৫৮ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৯ মার্চ, ২০২১ / ৫ চৈত্র, ১৪২৭
কলেজ পড়ুয়া, চাষি থেকে পরিযায়ী শ্রমিক দাসপুরে মোর্চা প্রার্থীকে জিতিয়ে বঞ্চনার জবাব দিতে চান
দেশহিতৈষীর প্রতিবেদন
দাসপুর কেন্দ্রে প্রচারে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী ধ্রুবশেখর মণ্ডল।
ফোন আসছে। বারবার। না কোনো রাজনৈতিক প্রচারের মধুমাখা গলায় সাঙ্গীতিক আবেদন নয়। ভিন রাজ্যে থাকা দাসপুরের ঘরের ছেলেদের ফোন। কারণ, দাসপুরের ৪০ হাজারেরও বেশি যুবক এখন রয়েছেন ভিন রাজ্যে। তাঁদের ফোন আসছে। দীর্ঘ দিন পরে বাড়ি ফেরার আকুতি নয়, তাঁরা ফোনে বলছেন অন্য কথা। জেলা এবং বিধানসভার নির্বাচনী প্রস্তুতি জানতে চেয়ে তাঁরা ফোনে বলছেন ফেরার কথা, ফেরানোর কথা। কি ফেরাবেন তাঁরা? দল বেঁধে তাঁরা আসবেন ভোট দিতে। ১ এপ্রিল। তাঁরা মনে রেখেছেন করোনার সময় মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের ঘরে ফেরার ট্রেনকে ‘করোনা এক্সপ্রেস’ বলে দায় ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। অসহায়ভাবে আধাপথ হেঁটে নরেন্দ্র মোদীর রেলকে কোনোরকমে পুরো ভাড়া গুনে দিয়ে কতটা অমানবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে তাঁদের ফিরতে হয়েছিল ট্রেনে। মনে রেখেছেন তাঁদের বন্ধু রাজু আলির কথা। দীর্ঘ পথ হেঁটে মুম্বাই থেকে ফেরার পথে চকপ্রসাদ গ্রামের রাজুর মৃত্যুর কথা। আজ পর্যন্ত রাজুর পরিবারকে রাজুর ডেথ সার্টিফিকেট দিতে পারেনি কেন্দ্র-রাজ্যের সরকার - তার কথা। কি অসহায় পরিস্থিতিতে দিন কাটাচ্ছেন রাজুর বাবা মা স্ত্রী - তার কথা। তাঁরা সুদ সহ ফেরাবেন সব।
দাসপুর ১ এবং দাসপুর ২ ব্লক নিয়ে গঠিত দাসপুর বিধানসভা। এই দাসপুরকে বলা হয় ‘সবজি ভাণ্ডার’। শিম, আলু, পটল, বাঁধাকপি সহ সবরকমের সবজি বিপুল পরিমাণে এখানে ফলে। এখানে সংযুক্তমোর্চার প্রার্থী সিপিআই(এম)’র ধ্রবশেখর মণ্ডল। কিন্তু তৃণমূল আশ্রিত ফড়েদের উৎপাতে চাষিদের নাভিশ্বাস উঠেছে। বিঘের পর বিঘে সবজি চাষে অভ্যস্ত দাসপুর এখন আর লোকসানের বোঝা বইতে রাজি নয়। সার বীজ সহ দাম বেড়েছে কৃষির সব উপকরণের। তাই তাঁরা কমিয়ে দিতে চাইছেন চাষের পরিমাণ। কারণ, সবজি সংরক্ষণের কোনো উপায় নেই। মাঠের ফসলের কোনো সরকার নিয়ন্ত্রিত হিমঘর নেই। সেচের জল নেই। বাজারে ৩০-৪০ টাকার নিচে কোনো সবজির দাম না থাকলেও এখানকার কৃষক কেজি পিছু ১০ বা ১২ টাকার বেশি দাম পান না। দাসপুরের কৃষকরা এই ফসল সংরক্ষণের পরিকাঠামো না থাকার জেরে বছরভর চূড়ান্ত অনিশ্চয়তায় দিন কাটান। চাই হিমঘর। সারা ভারত কৃষক সভার নেতৃত্বে ফসলের ন্যায্য দাম, এবং সরকারি হিমঘরের দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন চলছে দাসপুরে। জেলার শিক্ষক নেতা সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী সিপিআই(এম)’র ধ্রুবশেখর মণ্ডল বলছেন, আমরা চাই কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পান। হিমঘর গড়তে চাই সংযুক্ত মোর্চার সরকার। শুধু হিমঘর নয়, ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিনামুল্যে দিতে চাই আমরা। স্থানীয় দাবিগুলিকে অগ্রাধিকার দিতে চাই। বিধানসভায় মুখ খুলেছেন বর্তমান তৃণমূল বিধায়ক, এমন ‘দোষ’ তাঁকে কেউ দিতে পারবেন না। কারণ অভিযোগ, তিনি দলের গোষ্ঠী কোন্দল, নানাস্তরের কাটমানির বাটোয়ারা ইত্যাদি অর্থকরী বিষয়ে বছরভর ব্যস্ত থাকেন। এলাকার মানুষ তাঁকে পান না। তাই গ্রামের মানুষ তাঁদের প্রিয় ‘ধ্রুব স্যার’কে কাছে পেয়ে উজাড় করে দিচ্ছেন তাদের পাওয়া না পাওয়ার পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে দাসপুরের দু’টি ব্লকেই ভোট হয়েছে একতরফা। বলা উচিত, মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর্ব থেকে ভোট পর্যন্ত সবটাই মমতা ব্যানার্জির অনুপ্রেরণায় ‘উন্নয়নবাহিনী’ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে ২০১৮ সালে। তারপর লুটেপুটে খেয়েছে সবরকমের বরাদ্দের টাকা। দাসপুরের দু’টি ব্লক মিলিয়ে খেতমজুরের সংখ্যা কুড়ি হাজার। দাসপুরে জব কার্ডে মেরেকেটে ৬০ থেকে ৬৫ দিন রেগা’র কাজ পাওয়া যায়। লুট হয়েছে জব কার্ড। অভাবি মানুষ তার হদিশ পাননি। প্রার্থী ধ্রুবশেখর মণ্ডল গ্রামে গ্রামে বলছেন ইশতিহারের কথা। সংযুক্ত মোর্চা ক্ষমতায় এলে রেগায় ১৫০ দিন কাজ পাবেন। কেন্দ্র টাকা না দিলেও রাজ্য সরকার দেবে সেই টাকা।
গণতান্ত্রিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত দাসপুরে। পঞ্চায়েতের হিসেব অমিল। আমফানের ত্রাণের টাকা লুটের সময়ের পরিস্থিতি চরমে পৌঁছলে গ্রামগুলিতে মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সেই ক্ষোভের আগুন যে ধিকি ধিকি জ্বলছে তার আঁচ পাওয়া গেল প্রার্থীকে নিয়ে বসা বিভিন্ন বৈঠকি সভায়। গরিব অসহায় মানুষগুলোকে ভাঙা ঘর ছাওয়ার ত্রিপলটুকুও দেয়নি পঞ্চায়েত। এমনই একটি বৈঠকি সভায় সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী শিক্ষক নেতা ধ্রুবশেখর মণ্ডলকে দুরবস্থা ডেকে দেখাচ্ছিলেন কলড়া গ্রামের মানুষ। বলছিলেন বৃদ্ধা চঞ্চলা রুইদাসকে পঞ্চায়েত অফিসে ত্রিপল চাইতে গিয়ে ঘুষ না দিতে পারায় কিভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। তাঁর অসহায় অবস্থার কথা জেনেও তাঁর কাছ থেকে টাকা চাওয়া হয়েছে। এখনও বিধবা ভাতার টাকা পাননি তিনি। তাঁর দুয়ার সরকার এড়িয়ে গেছে। আবার নাম নথিভুক্ত করেও বাড়ি পাননি, ঘটেছে এমন ঘটনাও অন্যত্র। গৌরহরি দাস, মহাদেব দাস, সহদেব দাসরা ঘর পাননি এখনও। অথচ পাকা বাড়ি থাকলেও তৃণমূল ঘনিষ্ঠদের একতলা বাড়ি দোতলা হয়েছে। পাওয়া যায়নি স্বাস্থ্য কার্ড। স্বাস্থ্য কার্ডের অবশ্য কোনো মূল্য নেই দাসপুরের নিম্নবিত্ত মানুষদের কাছে। কারণ, দাসপুর গ্রামীণ হাসপাতালে মাসে ২ দিন ডাক্তার আসে। আর স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সামান্য হাত-পা কেটে গেলেও পরিষেবা অমিল। ক্ষোভের সঙ্গে বলছিলেন সবাই সেসব।
