৫৮ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৯ মার্চ, ২০২১ / ৫ চৈত্র, ১৪২৭
পদ্মের পাপড়ি খসে পড়ছে
অমিতাভ রায়
চলমান কৃষক আন্দোলনকে এড়িয়ে যেতে পারেন। লক্ষ লক্ষ কৃষকের শান্তিপূর্ণ অবস্থানকে উপেক্ষা করতে পারেন। অবস্থানরত কৃষকদের মৃত্যুকে অবজ্ঞা করতে পারেন। দাবিদাওয়া মেনে না নেওয়ায় যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধান না-ই করতে পারেন। অজ্ঞাত কারণে প্রচারমাধ্যমে কৃষক আন্দোলন সংক্রান্ত সংবাদ সম্প্রচার বন্ধ হতে পারে। কিন্তু বাস্তবকে অস্বীকার করা যাবে না। কৃষক আন্দোলনের ঢেউ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আঘাত হানছে।
উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গেরুয়া শিবিরের নেতা-কর্মী-মন্ত্রী এবং ভক্তবৃন্দের ‘লোটা-নমক বন্ধ’ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সামাজিক বর্জন বলতে উত্তর ভারতে লোটা-নমক বন্ধ বলা হয়, যার বাংলা প্রতিশব্দ,- ধোপানাপিত বন্ধ। গ্রাম শহরের বিভিন্ন মহাপঞ্চায়েতে সমবেত হাজার হাজার মানুষের সামনে নাম ধরে ধরে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘জয় শ্রীরাম’ হুঙ্কার দেওয়া কোন্ কোন্ মান্যবরকে সামাজিকভাবে বর্জন করা হবে । মুখে ঔদ্ধত্যের মুখোশ আঁটা থাকলেও মুখোশের আড়ালে গেরুয়া শিবির সন্ত্রস্ত। আতঙ্কগ্রস্ত। জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে দিনভর ভুবন মাতালেও দিনের শেষে তো বাড়ি ফিরতে হবে। পরিবার পরিজন নিয়ে বাড়িতে যদি বসবাস না-ই করা যায় তা হলে গোমাতার সঙ্গে গোয়ালে আশ্রয় নিতে হয়। কাজেই পদ্মফুলের পল্লবিত হওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। ভিত নড়ে গেলে ইমারতের ভাঙন কী এড়ানো যায়?
অবস্থা এতই খারাপ যে, দলের নয় শুধু নিজের মান মর্যাদা বাঁচাতে মেঘালয়ের রাজ্যপাল উত্তরপ্রদেশে ছুটে এলেন। নিজের এলাকা বাগপতে অনুষ্ঠিত কৃষক মহাপঞ্চায়েতে তিনি জানিয়েছেন যে, নতুন তিনটি কৃষি আইন কৃষক স্বার্থের পরিপন্থী। সাংবিধানিক পদে আসীন হয়েও নিজের দেশ-গাঁও-এ এসে কৃষক আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি যে ভাষায় নতুন তিন কৃষি আইনের সমালোচনা করেছেন তার ফলে বৃদ্ধ বয়সে রাজ্যপালের সুখের চাকরি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মেঘালয়ের বর্তমান রাজ্যপাল সৎপাল মালিক কিন্তু কোনো আনকোরা রাজনীতিক নন। রীতিমতো পোড়খাওয়া এই রাজনীতিকের উপর শাসকদলের অগাধ আস্থা। অবিভক্ত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের তিনি শেষ রাজ্যপাল। তাঁকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে দু’টুকরো করে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি করা হয়। ক্ষুব্ধ সৎপাল মালিককে তড়িঘড়ি গোয়ার রাজ্যপাল বানিয়ে দেওয়া হয়। জম্মু ও কাশ্মীরের আগে তিনি বিহারের রাজ্যপাল ছিলেন। একইসঙ্গে পালন করেন ওডিশার রাজ্যপালের দায়িত্ব। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময়ে লোকসভা এবং রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। এহেন মানুষ যখন ব্যক্তিগত মানসম্মান রক্ষার তাগিদে নিজভূমে এসে কৃষকের সমর্থনে ভাষণ দেন তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, নতুন তিন কৃষি আইন প্রবর্তনের পর শাসকদল পুরোপুরি সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
হরিয়ানা এবং পাঞ্জাবে গেরুয়া শিবিরের অবস্থা আশঙ্কাজনক। নেতা মন্ত্রীদের বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছেন স্থানীয়স্তরের আন্দোলনরত কৃষকরা। আন্দোলনের দাপটে এবং কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে হরিয়ানার এক বিধায়ক পদত্যাগ করেছেন। পাঞ্জাব বিধানসভার তিন গেরুয়া বিধায়ক দলবদল করে পাঞ্জাব বিধানসভাকে পদ্মমুক্ত করেছেন।
পাঞ্জাবের সাম্প্রতিক পুরসভা ও স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচনে পদ্মের পাপড়ি খোলেনি। গেরুয়া শিবিরের প্রার্থীদের জনগণ পুরোপুরি বর্জন করেছে। অন্ধ্রপ্রদেশেও একই অবস্থা। এই রাজ্যের সাম্প্রতিক পুরসভা ও স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচনে গেরুয়া শিবির সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত। আর দিল্লি বিধানসভার পাঁচটি আসনের সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে পদ্ম পাপড়ি মেলতেই পারেনি।
আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের ইশ্তিহারে তামিলনাডুর শাসকদল ঘোষণা করেছে যে, ক্ষমতায় ফিরে এলে তামিলনাড়ুতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অর্থাৎ সিএএ প্রয়োগ করা হবে না। গেরুয়া শিবিরের জন্য এ এক নতুন যন্ত্রণা। কারণ তামিলনাডুতে শাসকদলর সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে পদ্ম।
যন্ত্রণার শেষ এখানেই নয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দেড় ঘণ্টা ধরে ভারতের কৃষক আন্দোলন নিয়ে আলোচনা হওয়ায় গেরুয়া শিবির যারপরনাই ক্ষুব্ধ। কৃষক আন্দোলন দমিয়ে রাখতে ভারত সরকার যে সব পদক্ষেপ করেছে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। ভারতীয় সংসদে কিন্তু কৃষক আন্দোলন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। ভারতের সংসদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আচরণকে নিন্দা জানিয়েছে। সংখ্যাধিক্যের দাপটে এমন নিন্দা প্রস্তাব আনা মোটেও কঠিন নয়। কিন্তু তাতে কী পদ্মের পাপড়ি বিকশিত হয়?
সংসদের অধিবেশনে মন্ত্রীরা জানিয়েছেন যে, বিদেশে কাজ হারানো ভারতীয়দের নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন। দেশের কাজহারাদের জন্য সরকার কী করবে? গেরুয়া শিবির নির্বাক।
সামাজিক বর্জনের দাপটে গেরুয়া শিবির মাটি খুঁজে পাচ্ছে না। কৃষক আন্দোলন, ব্যাঙ্ক-বিমা ক্ষেত্রের ধর্মঘট, স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচন ইত্যাদিতে নাকানিচোবানি খাওয়ার পর পদ্মের পাপড়ি আর বিকশিত হচ্ছে না। এখন চাই আরেকটু ধাক্কা। ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তি সঙ্ঘবদ্ধভাবে সজোরে ধাক্কা দিতে পারলে শুধু পদ্মের পাপড়ি খসে পড়বে না, ডাটা সমেত উৎপাটিত হবে।