৫৮ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৯ মার্চ, ২০২১ / ৫ চৈত্র, ১৪২৭
শালবনির লড়াকু মানুষের উপাখ্যান
সন্দীপ দে
শালবনি কেন্দ্রের সিজুয়াতে প্রচার মিছিলে সিপিআই(এম) প্রার্থী সুশান্ত ঘোষ।
সত্তরোর্ধ্ব পার্বতী মুর্মু প্রথমে চিনতে পারেননি। কিন্তু দেখা গেল নামটা শুনেই তাঁর চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। দীর্ঘ অবকাশের পর আত্মজনদের দেখা পেলে প্রবীণ মানুষদের মন-প্রাণ যেমন খুশিতে ভরে ওঠে,অনেকটা সেরকমই যেন লাগলো পার্বতী মুর্মুকে । সেদিন শালবনি বিধানসভা কেন্দ্রের রসকুণ্ডু গ্রাম পঞ্চায়েতের বিভিন্ন গ্রামে চোখে পড়লো এমনই দৃশ্য। আসলে সেদিন সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী,সিপি আই (এম) নেতা সুশান্ত ঘোষ বেরিয়েছিলেন গ্রাম পরিক্রমায়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন লাল পতাকা নিয়ে দলীয় কর্মীরা। আদিবাসী অধ্যুষিত সোনাবান্দি গ্রামে লাল পতাকা দেখেই মাঠের কাজ ফেলে ছুটে এসেছেন রহিম মুর্মু, দুর্গা মুর্মু,কাজল মুর্মুরা। তাঁরা সুশান্ত ঘোষকে অনেকদিন পর কাছে পেয়ে মনের দুঃখ, যন্ত্রণা সব উজাড় করে দিচ্ছিলেন। অনেকদিন থেকেই বার্ধক্য ভাতা বন্ধ, নিয়মিত কাজ মেলেনা। তাই কোনোদিন অভুক্ত, কোনোদিন অর্ধভুক্ত - এভাবে টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে দিনযাপন। এখানে লুলু মুর্মু পানীয় জলের সমস্যার কথা জানাতে গিয়ে বললেন, তুরা ছিলি গরিব মানুষের পার্টি। আর এখন কেউ খবর লেয় না। শুনে সুশান্ত ঘোষ বললেন, এজন্যই তো আমরা এসেছি তোমাদের কাছে। ৬০ বছরের বেশি হলে বার্ধক্যভাতা দিতে হবে, আইন আছে। আইনটা কার্যকর করে যারা সরকারে আছে তারা। কিন্তু ওরা তা না করে মাঝখান থেকে কাটমানি খাচ্ছে। এটা ধরা পড়ে যাওয়ায় সব সাহায্য প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছে। কাজেই এসব কিছু আবার চালু করতে হলে লালঝান্ডাকে ফেরাতে হবে। বাম আমলে এসএসকে, এমএসকে, আইসিডিএস থেকে শুরু করে নানা সাহায্য প্রকল্প চালু ছিল। আর গত দশ বছর এরা এসবের টাকায় নিজেদের পকেট ভরেছে। তাই তোমাদের বলতে এসেছি এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। কথার সূত্র ধরেই সুশান্ত ঘোষ বললেন, ওরা কেবল গরিব মানুষের টাকাই মারেনি, গরিবদের ওপর অনেক অত্যাচার-নির্যাতনও চালিয়েছে। তাই এসব বন্ধ করতে হবে। আর সেজন্যই তোমাদের চেনা লাল ঝান্ডার পার্টিকে জেতাতে হবে। এই আলাপচারিতা শেষে চলে আসার মুহূর্তে ভিড়ের মধ্যে একজন বলে উঠলেন, গরিব মানুষের চোখ ফুটিয়ে ছিলি তুমরা। এখন দেখছি জোড়া ফুল,পদ্ম ফুল কত কি! কিন্তু ওরা আমাদের জন্য কিছুই করে না।
শুনে সুশান্ত ঘোষ বললেন, এই পদ্মফুল আরও ভয়ঙ্কর। ওরা মানুষে মানুষে ভাগ করতে চাইছে। এই জোড়া ফুলই পদ্মফুলকে ডেকে এনেছে রাজ্যে। তাই এই পদ্মফুলকে দূর করতে হলে জোড়া ফুলকেও দূর করতে হবে।
