৫৮ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৯ মার্চ, ২০২১ / ৫ চৈত্র, ১৪২৭
প্রসঙ্গঃ চিটফান্ড
যে সত্য চাপা দেওয়া যাবে না
সুপ্রতীপ রায়
সারদা সহ বিভিন্ন চিট ফন্ডে প্রতারিত মানুষদের অর্থ ফেরতের কী হলো? চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত তৃণমূল ও নব্য বিজেপি নেতাদের কী হবে? বিধানসভা নির্বাচনের মুখে এ প্রশ্নগুলির জবাব তৃণমূল এবং বিজেপি’কে দিতে হবেই। বিপুল পরিমাণ টাকার কেলেঙ্কারি হয়েছে সারদাতে। কেবলমাত্র মূলধনের অঙ্ক ধরলে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে সারদা কেলেঙ্কারিতে। ২০ অক্টোবর ১৩’র সংবাদসংস্থা পিটিআই, প্রদত্ত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সারদা গোষ্ঠীর চারটি কোম্পানি নানা পলিসির মাধ্যমে আমানত হিসাবে মোট ২৪৫৯ কোটি ৫৯ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে।
সুদীপ্ত সেন সারদার যে চারটি কোম্পানিকে ব্যবহার করে জালিয়াতির কারবার চালিয়েছিলেন সেগুলি হলো - সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস প্রাইভেট লিমিটেড, সারদা গার্ডেন রিসর্ট অ্যান্ড হোটেলস প্রাইভেট লিমিটেড, সারদা রিয়েলটি ইন্ডিয়া লিমিটেড, সারদা হাউজিং প্রাইভেট লিমিটেড। এও আমরা জানি, সারা দেশে বেশ কিছু সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলও চালাত সারদা গোষ্ঠী। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলের হয়ে এই সংবাদপত্র ও চ্যানেলগুলি প্রচার চালাত।
২০১৩ সালেই সারদাকর্তা সুদীপ্ত সেনের বিরুদ্ধে হাওলা প্রতিরোধ আইনে মামলা দায়ের করে ইডি। ইডি তদন্তে নেমে জানতে পেরেছিল, আফ্রিকার লাইবেরিয়ার খনিতে সুদীপ্ত সেন প্রচুর টাকা লগ্নি করেছে। হাওলা মারফত সেন নিয়মিত টাকা বিনিয়োগ করতেন সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে। এমনকি দুবাইয়ে আবাসন ক্ষেত্রেও মোটা টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছিল সুদীপ্ত সেনের নামে। কিন্তু বিনিয়োগের পুরো টাকাটা কী সুদীপ্ত সেনের? পশ্চিমবঙ্গের কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হয়ে কী সুদীপ্ত সেন ওই অর্থ বাইরে লগ্নি করেছিলেন? এর উত্তর মানুষ এখনও পাননি।
বাংলার মানুষের মনে আছে, দলের নেতাদের বাঁচাতে সরকারি কোষাগার থেকে কিছু প্রতারিতকে টাকা দেওয়া শুরু করেছিলেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী। সারদার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত না করে সরকারি কোষাগার থেকে প্রতারিত আমানতকারীদের টাকা বিতড়নের কাজ শুরু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ৩০ সেপ্টেম্বর ’১৩, ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে সরকারি অনুষ্ঠানে একাজ করা হয়েছিল।
