৫৮ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৯ মার্চ, ২০২১ / ৫ চৈত্র, ১৪২৭
বকুকীর্তি ঢাকতেই স্বাধীনতার ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ চায় সঙ্ঘ
গৌতম রায়
আরএসএস তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি’র রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সুযোগ নিয়ে নিজেদের জন্মলগ্ন থেকে ভারত এবং ভারতবাসীর সঙ্গে যে বেইমানি তারা করে এসেছে, তাকে ঢেকে দিতে চায়। রাষ্ট্রক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ফ্যাসিস্টদের ইতিহাস বিকৃতির যে ধারাবাহিকতা আমরা অতীতে ইতালি, জার্মানিতে দেখেছিলাম, সাম্প্রতিক অতীতে জিয়াউর রহমান থেকে এরশাদ, খালেদা জিয়ার শাসনকালে বাংলাদেশে দেখেছি, ঠিক তেমন ঘটনাবলী ঘটাবার বহু চেষ্টা ভারতে ধর্মান্ধ ফ্যাসিস্ট শক্তি বহুকাল ধরে করে আসছে। গত শতাব্দীর নয়ের দশকে যখন অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্ব কালে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ নামক নীতিবিহীন, সুবিধাবাদী জোট প্রায় সাড়ে ছয় বছর কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল, তখন এই প্রচেষ্টা ভয়াবহভাবে করা হয়েছিল। যদিও তখন সংসদীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেই হোক আর মাঠে ময়দানের রাজনীতির পরিসরেই হোক বামপন্থীরা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল, অন্যান্য অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিগুলি বলবান ছিল, তাই সেই প্রচেষ্টাকে সফল করে তুলবার ক্ষেত্রে আরএসএস বা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি কখনো কখনো বিক্ষিপ্তভাবে সফল হলেও সার্বিক কোনো সাফল্য তারা পায়নি। আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে, বিরোধী দলগুলির শক্তিক্ষয়ের সুযোগ নিয়ে তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্রীড়নক হিসেবে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের যে ন্যক্কারজনক ভূমিকা, সেই ভূমিকাকে বিজেপি চেপে দিয়ে, ইতিহাস পুনর্নির্মাণের নামে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে স্বাধীন ভারত পরিচালনার ইতিহাসে নিজেদের ইতিবাচকভাবে মেলে ধরতে চায়। একদা ঠিক এইভাবেই ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ চেয়েছিলেন ইতালিতে মুসোলিনি, জার্মানিতে হিটলার। তাই ইতিহাস বিকৃত করতে খোদ সংসদ ভবন রাইখস্টাগে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল ফ্যাসিস্টরা। পাশের রাষ্ট্র বাংলাদেশে তাঁদের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল সেই শক্তি, যারা চায়নি পাকিস্তানের এবং আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী থাবা থেকে বের হয়ে এসে তৈরি হোক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। সেই চণ্ড শক্তিরই বর্তমান সংস্করণ হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির তাই এখন ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে ইতিহাসের পুনর্নির্মাণের নাম করে আমাদের জাতীয় আন্দোলনের গৌরবজনক ইতিহাসকে বিকৃত করতে চায়। যে আরএসএস কখনো স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়নি, আরএসএস’র সেইসময়ের রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভা ব্রিটিশ আর হিন্দু, মুসলিম উভয় মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক শিবিরের শ্রেণিস্বার্থের তাগিদে দেশকে দ্বিখণ্ডিত করেছিল, সেই আরএসএস, হিন্দু মহাসভা আর তাদের নেতাদের এখন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়কের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে উঠে পড়ে লেগে গিয়েছে।