কদমবান্দি গ্রামে এসে জানা গেল এলাকার প্রবীণ মানুষ, প্রাক্তন প্রধান হাবল করণ অসুস্থ। শুনেই তাঁর কাছে গেলেন সুশান্ত ঘোষ। তাঁকে দীর্ঘদিন পর কাছে পেয়ে অশীতিপর মানুষটি যেন অনেকটাই ভরসা পেলেন। তাঁর বাড়ি থেকে বেরোনোর মুখে দেখা হলো দরিদ্র চাষি প্রশান্ত সরকারের সঙ্গে। তিনি এসেই সুশান্ত ঘোষকে প্রণাম করলেন, তাকে নিরস্ত করা গেলনা কিছুতেই। একবুক উচ্ছ্বাস নিয়ে নিয়ে প্রশান্ত জানালেন, সুশান্তবাবুর জন্যই তাঁর দিদির একটা কাজের সংস্থান হয়েছিল। সে কথা সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না। কথায় কথায় সে আরও জানালো, সেদিন যদি দিদির ওই কাজটা না হতো তবে বাড়ির লোকজনকে বোধহয় না খেয়েই মরতে হতো। এখন যারা এসেছে তাদের তো কিছুই বলার উপায় নেই। ওরা উল্টে সব কিছু কেড়ে নিচ্ছে।
পাশের পরাশোল গ্রামের ফণি মিদ্যা,সনাতন সরদার দুজনের বয়সই পঁচাত্তর পেরিয়েছে। তাঁদেরও অভিযোগ, গত বছর দশেক ধরে সরকার-পঞ্চায়েতের কোনো সাহায্যই পাননি। এসব শুনে সুশান্ত ঘোষ বললেন,সরকার করবে কী করে, ওরা তো ব্যস্ত নিজেদের পকেট ভরতে। আমরাতো চাইছি এদের দূর করতে। সেজন্যই তো আপনাদের সাহায্য-সমর্থন দরকার। এবারে সেটা পাবতো? উপস্থিত সবাই হাত তুলে আশ্বস্ত করলেন। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে লাল পতাকা দেখে ছুটে এলেন মালা-চন্দনা-রেখা সরদাররা। একগাল হাসি নিয়ে মালা সরদার বললেন, কাজ ফেলে রেখে চলে এসেছি। অনেকদিন পর দেখলাম আপনাদের। প্রত্যুত্তরে সুশান্ত ঘোষ বললেন, এখন থেকে আমাদের নিয়মিত দেখতে পাবেন। এতদিন ওরা আমাদের উপর আক্রমণ করে, অনেককে ঘর ছাড়া করে, মিথ্যা মামালায় জড়িয়ে আমাদের আটকে রাখতে চেয়েছে। এখন ওরা নিজেরাই নানা দুর্নীতি-কেলেঙ্কারিতে ফেঁসেছে। এসব থেকে বাঁচতে ওদের অনেকেই দল ছেড়ে ভিড় করছে বিজেপি’তে। বিজেপি-তে গিয়ে ওরা নিজেদের কলঙ্ক ঢাকতে চাইছে। আপনারাই বলুন এসবের বিচার চান কিনা। মালা-চন্দনারা সমস্বরে বলে উঠলেন, হ্যাঁ আমরা বিচার চাই। আমরা যখন আমাদের সমস্যার কথা ওদের বলতে গেছি ওরা আমাদের ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছে। আমরা এতদিন ভয়ে মুখ বুজে থেকেছি। কোনো কথা বলার সাহস পাইনি। শুনে সুশান্ত ঘোষ তাঁদের আশ্বস্ত করে করে বললেন, এবার থেকে আমরা পাশে থাকব। সবাই যাতে নির্ভয়ে চলতে পারেন, নিজের মনের কথা, সমস্যার কথা সহজেই বলতে পারেন সেজন্যই তো এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার। আর এই পরিবর্তন করতে পারবেন আপনারাই। এই কথাগুলি তখন যেন উপস্থিত সবার মনের গভীরে রেখাপাত করছিল। তারই আভাস ফুটে উঠছিল সবার চোখেমুখে।