৭ অক্টোবর ’১৩, তৎকালীন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র ও রাজ্যসভায় তৎকালীন সিপিআই(এম) সাংসদ সীতারাম ইয়েচুরি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে দাবি জানিয়েছিলেন - সারদা গোষ্ঠীর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে, সেই সম্পত্তি থেকেই প্রতারিতদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ওই চিঠিতে লেখা হয়েছিল, ‘‘এবছরের ৯ মে সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক বেনিয়ম সম্পর্কে আমরা কেন্দ্রকে জানিয়েছিলাম। ১৫ জুলাই আবার চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম কেন্দ্রীয় সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। পরিস্থিতি এখন এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে, সারদার অন্তত ১৭ লক্ষ আমানতকারী অর্থ ফেরত পাননি। সারদা সমস্ত অফিস বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ সেবি ও রাজ্য সরকার এখনও সারদার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের আইনগতভাবে যথাযথ পদ্ধতির বদলে কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছাড়া এবং কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে রাজ্য সরকার কোষাগার থেকে ৫০ কোটি টাকা দিয়েছে।’’
৩০ সেপ্টেম্বর ’১৩, ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেনঃ ‘‘টাকা দেওয়াটা সরকারের কাজ নয়, মানবিক বলেই আমরা দিচ্ছি।’’ আসলে সারদায় কলঙ্কিত নেতাদের বাঁচাতেই জনগণের করের টাকা বিলি করা হয়েছিল।
তৃণমূলের রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ কুণাল ঘোষ সারদা মিডিয়া গ্রুপের সিইও ছিলেন। তিনি বেতন তুলতেন ১৬ লক্ষ টাকা। সারদার এজেন্টদের সভায় মদন মিত্র বলেছিলেনঃ ‘‘সারদার কোনো বিপদ হলে বুক দিয়ে রক্ষা করা হবে’’। তিনি আরও বলেছিলেনঃ ‘‘বিন্দু থেকে সিন্ধু গড়ার কারিগর সুদীপ্ত সেন’’। শ্রীমান শঙ্কুদেব পণ্ডা এক সময়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা ছিলেন - বর্তমানে বিজেপি’তে। তিনি সারদার একটি চ্যানেল থেকে মাসে বেতন পেতেন ৫০ হাজার টাকা। শ্রীযুক্ত শুভাপ্রসন্নের ‘দেবকৃপা ব্যাপার প্রাইভেট লিমিটেড’ সংস্থার অন্যতম ডিরেক্টর ছিলেন সুদীপ্ত ও দেবযানী।
সারদা কেলেঙ্কারি থেকে মুখরক্ষার জন্য রাজ্য সরকার একটি প্রকল্প ঘোষণা করেছিল - ‘সেফ সেভিং স্কিম’। এই প্রকল্পের হাল কী? এই সঞ্চয় প্রকল্প চালু হওয়ার পর দেখা গেল, রাজ্যের খুব সামান্য অংশের মানুষই এই প্রকল্পের সুবিধা পেলেন। সারদা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পর রাজ্যে স্বল্প সঞ্চয়ে আঘাত আসে। ২০১০-১১’তে স্বল্প সঞ্চয়ে সংগ্রহ হয়েছিল ৩৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। ২০১১-১২-তে তা কমে দাঁড়িয়েছিল ২৩ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। একইরকমভাবে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে আঘাত আসে। ২০১০-১১’র তুলনায় ২০১১-১২’তে রাজ্যে ক্ষুদ্র সঞ্চয় কমেছে ১১ হাজার কোটির টাকার বেশি।
কুণাল ঘোষ এবারের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের অন্যতম প্রচারক। তৃণমূলের গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক দায়িত্বেও আছেন। এসব মুখ ছাড়া আর ভাল মুখ তো তৃণমূলের নেই। কিন্তু তিনি তো বিভিন্ন সময় তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। ১৯ অক্টোবর ’১৩, বিধাননগর কমিশনারেটে টানা তিন ঘণ্টা জেরা শেষে বাইরে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের বলেছিলেনঃ ‘‘আমি একাই যেন সুদীপ্ত সেন’কে চিনি?’’
