৫৮ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৯ মার্চ, ২০২১ / ৫ চৈত্র, ১৪২৭
সন্ত্রাসকে পর্যুদস্ত করে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই কেশপুরে
কেশপুর কেন্দ্রে সরিষাখোলায় সিপিআই(এম) প্রার্থী রামেশ্বর দোলইকে নিয়ে মিছিল।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সন্ত্রাসের কলঙ্ক মুছে ফেলে নতুন করে জেগে উঠছে কেশপুর। বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংযুক্ত মোর্চার প্রচার সাড়া ফেলছে মানুষের মনে। এই কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সিপিআই(এম)-র রামেশ্বর দোলই। তিনি ২০০৬ সাল থেকে ২০১৬ টানা দশ বছর বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তৃণমূলের ক্ষমতা দখলের পর শাসকদলের বেপরোয়া সন্ত্রাস, দৌরাত্ম্য, লাগামহীন ভোট লুট ইত্যাদির জেরে ২০১৬-র নির্বাচনের ফলাফল শাসকদলের অনুকূলে যায়। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের সময়ে প্রকৃতপক্ষে এখানে একতরফা ভোট করানো হয়েছে। তারপর সন্ত্রাসের মাত্রা বৃদ্ধি পায় ব্যাপক হারে। তবুও লালঝান্ডার অগ্রগতিকে স্তব্ধ করা যায়নি। সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীরা নানা দুর্বিপাকে, মানুষের ন্যায্য দাবিতে সাধ্যমতো গরিব শ্রমজীবী মানুষের পাশে থেকেছেন। তাদেরকে নিয়ে লড়াই সংগঠিত করেছেন। মানুষের স্বার্থে লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। জনজীবনের গুরুত্বপূর্ণ দাবিতে নির্বাচনের দিন ঘোষণার আগে কেশপুর থেকে আনন্দপুর দীর্ঘ ৭ কিলোমিটার পদযাত্রায় কয়েক হাজার মানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এই পরিবর্তনের আভাস স্পষ্ট হয়েছে।
এই কেন্দ্রে ২ লক্ষ ৬১ হাজার ভোটারের মধ্যে সংখ্যালঘু, তফশিলি, আদিবাসী এবং দলিত অংশের মানুষের হার প্রায় ৬০ থেকে ৬৫শতাংশ। একটা পর্যায়ে এই অংশের মানুষের মধ্যে বামপন্থীদের ভিত্তি সুদৃঢ় ছিল। পরে নানা কারণে এই ভিত্তি কিছুটা দুর্বল হয়। তৃণমূল কংগ্রেস লাগামহীন হিংসা-সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। বর্তমানে এই অবস্থার বদল ঘটছে। বিশেষ করে আদিবাসী সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী ভারত জাকাত মাঝি পরগনা আদিবাসীদের নানাভাবে বিভ্রান্ত করেছে। অপরদিকে তৃণমূলের জমানায় ওদের ওপর অনেক অত্যাচারও হয়েছে। তাদের গোরু, ছাগল, সহায় সম্বল লুট হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে ওদের সমর্থন ছিল তৃণমূল এবং বিজেপি’র দিকে। সম্প্রতি এই সংগঠনের পক্ষ থেকে এক ভিডিয়ো বার্তায় ওরা অবস্থানের পরিবর্তনের কথা জানিয়েছে। তারা আইএসএফ-র প্রতি তাদের সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছে।
