৫৮ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৯ মার্চ, ২০২১ / ৫ চৈত্র, ১৪২৭
সিপিআই(এমএল): পশ্চিমবঙ্গে বেঠিক বাঁক
একটি রাজনৈতিক মতামত
পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের কী কৌশল অবলম্বন করা উচিত সে বিষয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই সংবাদমাধ্যমে সিপিআই(এমএল)-র সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের মতামত সম্প্রচারিত হচ্ছে।
বিজেপি এবং তৃণমূলকে সমকক্ষ হিসেবে গণ্য করার জন্য এবং একইসাথে বিজেপি এবং তৃণমূল উভয়ের বিরুদ্ধেই লড়াইয়ের আহ্বান জানানোর জন্য তিনি সিপিআই(এম) তথা বামফ্রন্টের সমালোচনা করেছেন।
৮ মার্চ, দ্য হিন্দু সংবাদপত্রকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন - সিপিআই(এম)’র নেতৃত্বাধীন জোট যে রাজনৈতিক লাইন নিয়েছে তা হলো ‘সংকীর্ণ, অদূরদর্শী, আত্মঘাতী’। তিনি এও বলেছেন যে, বামফ্রন্ট ‘মমতা ব্যানার্জি এবং তৃণমূলকে টার্গেট করার সময় বিজেপি’কে খাটো করে দেখছে।’ এই ‘ভ্রান্ত’ লাইনের বিপ্রতীপে সিপিআই(এমএল) সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন জোট থেকে তারা সরে এসে একাই লড়বে। রিপোর্ট বলছে, ১২টি আসনে তারা প্রার্থী দেবে, সম্ভবত ১২ থেকে ১৫টি আসনে বাম প্রার্থীদের সমর্থন করবে এবং অন্য আসনগুলিতে বিজেপি’কে পরাস্ত করার জন্য প্রচার করবে। অর্থাৎ ২০০টির বেশি আসনে তাদের সমর্থন রয়েছে তৃণমূলের পক্ষে, এমনটাই ইঙ্গিত মিলছে।
সিপিআই(এমএল)-র অভিযোগ যাই হোক না কেন, সিপিআই(এম) তথা বামফ্রন্ট কখনোই বিজেপি এবং তৃণমূলকে এক করে দেখছে না। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি যে বিপদের সংকেত বয়ে এনেছে, তাকেও কোনো অংশেই ছোটো করে দেখা হচ্ছে না। এই রাজ্যে হিন্দুত্ব বাহিনী মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে এবং ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল থেকে তাদের উপস্থিতি কতটা বিপজ্জনক সেটাও বোঝা গেছে। কিন্তু তাই বলে, সিপিআই(এমএল)-র সাধারণ সম্পাদকের কথা মতো, তৃণমূল কংগ্রেসকে ও তার অত্যাচারী শাসনকে কখনোই কোনভাবেই ‘ফ্যাসিস্ত আগ্রাসন’ বিরোধী সংগ্রামের মিত্র বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে না।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের ভূমিকা এবং মমতা ব্যানার্জির সরকারের চরিত্র সম্পর্কে সঠিক বোঝাপড়া থাকা অত্যন্ত জরুরি। তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট-বিরোধী এবং বাম-বিরোধী শক্তির পুরোধা। ফ্যাসিস্তসুলভ হিংসা এবং লুম্পেন রাজনীতির মাধ্যমে তৃণমূল সিপিআই(এম) এবং বামফ্রন্টকে টার্গেট করেছে এবং বাম আন্দোলনকে শারীরিকভাবেই দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। গত এক দশকে সিপিআই(এম) সহ বামেদের ২২০ জনের বেশি কর্মী-সমর্থক খুন হয়েছেন, হাজারেরও বেশি ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, এক লাখেরও বেশি মিথ্যে মামলা সাজানো হয়েছে, এবং অনেক জায়গাতে সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস তার রাজনৈতিক জীবন শুরুই করেছিল বিজেপি’র জোটসঙ্গী হিসেবে। এবং ২০১৪ সাল পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদী তৃণমূল কংগ্রেসকে সম্ভাব্য মিত্রশক্তি হিসেবে দেখেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’র উত্থানের পিছনে রয়েছে তৃণমূল শাসনের প্রতিষ্ঠা এবং বামেদের দমন। সিপিআই(এমএল)-র মনে হলেও, একটি অগণতান্ত্রিক লুম্পেনাইজ্ড দল কখনো ফ্যাসিবাদের সাথে লড়তে পারে না।
বিহারের রাষ্ট্রীয় জনতা দল বা উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে তৃণমূলকে সমতুল করে দেখাটা ভুল হবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে আপনি শয়তানের সাথে এক টেবিলে বসতে পারেন না। তৃণমূল কংগ্রেস এবং মমতা ব্যানার্জির সরকার বারবার শ্রমিকশ্রেণির সাধারণ ধর্মঘট এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের বিরোধিতা করেছে এবং এই সংগ্রামের ওপর আঘাত হেনেছে। এমনকি ২৬ নভেম্বরের সাধারণ ধর্মঘটের মতো মোদী সরকারের নীতির বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলনগুলিকেও তারা চেষ্টা করেছে দমন করার। ভয়ানক দমন পীড়নের একটি দুঃখজনক উদাহরণ হলো যুবক মইদুলের মৃত্যু। ছাত্র-যুবদের একটি প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশের লাঠির আঘাতের ফলে যাঁর মৃত্যু হয়।
সাধারণ মানুষের মধ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সিপিআই(এমএল) তাকে খাটো করে দেখছে। এটি একটি বিধানসভার নির্বাচন। বামফ্রন্ট যদি দৃঢ়তার সঙ্গে, জোরের সঙ্গে, এক বাক্যে তৃণমূল সরকারের অবসান ঘটানোর জন্য না লড়ে, তাহলে এই ব্যাপক ক্ষোভের বিপুল অংশটাই কাজে লাগাবে বিজেপি তার নিজের স্বার্থে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও তৃণমূলের স্বৈরাচারী শাসনে জর্জরিত মানুষের একাংশ বিজেপি-কে ভোট দিয়েছিলেন। কারণ তাঁরা ভেবেছিলেন, তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো শক্তি বামফ্রন্টের নেই।
আজকে পশ্চিমবঙ্গে এমনই অবস্থা যে, বিজেপি’র কূটচক্রান্তের বিরুদ্ধে মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্যও তৃণমূল-বিরোধী শক্তি হিসেবে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা আগে প্রমাণ করা একটা জরুরি কাজ হয়ে উঠেছে।
সিপিআই(এমএল) যে নির্বাচনী কৌশলের কথা বলছে তা বিজেপি বিরোধী সংগ্রামকে শক্তিশালী করতে মোটেই সাহায্য করবে না। তৃণমূলকে সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন পার্টিকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি, সেই তালিকায় সিপিআই(এমএল)-র সাধারণ সম্পাদকের নামও রয়েছে। এটা সত্যিই খুব দুঃখজনক যে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’র বিরুদ্ধে লড়াইতে সিপিআই(এমএল) পথভ্রষ্ট হয়ে বামফ্রন্টের চেয়ে তৃণমূলকে বেশি বিশ্বস্ত ও ভালো বলে মনে করছে!
(পিপলস্ ডেমোক্রেসি থেকে অনূদিত)