২৩ নভেম্বর ’১৩, কুণাল ঘোষ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কুনাল ঘোষ যে গ্রেপ্তার হতে পারেন সে বিষয়ে ২২ নভেম্বর ’১৩, তিনি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে জানিয়েছিলেন। ২২ নভেম্বর ১৩, সাংবাদিক বৈঠক করে কুনাল ঘোষ অভিযোগ করেছিলেন - দলনেত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে সুদীপ্ত সেনের যোগাযোগ আছে এবং মুখ্যমন্ত্রী সব জানতেন। তৎকালীন বিধাননগরের কমিশনার রাজীবকুমার মুকুল রায়ের কথায় ওঠাবসা করেন - এমন অভিযোগও কুনাল ঘোষ প্রকাশ্যেই করেছিলেন।
২২ নভেম্বর ’১৩, সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে বসে কুণাল ঘোষ বলেছিলেন - সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি গোপন বৈঠক করেছিলেন। কুণাল ঘোষ দাবি করেছিলেন, গোপন বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে সুদীপ্ত সেন বলেছিলেন, ‘‘ম্যাডাম আপনি সিএম থেকে পিএম হবেন। আমি মিডিয়া হাউসকে সেভাবেই সাজাচ্ছি।’’
কুণাল ঘোষ তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করে বলেছিলেন, সারদা কাণ্ডের তদন্তে পুলিশ মুখ্যমন্ত্রীকে জেরা করুক। তিনি ফেসবুকে লিখেছিলেন - তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে অন্যায়ভাবে। ২২ নভেম্বর ’১৩, সারদা প্রসঙ্গে মুকুল রায় বলেছিলেন - ‘‘আইন আইনের পথেই চলবে’’। সে কথার জবাব দিয়ে কুণাল ঘোষ বলেছিলেন, ‘‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয় এটা বলা সহজ... নিজেদের আড়ালে রেখে’’।
কুণাল ঘোষ ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছিলেন, ‘‘যারা সেনকে চিনতেন, সারদার ডাইরেক্ট বা ইনডাইরেক্ট সাহায্য পেয়েছেন... কিংবা অন্যভাবে জানেন, তাদের তদন্তে সাহায্য চাওয়া হোক। যাঁরা সাহায্য করতে পারেন - (১) টুটু বোস, সৃঞ্জয় বোস, সৌমিক বোস, (২) রজত মজুমদার, (৩) শুভেন্দু অধিকারী, (৪) মদন মিত্র, (৫) কৃষ্ণা চক্রবর্তী, বুয়া চক্রবর্তী (সমীর), (৬) কেডি সিং, (৭) আসিফ খান, (৮) মুকুল রায়, (৯) মমতা ব্যানার্জি।’’
সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে মমতা ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠতার কথা কুণাল ঘোষ একসময়ে প্রকাশ্যে বলেছিলেন। ২২ নভেম্বর ২০১৩, সাংবাদিকদের কাছে কুণাল বলেছিলেন, ‘‘সারদার মিডিয়া আছে কে জানতো না? কাদের মুখপাত্র হয়ে কাজ করতে হয়েছে সেই মিডিয়াকে?... মিডিয়ায় যদি ২০০ কোটি টাকা ঢালা হয় তবে ২ হাজার কোটি টাকার এফেক্ট কারা পেয়েছেন তাও তো তদন্ত করা উচিত... যারা সমস্তরকম সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন সারদা থেকে সারা বাংলা জুড়ে তাঁরা আজকে ঈশ্বরজ্ঞানে পূজিত হচ্ছেন’’।
কুণাল ঘোষ আরও বলেছিলেন, ‘‘আমি কোনদিন আগাম জামিনের আবেদন করিনি। মমতাদি পুলিশ পাঠিয়ে আমাকে ধরুক। মুকুল রায়ের কথায় এখন বিধাননগর কমিশনার রাজীব কুমার ওঠাবসা করেন। আমাকে অ্যারেস্ট করুক’’। কুণাল ঘোষ কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘‘হয়তো ৫০০-র বেশি মামলা রয়েছে। প্রতিটি মামলায় ১০ দিন করে পুলিশি হেফাজত হলে অন্তত পাঁচ হাজার দিন পুলিশ হেফাজতে থাকতে হবে।’’
সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে কুণাল ঘোষের রেকর্ড করা জবানবন্দিতে মমতা ব্যানার্জি, মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী প্রমুখ সম্পর্কে মারাত্মক অভিযোগ করেছিলেন। তিনি অভিযোগ করে বলেছিলেন - সারদা কর্তার অন্তর্ধান রহস্যের সবটা জানতেন মুকুল রায়। সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে নিজাম প্যালেসের বৈঠকে মুকুল রায় ছিলেন। কালিম্পঙের ডেলোর বৈঠকে মমতা ব্যানার্জি, রোজভ্যালির গৌতম কুণ্ডু, সুদীপ্ত সেন, কুণাল ঘোষ নিজেও ছিলেন - এতথ্য তো কুণাল ঘোষের দেওয়া। ডেলো বাংলোর দু’দিনের বৈঠকে মমতা ব্যানার্জি, মুকুল রায় দু’জনেই ছিলেন।
পশ্চিমবাংলার মানুষ তৃণমূল এবং বিজেপি’র কাছে জানতে চাইছে - (১) সারদার সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব কারা নিয়েছিল? (২) সুদীপ্ত সেনের চারটি চ্যানেল কারা চালাত? কারা টাকা দিত? (৩) তৃণমূলের কাগজ ‘জাগো বাংলা’কে টাকা কারা দিত? (৪) কলম পত্রিকার মালিক ছিলেন সুদীপ্ত সেন। জেলে যাওয়ার পর কলম পত্রিকার মালিকানা হাতবদল কিভাবে হয়েছিল? ঘোষণাপত্রে কে সই করেছিল? টাকাই বা কে দিয়েছিল? কুণাল ঘোষের অভিযোগ ছিল - সুদীপ্ত সেন 'কলম' এবং 'আজাদ হিন্দ' পত্রিকার মালিকানাস্বত্ব মুকুল রায়কেই লিখে দিয়েছিলেন।
২৯ অক্টোবর ’১৩, ইডি-র জেরায় কুণাল ঘোষ বলেছিলেন, সারদার কাহিনি জানেন মদন মিত্র। তিনি বলেছিলেন, বিষ্ণুপুর থেকে সারদার উত্থান। কিভাবে জমির ব্যবসা থেকে সারদা এত বড়ো সম্পত্তি করল, তা বলতে পারবেন মদন মিত্র। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরে জমি কেনা নিয়ে সারদার বিশাল সাম্রাজ্যের সূত্রপাত। সেই বিচারে সব জানেন মদন মিত্র।
কুণাল ঘোষ অভিযোগ করেছিলেন, সারদার বহুতল নির্মাণের জন্য শুভেন্দু অধিকারীকে ৪ কোটি টাকা তোলার রফা পর্যন্ত করতে হয়েছিল মমতা ব্যানার্জিকে। একাধিক ক্লাব ও পুজো কমিটিকে টাকা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও করতে হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীকে। ২৬ নভেম্বর ২০১৩, রাতে ২৪ ঘণ্টা চ্যানেলে সম্প্রসারিত হয় কুণালের ভিডিও রেকর্ডটি। ২৭ নভেম্বর ২০১৩, দুপুরে প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক বৈঠক করেন শুভেন্দু অধিকারী। যদিও কুণালের অভিযোগ তিনি খণ্ডন করে জোরালো বক্তব্য রাখতে পারেননি। তিনি শুধু ২৪ ঘণ্টা চ্যানেলে ওই ভিডিওটি সম্প্রচারিত করার জন্য ১০০ কোটি টাকা মানহানি মামলা করার হুমকি দিয়েছিলেন। গণশক্তি পত্রিকার বিরুদ্ধেও বিষোদগার করেছিলেন।
২১ অক্টোবর ২০১৩, কুণাল ঘোষ দিল্লিতে বলেছিলেন, ‘‘মনে হচ্ছে এই খোলা আকাশের নিচে আমিই একমাত্র জীবিত ব্যক্তি যার সঙ্গে সারদার মালিক সুদীপ্ত সেনের যোগাযোগ ছিল’’। ২০ অক্টোবর ২০১৩, কুণাল ঘোষের সঙ্গে রফা সূত্র খুঁজতে বৈঠকে বসেছিলেন মুকুল রায়। সারদা কাণ্ডে যখন তৃণমূল সাংসদ, মন্ত্রীদের নাম উঠতে থাকে তখন মমতা ব্যানার্জি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘‘কুণাল চোর? মুকুল চোর? মদন চোর? আমি চোর?...।’’