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ চাইছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই ডাক দিয়ে গান্ধীজির সবরমতী আশ্রম থেকে ১২ মার্চ, ’২১ ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসবে’র সূচনা করলেন মোদী। যে হাত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসের মূর্তিতে মালা দিয়েছেন, সেই হাত দিয়েই গান্ধীজির মূর্তিতে মালা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন কংগ্রেস এবং নেহরু পরিবারের কীর্তিতে রঞ্জিত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের তিনি পরিবর্তন চান। তিনি তুলে ধরতে চান ইতিহাসে উপেক্ষিতদের ভূমিকা। প্রধানমন্ত্রী ইতিহাসে উপেক্ষিতদের তালিকায় একবারও কিন্তু ভূমিস্তরে লড়াই করেছেন যেসব মানুষ, যাঁদের ভিতরে একটা বড়ো অংশ আছেন, যাঁরা ধর্মে মুসলমান, তাঁদের নামোচ্চারণ পর্যন্ত করেন নি। গান্ধী হত্যার সঙ্গে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের ঘনিষ্ঠ সংযোগ আজ সবার জানা। দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির গান্ধী হত্যাকারী নাথুরামের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক অস্বীকার করবার চেষ্টা করে। আরএসএস’র সেই সময়ের রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভার সঙ্গে নাথুরামের প্রথমে ঘনিষ্ঠতা, পরে কৌশলগত কারণে প্রকাশ্য ঘনিষ্ঠতা এড়ানো - এইসব প্রসঙ্গগুলিই হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির এখন বেমালুম চেপে যেতে চায়। সেই গান্ধীজিরই ডাণ্ডি অভিযানের অনুকরণে নতুন করে অভিযানের ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। আরএসএস অনুমোদিত এই নতুন ডাণ্ডি অভিযানের ভিতর দিয়ে আদিবাসী সহ পাদপ্রদীপের তলায় থাকা মানুষ, যাঁদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা আছে, সেইসব অবদানগুলিকে আরও গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরবার অঙ্গীকার প্রধানমন্ত্রী করেছেন। সহজেই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, কোন্ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে নতুন করে ডাণ্ডি অভিযানের কথা নরেন্দ্র মোদী বলছেন।
আপাতদৃষ্টিতে মানুষের মনে হতে পারে, জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাস চর্চাতে নতুন গবেষণার ধারাকে উজ্জীবিত করা প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য। একটু গভীরভাবে ভাবলেই দেখা যাবে, নতুন গবেষণার কোনো আঙ্গিক উন্মোচন প্রধানমন্ত্রী মোদীর আদৌ লক্ষ্য নয়। তাঁর একমাত্র টার্গেট হলো, আমাদের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে আরএসএস সহ গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির যে বেইমানির ইতিহাস আছে, ব্রিটিশের সেবাদাসের ভূমিকা পালনের ইতিহাস আছে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর বিয়াল্লিশের আন্দোলনের কালে তৎকালীন যুক্তপ্রদেশের (পরবর্তীতে উত্তরপ্রদেশ) বটেশ্বর থানায় পুলিশের কাছে মুচলেকা দিয়ে ব্রিটিশের কার্যত সেবাদাস হিসেবে কাজ করবার অঙ্গীকারপত্র আছে, তারও আগে ব্রিটিশের দাসানুদাস হিসেবে কাজ করবার বিনিময়ে আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে লেখা সাভারকরের মুচলেকা আছে - সেই সবগুলোকে একদম ভ্যানিশ করবার লক্ষ্য নিয়েই আরএসএস’র নির্দেশে নরেন্দ্র মোদী আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের পুনর্নির্মাণের কথা বলতে শুরু করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাস নতুন করে চর্চার ইচ্ছের ভিতরে ইতিহাস বিকৃতির অভিসন্ধিই সবথেকে বড়ো হয়ে উঠছে। ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে নেতা-নেত্রীদের অবদান অপেক্ষা সাধারণ মানুষের লড়াই, সংগ্রামের বিষয়টিকেই সবথেকে বেশি গুরুত্বদিয়ে তুলে আনার ধারাটি প্রথম শুরু করেছিলেন বস্তুবাদী ইতিহাস গবেষকেরা। জাতীয়তাবাদী প্রবণতার ইতিহাসকারেরা ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে ইতিহাস দর্শনের আধুনিক গতিপথের দিকে যে সব সময়ে সুবিচার করেছিলেন তা বলা যায় না। জাতীয়তাবাদের আড়ালে উগ্র জাতীয়তাবাদ, যা সেই সময়ে সুপ্ত হিন্দুত্ববাদী চেতনার ধারণার দ্বারা পুষ্ট ছিল, সেই ধারার ইতিহাস রচনার প্রবণতাও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ঘিরে ক্ষমতা হস্তান্তরের অল্প সময় পর থেকেই তীব্র হয়ে উঠতে শুরু করে।