আগে এখানে বিজেপি’র পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল, তাদেরকে সমর্থন না করলেও মানুষ সমর্থন করুক তৃণমূলকে। এভাবে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল সাধারণ মানুষকে। এখন মানুষের ভুল ভাঙছে। বিভ্রান্তি কাটিয়ে তৃণমূল-বিজেপি’র দিকে যাওয়া মানুষ আবার ফিরে আসছেন বামপন্থীদের দিকে। করোনা পরিস্থিতি, লকডাউন, আমফান ঝড়ের প্রকোপ থেকে ফসলের দাম, একশো দিনের কাজ ও মজুরি বৃদ্ধি, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, বেকারদের কাজের দাবি ইত্যাদি নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লাল ঝান্ডার কর্মীদের পথে নামা, মানুষের পাশে থেকে লড়াই আন্দোলন পরিচালনা করা সবই প্রত্যক্ষ করেছেন এখানকার সাধারণ মানুষ। তারই প্রভাব পড়ছে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী রামেশ্বর দোলইয়ের প্রচারে। প্রার্থীর এলাকা পরিক্রমায়, বৈঠকসভা-পথসভায়, মিছিল ইত্যাদিতে বিভিন্ন অংশের মানুষের পাশাপাশি যুবদের অংশগ্রহণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
কেশপুর সংলগ্ন মহিষদা এলাকা পরিক্রমার সময়ে সেই দৃশ্যই চোখে পড়লো। এখানে সিপিআই(এম) অফিসটি দখল করে সবক’টি লোহার গ্রিলে কাস্তে হাতুড়ি চিহ্ন তুলে দিয়ে সেখানে জোড়াফুল লাগিয়েছিল শাসকদলের দুর্বৃত্তরা। অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও সন্ত্রাস, ভীতির পরিবেশ তৈরি করেছিল। পাটি কর্মীদের নানা মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দিয়েছিল। গণআন্দোলনের নেতা ও স্থানীয় স্কুল শিক্ষক বিপদতারণ ঘোষ শাসকদলের দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ব্যে ৫ বছর স্কুল যেতে পারেননি। এছাড়াও তাঁকে মিথ্যা মামলায় ৯৮দিন জেল খাটতে হয়েছে, আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে প্রায় দু’বছর। এতকিছু করেও লালঝান্ডার অগ্রগতিকে স্তব্ধ করতে পারেনি ওরা। সেদিন তৃণমূলীদের কবল থেকে উদ্ধার করা সেই পার্টি অফিসের সামনে থেকেই সংগঠিত হলো দৃপ্ত মিছিল। উপস্থিত ছিলেন সিপিআই (এম) জেলা সম্পাদক তরুণ রায়, প্রার্থী রামেশ্বর দোলই, পার্টি নেতা মানিক সেনগুপ্ত, বিপদতারণ ঘোষ সহ অসংখ্য পার্টিকর্মী সমর্থক। মিছিল শেষে পথসভায় নেতৃবৃন্দ তুলে ধরলেন এবারের নির্বাচনে কেন সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীদের নির্বাচিত করা জরুরি।
বামফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগে কেশপুর অঞ্চলে যে সাফল্য এসেছিল, বর্তমানে তৃণমূলের শাসনে তা কেবল বিনষ্ট হয়নি, এই এলাকাকে যেন দশ বছর পিছিয়ে দিয়েছে। করোনা মহামারী, আমফান ঝড়ের তাণ্ডব সহ নানা দুর্বিপাক ও সমস্যায় বিধায়কের দেখা মেলেনি। আসেনি কোনো সরকারি সাহায্য। বিপরীতে তৃণমূলের নানা হামলা আক্রমণকে মোকাবিলা করেও সিপিআই(এম)সহ বামপন্থীরা সাধ্যমতো সচেষ্ট থেকেছেন মানুষের পাশে থাকতে। এই কেন্দ্রের মানুষ জানেন, সাধারণ মানুষের স্বার্থে লড়াই আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে ৭৭জন বামপন্থী কর্মীকে শহিদ হতে হয়েছে। ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর শাসকদলের আক্রমণে এপর্যন্ত খুন হয়েছেন ৫ জন সিপিআই (এম) কর্মী। তাঁদের স্মৃতিকে বুকে নিয়েই কেশপুরে গণআন্দোলনের অতীত ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি বিকল্প সরকার গড়ার লক্ষ্যে এই কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চার প্রচার তুমুল সাড়া ফেলছে মানুষের মনে।