৫৮ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৯ মার্চ, ২০২১ / ৫ চৈত্র, ১৪২৭
যে চোরেরা তৃণমূলে,/ সে-ই তো আবার পদ্ম ফুলে!
তাই পাঁশকুড়া (পূর্ব) কেন্দ্রের মানুষ সেখ ইব্রাহিমকেই আবার চান
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
পাঁশকুড়া পূর্ব কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী সেখ ইব্রাহিম আলির সমর্থনে মিছিল।
মেদিনীপুর জেলা সহ পাঁশকুড়া পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্রের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার অন্যতম প্রতীক ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন ‘নিভন্ত চুল্লি’। এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের (কেটিপিপি) ৬টি চুল্লির একটি মাত্র ইউনিট এখন চালু। কারণ, রাজ্যের শিল্পক্ষেত্র এখন শ্মশান, তাই বিদ্যুতের চাহিদা নেই। মার্চের গরমে গার্হস্থ্য ব্যবহারের বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে থাকলেও ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন এই একটি চুল্লিই যথেষ্ট। তা মুখ্যমন্ত্রী যতই বলুন না কেন বিদ্যুৎ ব্যাঙ্কের কথা, রাজ্য সরকারেরও এই কেন্দ্র চালু রাখার মতো রসদ নেই। নেই বিদ্যুৎ বিক্রির পরিস্থিতিও।
কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের এই ছবি একই ফ্রেমে গোটা রাজ্যের অর্থনীতি, শিল্প আর কর্মসংস্থানের দেউলিয়া দশাকেই উদোম করে দিয়েছে। কেটিপিপি আবাসনে দাঁড়িয়ে পাঁশকুড়া পূর্ব কেন্দ্রের সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী বর্তমান বিধায়ক সিপিআই(এম)’র ইব্রাহিম আলির নির্বাচনী প্রচারে আসা বিড়লা ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির পড়ুয়া সৈকত মণ্ডল বলছিল ওর উদ্বেগের কথা। ‘পড়াশোনা শেষ করে এখানে (কেটিপিপি)সরকারি চাকরি পাব ভেবেছিলাম। কিন্তু এই উপনগরী থেকেই স্থায়ী কর্মীদের বড়ো অংশকে অন্যত্র বদলি করে দিচ্ছে রাজ্য সরকার। আর কলেজের ক্যাম্পাসিং থেকে যা প্লেসমেন্ট হচ্ছে সব বাইরে। ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই। এ রাজ্যে আমাদের মতো ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী।’ পাশ থেকে আরেক ছাত্র প্রবীর মাইতি বললেন, বিজেপি তো পারলে এই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রই বেচে দেবে!
২০১৬ সালে সন্ত্রাসের আবহাওয়াতেও এই কেন্দ্রে বামপন্থী যুব আন্দোলনের জনপ্রিয় এই নেতা সিপিআই(এম)’র সেখ ইব্রাহিম আলি জিতেছিলেন। কড়া প্রহরার মধ্য দিয়ে ছাত্র-যুবদের নবান্ন অভিযানের দিন মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগনামা নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন নবান্নের চৌহদ্দিতে। রাজ্যের দলদাস পুলিশ বেকার যুবকদের চাকরির দাবি নিয়ে আসা এক বিধায়ককে সেদিন ঢুকতে দেয়নি নবান্নতে। সে ছবি ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়েছে ইব্রাহিমের।