সংলগ্ন ভৈরবশোল গ্রামের মহিলারা সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী যেতেই ফুল ছড়িয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। মলিন শাড়িপরা আশি পেরোনো বৃদ্ধা করুণা পাত্র লাঠি ভর করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁকে পার্টি কর্মীরা জিজ্ঞাসা করলেন প্রার্থীকে চিনতে পেরেছেন কিনা। তিনি অপলক দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর প্রার্থী স্বয়ং বৃদ্ধার হাতদুটি ধরে নিজের নাম এবং লাল ঝান্ডার কথা বললেন। এবারে চিনতে পেরে প্রার্থীর দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। তখন সেখানে উপস্থিত অপর বৃদ্ধা দুর্গা ঘোষ কান্নাভেজা গলায় বলে উঠলেন, এখন আর ভাতার টাকা পাইনা। আমার যে সংসার চলে না! কয়েক মুহূর্ত যেন সকলেই হতবাক। নীরবতা ভেঙে সুশান্ত ঘোষ বললেন, আপনি নিশ্চয়ই আপনার ন্যায্য সুবিধা পাবেন। আমরা তো সেজন্যই লড়াই-আন্দোলন করে আসছি। আপনাদের কাছে এসেছি একথাই বলতে যে, গরিব মানুষের হকের অধিকার রক্ষা করতে ও দাবি আদায়ের জন্য প্রথমেই দরকার এই সরকারটাকে পরিবর্তন করা। আর তাই দরকার আপনাদের ভালোবাসা, সমর্থন ও সহযোগিতা। সমবেত সকলের সেই আন্তরিক আশ্বাস নিয়ে পরের গ্রাম মইতারা এসে দেখা হলো গণ দুলে, প্রসেনজিৎ দুলে, ভক্তি দুলেদের সঙ্গে। লাল পতাকার পাশাপাশি সংযুক্ত মোর্চার অন্য শরিকদের পতাকা নিয়ে অনেককে দেখে বাড়ির বধূরাও তখন এসে ভিড় জমিয়েছেন। তাঁদের সবার সঙ্গে আলাপচারিতায় বর্তমানের দুঃসহ অবস্থার কথা সংক্ষেপে তুলে ধরলেন প্রার্থী সুশান্ত ঘোষ। কথায় কথায় উঠে এলো তৃণমূল জমানার সন্ত্রাস-অত্যাচারের কথাও। অঞ্চলের মানুষ যে কী দুর্দশার মধ্যে কাটিয়েছেন তাও শোনা গেল। সুশান্ত ঘোষ বললেন,আমরা কমবেশি সকলেই ওদের ওই হিংসা-সন্ত্রাসের সাক্ষী। আপনারা জানেন আমাকেও মিথ্যা মামলায় দীর্ঘদিন জেল খাটতে হয়েছে। ৮৬ বছরের বৃদ্ধা মাকে দেখতে যেতে পারিনি, অসুস্থ স্ত্রীর পাশে থাকতে পারিনি। এই মিথ্যা মামলায় যখন জামিন পেলাম তখন আবার জেলায় ঢুকতে পারিনি। এখন আপনাদের কাছে এসেছি। আর কারও হিম্মত হবে না আপনাদের উপর জোরজুলুম করার। পার্টি আপনাদের পাশে থাকবে। আপনারাও জোটবেঁধে প্রতিবাদ প্রতিরোধের জন্য তৈরি হোন। এই নির্বাচন আপনাদের একটা বড়ো সুযোগ এনে দিয়েছে এই অবস্থা পরিবর্তন করার। আপনাদের নিজেদের স্বার্থে, রাজ্যের মানুষের স্বার্থে এই অপদার্থ লুটেরাদের সরকারকে হঠিয়ে গরিব সাধারণ মানুষের জন্য বিকল্প সরকার গড়ার প্রস্তুতি নিন। তখন সেখানে উপস্থিত সবার চোখেমুখে, শরীরী ভাষায় সেই প্রত্যয়ের আভাস যেন ফুটে উঠছিল।
কেবল সে দিনটাই নয় বিগত মাস তিনেক ধরে সিপিআই(এম) নেতা সুশান্ত ঘোষ দলীয় সাথিদের নিয়ে এই কেন্দ্রের অন্তর্গত প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়, প্রতিটি প্রান্তে এভাবে জনতার মুখরিত সখ্যে পার্টির নেতৃত্বে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ও লড়াইয়ের বার্তা, অন্ধকারের দিন বদল ঘটিয়ে নতুন দিন আনার দুর্জয় বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তা আজ যেন অনেক অত্যাচার-নিপীড়ন ও বঞ্চনা সহ্য করা মানুষদের মনে নতুন সঞ্জীবনী প্রত্যয় জাগিয়ে তুলেছে। তাঁরাও আজ নবীন আশায় বুক বাঁধছেন। যা আগামীদিনে রচনা করবে অকুতোভয় লড়াকু মানুষদের নতুন আশায় দিনবদলের এক প্রত্যয়ী উপাখ্যান।