কুণাল ঘোষ তখন অনেক লম্বা চওড়া কথা বলেছেন। কিন্তু দল থেকে সাসপেন্ড হওয়ার পর অনেক ক্ষোভ তিনি প্রকাশ করেছিলেন। ২ অক্টোবর ২০১৩, তিনি সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন, ২৮ সেপ্টেম্বর দল থেকে সাসপেন্ড হওয়ার পর তার ওপর পুলিশি চাপ বাড়ছে। বিধাননগর পুলিশ তাঁকে বিনাকারণে বার বার ডেকে পাঠাচ্ছে বলেও ক্ষোভ ব্যক্ত করেছিলেন। দল থেকে বহিষ্কৃত হলেও মুকুল রায় ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যে সম্পর্ক ভাল ছিল তা তিনি বারে বারে বলেছিলেন।
কুণাল ঘোষ একসময় বলেছিলেন, সুদীপ্ত সেনকে দিয়ে জোর করে সিবিআই’র কাছে চিঠি লেখানো হয়েছে। ৩ অক্টোবর ২০১৩, কুণাল ঘোষ বিধাননগর কমিশনারেটে এসে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, ‘‘সুদীপ্ত সেনকে দিয়ে সিবিআই’র কাছে জোর করে চিঠি লেখানো হয়েছে। এর পিছনে রয়েছে গভীর চক্রান্ত। সারদা নিয়ে যারা বেশি জানেন, তাদের জেরা করলে তদন্ত আরও গতি পাবে।’’
চিট ফান্ড নিয়ে কথা বলার অপরাধে বিধানসভার অভ্যন্তরে বাম বিধায়ক দেবলীনা হেমব্রম ও গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়কে রক্তাক্ত করা হয়েছিল। ১১ ডিসেম্বর ২০১২, চিট ফান্ডকে কেন্দ্র করে একটা মুলতবি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। স্পিকার তা অগ্রাহ্য করেন। ওই দিন বিধানসভার মধ্যে দেবলীনা হেমব্রমকে চুলের মুঠি ধরে যেমন খুশি কিল, চড়, ঘুষি মারা হয়েছিল। বিধায়ক গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জিকে মাটিতে ফেলে মারা হয়েছিল। আহত, রক্তাক্ত হয়েছিলেন আরও কয়েকজন বামফ্রন্ট বিধায়ক।
সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে তৎকালীন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছিলেন, ‘‘ঠিক কোন্ যন্ত্রণায় মঙ্গলবার বিধানসভার অভ্যন্তরে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল ক্ষিপ্ত হয়ে এমন মারমুখী হয়ে উঠল? রাজ্যজুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা চিট ফান্ডের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি তোলা মুলতবি প্রস্তাব এনেছিলেন এদিন বামপন্থীরা। যন্ত্রণা ছিল সেটাই। রাজ্যের শাসকদলের স্বার্থের সঙ্গে যে রাজ্যের চিট ফান্ডের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক জুড়ে রয়েছে তার প্রমাণ মিলল এই ন্যক্কারজনক আক্রমণে।’’
তৃণমূল দলটি আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত। গত দশ বছরে একাধিক দৃষ্টান্ত সামনে এসেছে। ২০১১ সালের বিধানসভার নির্বাচনের আগে সিপিআই(এম) নেতা গৌতম দেব অভিযোগ করেছিলেন - তৃণমূল কংগ্রেস নির্বাচনের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে। তৃণমূল কংগ্রেস সব প্রার্থীকে ১৫ লক্ষ করে টাকা দিয়েছে। কয়েক কোটি টাকা বিলি হয়েছে। এই টাকা বিলির পর কুপন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গৌতম দেব সে সময়ই অভিযোগ করেছিলেন, বিভিন্ন চিট ফান্ড মালিকদের কাছ থেকে তৃণমূল কংগ্রেস টাকা নিয়েছে।
তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি ভাবছে মানুষ এসব ভুলে গেছেন। নির্বাচনে বিপুল অর্থ ব্যয় করে এসব তথ্য চাপা দেওয়া যাবে না। তৃণমূল এবং বিজেপি দলের নেতৃত্ব যারা আছেন তাদের বেশিরভাগ চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে কলঙ্কিত! চিট ফান্ড কাণ্ডে প্রতারিতদের অর্থ ফেরত এবং অর্থ আত্মসাৎকারীদের শাস্তি দিতে সংযুক্ত মোর্চার সরকার প্রয়োজন।