মুম্বাই, আহমেদাবাদ, সুরাট, কোয়েম্বাটুর, গুন্টুর সহ পশ্চিম এবং দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন শহরে কাজ করতে যান দাসপুরের ভূমিপুত্ররা। সেখানে শুধু স্বর্ণ শিল্পের সঙ্গেই যুক্ত দাসপুরের প্রায় ৩২ হাজার যুবক। এই যুবকদের জন্য স্বর্ণশিল্পের হাব তৈরি করে দেবে সংযুক্ত মোর্চার সরকার। ভিন রাজ্যে নয়, গ্রামের ছেলেরা গ্রামে থেকেই কাজ পাবেন। এটাই বামপন্থার বিকল্প নীতি। প্রচারে এটাই বলছিলেন সংযুক্ত মোর্চার মাস্টারমশাই প্রার্থী। চকপ্রসাদ গ্রামে প্রার্থী গিয়েছিলেন মৃত পরিযায়ী শ্রমিক রাজু আলির বাড়ি। তাঁর কাছে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাজুর বাবা নুরুল হক। তিনি ছেলের এই অপমৃত্যুর বিচার চেয়ে পাননি। পাননি ডেথ সার্টিফিকেট। ধ্রুব স্যার তাঁর পাশে আছেন জানেন তিনি। পুত্রহারা পিতা বলেছেন, তিনিও তাঁর পাশে থাকবেন। মাস্টারমশাই প্রার্থী দাসপুরের মানুষকে বলছেন, ‘ওরা ভুল বুঝিয়েছে, মিথ্যা বলেছে, চুরি করেছে গত ১০ বছর। আগের বিধায়ক বিধানসভায় গিয়ে এলাকার কথা বলতেন না। আমি আপনাদের দাবির কথা বলব বিধানসভায়। দাবিগুলি সংহত করে স্থানীয় দাবি আদায় করে ছাড়ব। রামের (বিজেপি) আর তৃণমূলের কোনো তফাৎ নেই। ভোটটা তাই বামে দিতে হবে।’
পানীয় জলের অভাব এখানে তীব্র। তার পাশাপাশি রয়েছে সেচের জলের অভাব। তাই মার খাচ্ছে চাষ। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে মূলত বোরো চাষের জন্য নদীতে বাঁধ দিয়ে জল ধরে রাখা হতো। কিন্তু সে সব এখন অতীত। রাজ্য সরকারের বহুল প্রচারিত সজল ধারা মুখ থুবড়ে পড়েছে এখানে। তীব্র জলকষ্ট। আর তৃণমূলের পঞ্চায়েত নিষ্ঠুর রসিকতা করেছে গ্রামবাসীদের সঙ্গে। বেশ কয়েক জায়গায় পাইপ বসালেও জলের দেখা নেই। অথচ কাগজে-কলমে প্রকল্প চালু রয়েছে।
শিক্ষিত বেকারদের নিয়োগ তো কবেই বন্ধ করে দিয়েছে রাজ্য সরকার। ১০ বছর আগে যারা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের স্কুলপড়ুয়া ছিল তাদের বয়স এখন ২৮ ছুঁই ছুঁই। বেকারত্বের যন্ত্রণা এখন ক্ষোভে পরিণত হয়েছে। এসএসসি বা টেট পরীক্ষা হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই নিয়োগ আটকে। প্রতি বছর বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। টাকা দিয়ে চাকরি কিনতে হচ্ছে। পাঁচবেড়িয়া থেকে জয়কৃষ্ণপুরে ধ্রুব স্যারের ছাত্ররা নেমে পড়েছেন স্যারের হয়ে প্রচারে। কলেজ ছাত্র প্রশান্ত মাজি বলছিলেন, শিক্ষামন্ত্রীর সেই নিষ্ঠুর মন্তব্যের কথা। ‘এসএসসি কি দুর্গাপুজো যে বছর বছর হবে?’ শিক্ষামন্ত্রীকে প্রশান্তরা মনে করিয়ে দিতে চান, নির্বাচন কিন্তু পাঁচ বছরে একবার হবেই। জবাবটা দেওয়া হবে সেখানেই।