৬০ বর্ষ ৪০ সংখ্যা / ১৯ মে, ২০২৩ / ৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজ্যজুড়ে স্বাক্ষর সংগ্রহে বিপুল সাড়া
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ তৃণমূলের জমানায় রাজ্যে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে সিপিআই(এম) যে রাজ্যজুড়ে এক কোটি স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান সংগঠিত করছে, তাতে বিপুল সাড়া মিলছে। মে মাস জুড়ে রাজ্যবাসীর কাছ থেকে স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হবে। শাসকদলের মদতে সর্বস্তরে যে ব্যাপক দুর্নীতি রেকর্ড ছুঁয়েছে, তার উপযুক্ত বিচার চেয়ে এক কোটিরও বেশি স্বাক্ষর সংবলিত স্মারকলিপি দেওয়া হবে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে। রাস্তার লড়াইয়ের পাশাপাশি আইন ও বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমেও রাজ্যের মানুষ যাতে ন্যায়বিচার পান সেই লক্ষ্যেই এই জনমত সংগঠিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তৃণমূলের সীমাহীন দুর্নীতি ও অপশাসনের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের ক্ষোভ এতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে, পার্টির ডাকে এক কোটি স্বাক্ষর সংগ্রহের সীমা অনেকটাই ছাপিয়ে যাবে। জেলায় জেলায় সংগঠিত প্রতিবাদ-আন্দোলন কর্মসূচিগুলিতে বিপুল অংশের মানুষের অংশগ্রহণে এই আভাসই মিলছে।
এই কর্মসূচির ব্যাপকতা প্রসঙ্গে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতি ও দুষ্কৃতীতন্ত্র যে সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষ আজ প্রতিবাদে মুখর। ন্যায়বিচার চেয়ে চাকরি প্রার্থীরা পথে নেমেছেন। তৃণমূল সরকারের সমস্ত অন্যায়, অপরাধ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এবং সুষ্ঠু বিচার চেয়ে রাস্তার যে লড়াই তার আওয়াজ রাজ্য সরকারের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় আদালতের নির্দেশে যে ইডি-সিবিআই’র তদন্ত চলছে তাতে একের পর এক তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীকে জেলে যেতে হচ্ছে। তাই এই বিচার ব্যবস্থাকে প্রলম্বিত করা হচ্ছে, এমনকী বিচারপতির এজলাসে ঢুকেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। মুখ্যমন্ত্রী প্রথম দিন থেকেই এই দুর্নীতিকে আড়াল করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। আজ তাঁর দলের নেতা থেকে মন্ত্রী-বিধায়ক, আমলা, বিভিন্ন পর্ষদের চেয়ারম্যানকে দুর্নীতির দায়ে হাজতবাস করতে হচ্ছে। শাসকদলের অনুগত দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদেরই বেছে বেছে বিভিন্ন দপ্তর ও পর্ষদের শীর্ষপদে বসিয়ে অর্থাগমের প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছিল। এদেরই অনেককে আজ জেলে কাটাতে হচ্ছে।
মহম্মদ সেলিম এই সূত্রে আরও বলেছেন, যারা দুর্নীতি করেছে, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাড়তি সুবিধা পেয়েছে এবং টাকার বিনিময়ে যারা চাকরি পেয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য সরকার তাদের পক্ষ নিচ্ছে। তাই বিচারের বাণী যাতে নীরবে নিভৃতে না পর্যবসিত না হতে পারে সেই লক্ষ্যেই রাজ্যজুড়ে আমাদের প্রতিবাদ আন্দোলন চলছে। তিনি বলেছেন, চাকরির প্রক্রিয়া যাতে সুষ্ঠু ও সঠিক হয়; যাঁরা প্রকৃত যোগ্য ও উপযুক্ত প্রমাণ করেছেন নিজেদের, তাঁরা যাতে বঞ্চনা থেকে মুক্তি পান তার দাবিতেই বামপন্থীরা রাজ্যজুড়ে লড়াই-আন্দোলন জারি রেখেছেন।
বর্তমান তৃণমূল জমানার সাথে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ের বিস্তর পার্থক্য। তখন সমস্ত ক্ষেত্রে সরকারের একটা সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা ছিল। বিশেষকরে চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন মাফিক স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ব্যবস্থা মেনে চলা হতো। বর্তমান জমানায় এই সমস্ত নিয়ম কানুন, ব্যবস্থাকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি শুধুমাত্র শিক্ষা ক্ষেত্রে নয়, প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে এই সমস্ত দুর্নীতিকে মদত দেওয়া হয়েছে। তাই সারদা, নারদ থেকে নিয়োগ কেলেঙ্কারি, গোরু পাচার, কয়লা ও বালি কেলেঙ্কারি, একশো দিনের কাজের মজুরি সহ পঞ্চায়েতের বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা লুট, আবাস যোজনায় কাটমানি, বিভিন্ন জায়গায় তোলাবাজি,হামলা ইত্যাদি রমরমিয়ে চলেছে রাজ্যে। দুর্নীতি সহ এই সমস্ত অপকীর্তিকে শাসকদল যেন একটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিয়েছে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষ রাজপথে নেমে প্রতিদিন সোচ্চার হচ্ছেন। এমনকী শাসকদলের হুমকি হামলায় এতদিন যাঁরা ভয়-ভীতিতে সন্ত্রস্ত ছিলেন, যাঁদের নানা অজুহাতে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে অপদস্ত করা হয়েছে, তাঁরাও আজ সবকিছুকে উপেক্ষা করে প্রতিবাদে পথে নামছেন।
রাজ্যের বর্তমান এই প্রেক্ষিতকে তুলে ধরে মহম্মদ সেলিম বলেছেন, এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্যের শাসকদলের যোগসাজশে তদন্তের প্রক্রিয়া যাতে প্রলম্বিত না হয়, সব দুর্নীতিবাজ ও দোষীরা যাতে শাস্তি পায় এবং রাজ্য থেকে দুর্নীতিতন্ত্রকে সমূলে উৎপাটিত করতে রাস্তার লড়াইকে আরও বেগবান করতে হবে। সেই সঙ্গে আইনি লড়াই যাতে কোনোভাবে বেলাইনে যেতে না পারে সেজন্যও আমাদের উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে হবে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আমাদের কর্মীরা রাজ্যের সমস্ত অংশের মানুষের কাছ থেকে স্বাক্ষর সংগ্রহ করছেন, যা পাঠানো হবে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে। সেজন্য বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজির পাশাপাশি নেপালি, সাঁওতালি প্রভৃতি বিভিন্ন জন অংশের মানুষের ভাষায় আবেদনপত্র নিয়ে স্বাক্ষর সংগ্রহ ও প্রচার অভিযান চালাচ্ছেন পার্টিকর্মীরা। শুধু বামপন্থীদের কাছেই নয়, যাঁরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে, রাজ্যে আইনের শাসন, সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ যাঁরা প্রত্যাশা করেন, সেই সব অংশের মানুষের কাছ থেকেই স্বাক্ষর সংগ্রহ চলছে। প্রাথমিকভাবে এক কোটি স্বাক্ষর সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এই কর্মসূচি শুরু হলেও জেলায় জেলায় বিভিন্ন অংশের মানুষের কাছ থেকে যেভাবে সাড়া মিলছে, তাঁদের যে উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ করা যাচ্ছে তাতে নিশ্চিতভাবেই সংগৃহীত স্বাক্ষরের পরিমাণ এক কোটিকে অনেকটাই ছাপিয়ে যাবে।
তৃণমূল কংগ্রের অপশাসন, দুর্নীতি ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে এবং বিজেপি’র বিভাজনের রাজনীতির প্রতিবাদে রাজ্যের মানুষ যে ক্রমশ জোটবদ্ধ ও সোচ্চার হচ্ছেন, তার অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে সাগরদিঘি কেন্দ্রে বিধানসভা উপ নির্বাচনের ফলাফলে এবং রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রতিক অনুষ্ঠিত কয়েকটি সমবায় নির্বাচনে। এছাড়াও লক্ষণীয়, সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীদের সভা, সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মসূচিতে মানুষের অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আবার এই দৃশ্যও দেখা যাচ্ছে যে, রাজ্যের নানা জায়গায় শাসকদলের কর্মীরা দলের নানা অপকীর্তিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বাম অথবা কংগ্রেসদলের কাছে আসছেন। মানুষের এই মেজাজ বুঝতে পেরে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দল পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেবলই পিছিয়ে দিচ্ছে। এদিকে রাজ্যজুড়ে দুর্নীতিমুক্ত - মানুষের পঞ্চায়েত গড়ে তোলার আওয়াজ ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম তৃণমূল-বিজেপি’র বিরুদ্ধে বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিকামী মানুষের জোটকে ঐক্যবদ্ধ করে সাধারণ মানুষের স্বার্থে লড়াই-আন্দোলনকে আরও তীব্র করার ডাক দিয়েছেন। সব মিলিয়ে রাজ্যজুড়ে আজ লালঝান্ডার লড়াই এক নতুন আবহ রচনা করেছে।