ছে প্রচার কর্মসূচিগুলিতে। খেজুরির উন্নয়নে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান এবং মানুষের স্বার্থে ধারাবাহিকভাবে গণআন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালনের স্বীকৃতি স্বরূপ এই কেন্দ্রের বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী, অধ্যাপক, কবি, শিল্পী, সহিত্যিক, সমাজকর্মীরাও হিমাংশু দাসকে সমর্থন জানানোর আবেদন জানিয়েছেন।
২০০৭ সালের পর থেকে নন্দীগ্রামের পাশাপাশি খেজুরি অঞ্চলও বারে বারে তৃণমূলের দুর্বৃত্তদের হিংস্র আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়েছে। সিপিআই(এম)’র নেতা-কর্মীদের রক্তে ভিজেছে এই অঞ্চলের মাটি। ২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূলের ক্ষমতা দখলের পর ৮ জন পার্টি নেতা-কর্মীকে খুন হতে হয়েছে। ২০০৬ সালের পর থেকে শহিদ হয়েছেন ১৭ জন। অগণিত কর্মী-সমর্থকের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। শুধুমাত্র সিপিআই(এম) করার ‘অপরাধে’ অনেক নিরীহ মানুষকে নিঃস্ব-রিক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এই রিক্ত, বঞ্চিত মানুষেরা আজ দীর্ঘ দুঃশাসনের অন্ধকার কাটিয়ে স্বস্তির আলো জ্বালার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রার্থী হিমাংশু দাসের কথায় ‘নন্দীগ্রাম-খেজুরির মানুষের বুকের ভাঙা পাঁজর জোড়া দিয়ে নতুন করে গড়ার অভিযান’ শুরু হয়েছে। অতীতের যন্ত্রণাদগ্ধ অভিজ্ঞতাকে সঙ্গে নিয়েই এই দুর্বার অভিযানে শামিল হয়েছেন খেজুরির বিভিন্ন অংশের অগণিত মানুষ। তাই এই কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চার প্রচারে লাল পতাকার দৃপ্ত সমারোহে নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা আশা জাগাচ্ছে।