বিধানসভার ভেতরে ইব্রাহিম এলাকার সমস্যার কথা বারবার তুলে ধরেছেন, সোচ্চার হয়েছেন চাকরির দাবিতে। কেপিপি উপনগরীর চৌহদ্দি সংলগ্ন এবং লাগোয়া এলাকায় প্রচার মিছিল সকাল সাড়ে আটটায় শুরু হবার পরই দেখা যাচ্ছিল তাঁর সেই লড়াকু ভূমিকায় খেটে খাওয়া মানুষের ভালবাসার নজির। উপনগরীর রাস্তায় মিছিলকে উল্টো দিক থেকে পেরিয়ে যাওয়া পথচলতি ব্যস্ত মানুষ হাত নেড়ে কেউ কেউ অভিবাদন জানালেন। কেউ মাথা ঝুঁকিয়ে খুশির অভিব্যক্তি আর আস্থার মুদ্রা ফুটিয়ে তুলছেন ইব্রাহিমকে দেখে। দু’চাকার সাইকেল অথবা বাইক চড়ে কর্মস্থলে বা বাজারে বা সন্তানকে স্কুলে পৌঁছতে যাওয়া সওয়ারি অভিভাবকের ডান হাত নড়ে উঠছে পাশে থাকার ইঙ্গিত দিয়ে। হেলমেটের ভেতর থেকে তাঁদের ইতিবাচক চোখ বারবার ঘোষণা করছিল তাঁরা আবারও বিধায়ক হিসেবে ইব্রাহিমকে বেছে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। মিছিল শ্লথ করতে হয়েছে জায়গায় জায়গায়। তাঁকে ঘিরে ধরেছেন যুবক থেকে জীবন যুদ্ধে পোড় খাওয়া শ্রমিক, গ্রামের লালঝান্ডার পাশে থাকা চাষি, খেতমজুরের পরিবারের সদস্যরাও। মাইক ব্যবহারের অনুমতি নেই, তবু গলার শির ফোলানো স্লোগানের শব্দে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন গ্রামের মানুষ। আগুয়ান মিছিলকে ঘিরে ধরেছেন জটলা করে। পথচলতি গেরুয়া পোশাকে পেশায় পূজারি ইব্রাহিম আলিকে মাথায় হাত ছুঁইয়ে জয়ী হবার আশীর্বাদ করছেন, দেখা গেছে এমন দৃশ্যও।
রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলের কৃষিজীবীদের মতো এই বিধানসভা কেন্দ্রের চাষিরাও ফসলের ন্যায্য দাম পান না। রেগায় বছরে ৪৫ দিনের বেশি কাজ পান না বেরোজগার মানুষ। চোখের সামনে দেখেন ভুয়ো শ্রমিকের হিসেব দেখিয়ে তৃণমূলীদের চুরি। আবার সরকার বিজ্ঞাপিত সতেরোশো টাকা নয়, এই এলাকায় ধানের কুইন্টাল প্রতি দাম ঘোরাফেরা করে শাসক ঘনিষ্ঠ ফড়েদের ঠিক করে দেওয়া এগারোশো থেকে বারোশো টাকায়। এদের প্রতিনিধি ইব্রাহিম কর্মসংস্থানের পাশাপাশি ফসলের ন্যায্য দামের দাবিতে বারবার সরব হয়েছেন বিধানসভায়। এলাকার ফুল চাষিদের অন্যতম সমস্যা হলো লকডাউনের জেরে তাদের ভিন রাজ্যের বাজার সংকুচিত। কারণ ট্রেন খড়গপুর পেরিয়ে চলছে কম এবং অনিয়মিত। এই ট্রেন চলাচলে সমস্যা নিয়ে রেলের কাছে পার্টি এবং বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে সমাধানের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। ইব্রাহিম আলি সেই লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এখানে ক্ষুদ্র শিল্পের বেশকিছু হোসিয়ারি ইউনিট রয়েছে যেখানে মালিকপক্ষ ইউনিয়ন করতে দিতে নারাজ। তৃণমূল-বিজেপি মালিকদের পাশে। কাজের সময় ৮ ঘণ্টার চেয়ে বেশি। প্রভিডেন্ট ফান্ড বা গ্র্যাচুয়িটি এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে ইএসআই’র সুবিধা অমিল। শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে সিপিআই(এম)’র পক্ষ থেকে চলছে লাগাতার আন্দোলন। বিধায়ক হিসেবে মালিকপক্ষের সঙ্গে বারবার বৈঠকে উপস্থিত থেকে সোচ্চার হয়েছেন ইব্রাহিম।
এলাকার চাষিদের আরেকটি সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে ইদানিং। শাসক তৃণমূলের জোর জবরদস্তিতে কৃষি জমিতে ভেড়ি তৈরি করে মাছ চাষ হচ্ছে। ভেড়ির জলের জেরে এলাকার জল নিকাশের সমস্যা তীব্র হয়েছে। সমস্যা সমাধানে এলাকার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে প্রশাসনকে ডেপুটেশন দিয়েছেন বিধায়ক।
রাজ্যসভার সাংসদ তপন সেনের তহবিল থেকে এলাকার ৮০ শতাংশ স্কুলকে ক্লাস রুম তৈরি থেকে বিভিন্ন খাতে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা অর্থ সাহায্য পাইয়ে দিয়েছেন ইব্রাহিম। ইব্রাহিমের এমন উদ্যোগকে স্কুলগুলির সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক, বামফ্রন্টের ভোটার নন এমন মানুষও সাধুবাদ জানাচ্ছেন।