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের ভূমিকা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পদলেহনকারী। সেই ভূমিকাকে আড়াল করতে প্রথম এগিয়ে এসেছিলেন সাভারকর। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের (১৮৫৭) ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন সাভারকর ঘটিয়েছিলেন এ সম্পর্কে লেখা তাঁর গ্রন্থে।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পণ্ডিত নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে মহাবিদ্রোহের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে সাভারকরের দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী হয়ে প্রথমে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ১৮৫৭-র ইতিহাস লেখায় হাত দেন আরএসএস’র ঘরের লোক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার। তাঁর ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং সেই ভাবনার প্রকাশ ১৮৫৭-র ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে ঘটতে শুরু করায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে ডঃ মজুমদারের তীব্র সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয়। ভারত সরকার কোনো অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি-প্রসূত চেতনাকে সরকারি ইতিহাসের স্বীকৃতি দিতে রাজি হয় না। এই অবস্থায় ডঃ মজুমদারেরই সহপাঠী তথা পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য সুরেন্দ্রনাথ সেন ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করেন।
নিজেদের ব্রিটিশ তোষামোদের ইতিহাসকে চেপে রাখতেই হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে বিশেষ পরিবারের ইতিহাস হিসেবে তুলে ধরবার অভিযোগ তোলে। এভাবেই তারা মুসলিম সাম্প্রদায়িক শিবিরকে সাহায্য করে, মুসলিম লিগের দেশভাগের দাবি এবং সেই দাবি পূরণ ঘিরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীদের যে ভূমিকা, তা মানুষকে ভুলিয়ে দিতে চায়।ভুলিয়ে দিতে চায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মুসলমান সম্প্রদায়ের ধারাবাহিক ঐতিহাসিক অবদানকেও। তাই-ই প্রধানমন্ত্রী মোদী সবরমতী আশ্রমে দাঁড়িয়ে আমাদের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে স্বাধীনতার ইতিহাস পুনর্নির্মাণের যে কথা বলেছেন, সেখানে আদিবাসী সমাজের কথা বললেও একটিবারের জন্যেও উচ্চারণ করেননি মুসলমান সমাজের ঐতিহাসিক অবদানের কথা। তিতুমিরের বাঁশের কেল্লার লড়াই থেকে শুরু করে, ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৮৫৭), দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিকস্তরে হলেও যে অসংখ্য ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন হয়েছে, যেগুলিতে কখনো মুসলমানেরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, কখনো হিন্দু-মুসলমান যৌথভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে - সেগুলির কোনো উল্লেখই প্রধানমন্ত্রী করেননি। বহু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও খিলাফত অসহযোগ আন্দোলন গ্রামীণ ভারতে ব্রিটিশের আর্থ-সামাজিক শোষণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে যে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছিল, বলাবাহুল্য প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে এগুলির একটিরও নাম বলেন নি। আজাদ হিন্দ ফৌজের ঐতিহাসিক সংগ্রামে হিন্দু-মুসলমানের যৌথ লড়াই ঘিরেও মোদী নিশ্চুপই থেকেছেন। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোটের মুখে দেশপ্রেমের নামে উগ্রতাকে একটা বল্গাহীন জায়গাতে পৌঁছে দিতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পুনর্নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ইচ্ছা প্রকাশ হলো আরএসএস’র রাজনৈতিক অভিপ্সার একটি নগ্ন প্রকাশ। অতীতে বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে এই চেষ্টাই আরএসএস করেছিল আইসিএইচআর’র যাবতীয় পাঠক্রম বদলে দিয়ে। ‘টুওয়ার্ড ফ্রিডম’ নামক সরকারি গ্রন্থে জাতীয় আন্দোলনে হিন্দুত্ববাদীদের ইতিবাচকভাবে দেখিয়ে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন বাজপেয়ী মন্ত্রীসভার সদস্যা ছিলেন। একটি প্রতিবাদও সেইদিন মমতা করেননি। আজও ঠিক তেমনভাবেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বিকৃত করে, প্রচারের আলো থেকে দূরে থাকা স্বাধীনতার যোদ্ধাদের অবদানের স্বীকৃতির নাম করে, আরএসএস তাদের সেই সময়ের রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভাসহ আরও বহু সংগঠনের ভূমিকাকে ইতিবাচকভাবে দেখাবার প্রচেষ্টা শুরু করেছে। বলাবাহুল্য, এইঅপচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রগলভ মমতা এখনো পর্যন্ত কিন্তু একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।
ফ্যাসিস্টদের চিরকালের প্রবণতা বিকৃত ইতিহাসের ভিতর দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনাগুলোকে মানুষের ভিতরে গেঁথে দেওয়া। ইতিহাস বিকৃতির সেই পথেই ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির এখন নিজেদের পরিচালিত করছে।দেশের সংবিধানের মৌলিক চরিত্র বদলে দিতে আরএসএস’র যে সার্বিক ষড়যন্ত্র, মোদীর ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাস নতুন করে লেখার ডাক দেওয়া সেই জঘন্য ষড়যন্ত্রেরই একটি ক্ষিপ্ত কৌশল। যে স্বাধীনতায় মোদীর দল বা চিন্তাভাবনার শরিকদের ভূমিকা ব্রিটিশ শাসকদের চর হিসেবে কাজ করা, সেই স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস রচনায়, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পঁচাত্তর বছর পরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীদের দ্বারা পরিচালিত দেশের সরকার প্রধান উৎসাহী যে হলেন, সেই উৎসাহের পিছনে কী গোপন উদ্দেশ্য, অভিপ্সা কাজ করছে, তা প্রতিটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী দেশপ্রেমিক নাগরিকের গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার।
ভারতের বহুত্ববাদী চিন্তাচেতনার উত্তরাধিকারকে সমূলে উপড়ে ফেলতে আরএসএস, তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি কেন্দ্রে এককভাবে ক্ষমতায় আসার পর থেকে নিরন্তরভাবে চেষ্টা করে চলেছে। ইতিহাস পুনর্নির্মাণ আরএসএস’র বহুত্ববাদী ভারতকে ধ্বংস করবার কুটিল প্রক্রিয়ার একটি অঙ্গ। হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির ভারতের যে নয়া ইতিহাস লিখতে চায়, সেই ইতিহাসে ঠাঁই হবে না আরএসএস’র বিচারের মানদণ্ডে যাঁরা ‘হিন্দু’ বলে বিবেচিত হবেন না, তাঁদের কারোরই। যেসব মানুষ জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও পরধর্মে বিদ্বেষী নন, মুসলমানকে ঘৃণার পরিবর্তে আত্মজ বলে মনে করেন, আরএসএস তাঁদের কখনো হিন্দু বলেই স্বীকার করে না। তাই বৈচিত্র্যময় ভারতকে ভালোবেসে জাতি, ধর্ম, ভাষা, লিঙ্গ নির্বিশেষে যেসব মানুষ জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, তাঁদের ঐতিহাসিক অবদানকে ভুলিয়ে দিয়ে, চেপে দিয়ে, ব্রিটিশ তোষামোদকারী হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীদেরই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নায়ক হিসেবে তুলে ধরে, নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে প্রধানমন্ত্রী মোদীর জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাস পুনর্নির্মাণের এই প্রয়াস।