করোনার তীব্রতার যে স্তরে আতঙ্কে মুখে মাস্ক পরেও পাশাপাশি দু’জন মানুষ কথা বলতে ভয় পেতেন, তখন রুজি হারানো বেরোজগার মানুষ থেকে ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে প্রবলভাবে থেকেছেন ইব্রাহিম আলি। প্রতিদিন তাদের কাছে রসদ পৌঁছে দিচ্ছেন। কে কোন্ দলের সমর্থক তার তোয়াক্কা না করেই অসুস্থ মানুষকে পৌঁছে দিয়েছেন চিকিৎসকের কাছে, সংক্রমণের তোয়াক্কা না করে পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছেন। সেদিন আজকের ভোট চাইতে আসা বিজেপি-তৃণমূল পাশে ছিল না। প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলিতে ইব্রাহিমের নেতৃত্বে পার্টিকর্মীদের ঝাঁপিয়ে পড়ার কর্মকাণ্ড মানুষ মনে রেখেছেন। আর সেই পরিযায়ী শ্রমিকরা, যারা ভিন রাজ্যে রয়েছেন, লকডাউনে সরকারকে পাশে পান নি, তারা তৃণমূলের ওপর ক্ষোভে ফুঁসছেন। শাসকদলের সঙ্গে বোঝাপড়া ব্যালটে মেটাতেই গ্রামে ফিরছেন ১ এপ্রিল ভোট দিতে।
ভিন রাজ্যে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষোভটা সংগত। কারণ পাওয়ার প্লান্টে তাঁরা কাজ পাননি, এমন কি ঠিকা শ্রমিকের কাজও পাননি। কারণ অভাবী কৃষক পরিবারের সন্তানেরা তৃণমূল নেতাদের ঘুষ দিতে পারেননি। অভিযোগ, ঠিকা শ্রমিকদের ঠিকাদারি এতদিন চালাত শুভেন্দু অধিকারীর লোকেরা। দল বদলে শুভেন্দু বিজেপি-তে যেতেই তৃণমূল প্রার্থী বিপ্লব রায়চৌধুরী ঠিকাদারি থেকে ফ্লাই অ্যাশ’র লরি পিছু কাটমানি পৌঁছে দিচ্ছেন তৃণমূলের শীর্ষস্তরে। ভাগে টান পড়ায় গোষ্ঠী কোঁদলে জেরবার তৃণমূল। অতএব প্রার্থীকে ঘিরে ক্ষোভ সর্বস্তরেই।
এদিকে গোটা রাজ্যের মতো পাঁশকুড়াতেও মানুষ ঠাট্টার পাশাপাশি রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে টিপ্পনী করতে ছাড়ছেন না। মুখ্যমন্ত্রীর পায়ে চোট লাগার ঘটনা সম্পর্কে তাঁরা জানতে চাইছেন, আমাদের জেলায় পায়ে সামান্য মোচড় লাগলেও তার চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই একথা মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রমাণ করে দিলেন। ১০ বছর স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকার পরেও সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের নামে উনি যে ভাঁওতা দিয়েছেন তা স্পষ্ট হয়ে গেল। আমাদের চিকিৎসার দুরবস্থার কথা একবার ভাবুন তাহলে!
ইব্রাহিম আলি বলছিলেন, এ রাজ্যে এখন ঘুষ ছাড়া চাকরি নেই, কল কারখানা নেই। বামফ্রন্টের সময়ে চালু হওয়া কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা ক্ষমতায় এলে এসএসসি চালু হবে প্রতি বছর। সরকারি শূন্য পদে মেধার ভিত্তিতে পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ হবে, কাউকে এক টাকাও দিতে হবে না।বিরোধীদের সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, এরাজ্যে যাহা তৃণমূল তাহাই বিজেপি। তৃণমূলের প্রাক্তন তোলাবাজ, ঘুষখোর, চোরেরা এখন বিজেপি’র নেতা। যে শুভেন্দু অধিকারী বলেছিলেন তৃণমূল ছাড়া এখানে কিছুই থাকবে না, তিনি এখন বিজেপি’র ঝান্ডা ধরেছেন। মানুষের কাছে এসব বোঝাপড়া স্পষ্ট। তাঁরা বলছেন, তোমাদের দরকার। সংযুক্ত মোর্চাকেই দরকার। তাই আমরা প্রত্যয়ী, আমরা জিতব। ইব্রাহিম আলির বক্তব্যকে অনুসরণ করেই স্লোগান উঠল -
যে চোরেরা তৃণমূলে,/ সে-ই তো আবার পদ্ম ফুলে!/ তাইতো বলি এ বাংলায়/ কোনো ফুলই চলবে না।