E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪০ সংখ্যা / ১৯ মে, ২০২৩ / ৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

অনুষ্ঠিত হলো বেঙ্গল চটকল মজদুর ইউনিয়নের ৬৭তম সম্মেলন

বিশ্বজিৎ রায়


আগামীদিনে প্রতিটি চটকলে শ্রমিকদের ন্যায্য প্রাপ্য আদায় ও শ্রমিকদের উপর প্রতিটি আক্রমণকে রুখতে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ব্যর্থ করতে হবে মালিকদের চক্রান্তকে। গত ১৩-১৪ মে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ভাটপাড়ায় অনুষ্ঠিত বেঙ্গল চটকল মজদুর ইউনিয়নের (বিসিএমইউ) ৬৭তম কেন্দ্রীয় সম্মেলন থেকে এই আহ্বান জানানো হয়েছে। সম্মেলন মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে,আগামী ৯ আগস্ট ‘ভারত ছাড়ো’ দিবসে দেশব্যাপী যে শ্রমিক সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, তাতে চটকল শ্রমিকদেরও সচেতনভাবে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। এছাড়া রাজ্য সরকারের দুর্নীতি ও জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে শক্তিশালী করার ডাক দিয়েছে এই সম্মেলন।

বিসিএমইউ’র ৬৭তম কেন্দ্রীয় সম্মেলন ভাটপাড়া (মহম্মদ আমিন নগর)-র মুন্সি প্রেমচাঁদ শতবার্ষিকী ভবনে কমরেড নিমাই সামন্ত, কমরেড রামপ্রসাদ কুণ্ডু, কমরেড বাবলী দে, কমরেড অমিতাভ চক্রবর্তী মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের শুরুতে সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করেন সংগঠনের সভাপতি তড়িৎ বরণ তোপদার। শহিদ বেদিতে নেতৃবৃন্দ মাল্যদান করেন। শোকপ্রস্তাব উত্থাপন করেন দীপক দাশগুপ্ত।

সম্মেলনের উদ্বোধন করতে গিয়ে সিআইটিইউ’র রাজ্য সভাপতি সুভাষ মুখার্জি বলেন, চটকল শ্রমিকদের লড়াই আন্দোলনের এক দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসের ধারায় চটকলের শ্রমিকরা তাদের লড়াই আন্দোলন এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে চটকলে ভয়াবহ সংকট। শ্রমিকদের এই সংকট নিরসনে কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকার উদাসীন। চটকলে শ্রমিকদের ওপর শোষণ বাড়ছে। মালিকরা শোষণের কৌশল পরিবর্তন করে সর্বোচ্চ মুনাফা করতে চাইছে। শ্রমিকরা দীর্ঘ লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে অধিকারগুলো অর্জন করেছে, সেই অধিকারগুলি আজ আক্রান্ত। একটা সময় অধিকার আদায়ের লড়াই হয়েছে। এখন সেই অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, মোদি ও মমতা শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নিতে একই পথে চলছে। শ্রমিকের স্বার্থে এরা কাজ করে না। মালিকের স্বার্থ রক্ষায় এই দুটো সরকার কাজ করছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। মোদি ও মমতা একটিও কারখানার ফিতে কাটেনি। বেকারি বাড়ছে। এরা সংবিধান মানে না। মোদি দেশে হিন্দুত্ববাদী স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে চাইছে। বিভাজনের রাজনীতিকে হাতিয়ার করে এরা শ্রমিকের ঐক্য ভাঙতে চাইছে। তিনি বলেন, দাবি আদায়ের লড়াইয়ের পাশাপাশি শ্রমিকদের সমাজ পরিবর্তনের লড়াইও করতে হবে।এই লড়াই না করতে পারলে শ্রমিকদের ওপর শোষণ বঞ্চনার অবসান হবে না।

সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করতে গিয়ে বিসিএমইউ’র সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু বলেন, চটকলগুলোতে মালিকের শোষণ, বঞ্চনা বেড়েই চলেছে। মালিকরা বুঝে গেছে কেন্দ্রে ও রাজ্যে তাদের স্বার্থরক্ষাকারী সরকার ক্ষমতায় আছে। তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় চটকলগুলোতে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন শ্রমিকরা। মিলে বিভিন্ন রকমের মজুরি দিচ্ছে। সমকাজে সমবেতনের নিয়ম মানছে না। মিলগুলো মালিক নিজের খুশিমতো বন্ধ করে দেয়। স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমছে। ঠিকা শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। মালিক ৯০:২০ শতাংশ অনুপাতে শ্রমিকদের স্থায়ীকরণের দাবি মানছে না। ত্রিপাক্ষিক চুক্তি কার্যকর করতে চাইছে না মালিক। এই চুক্তি কার্যকর করার জন্য রাজ্য সরকার মালিককে কোনো চাপ দিচ্ছে না। লকডাউনের সময়কার বেতন দেয়নি মালিক। অবসরের পর শ্রমিকদের পিএফ, গ্র্যাচুইটির টাকা মালিক ঠিকমতো দেয় না। মালিকের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে শ্রমিককে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই আন্দোলন করতে হবে।

তিনি বলেন, কেন্দ্রে ও রাজ্যে শ্রমিক বিরোধী সরকার ক্ষমতায় আছে। শ্রমিকদের ধর্মঘট করার অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে। মোদি সরকারের আমলে দেশের বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেড়েছে। দেশের শ্রমিক শ্রেণির কোনো ‘আচ্ছে দিন’ আসেনি। আদানি, আম্বানিদের আচ্ছে দিন এসেছে। ২৯টা শ্রমআইন তুলে দিয়েছে। চারটে শ্রমকোড চালু করার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের অর্জিত অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে। আমরা দাবি করেছি শ্রমকোড বাতিল করতে হবে। আগামীদিনে ২৭ দফা দাবিতে চটকলের শ্রমিকদের লড়াই আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

বিসিএমইউ’র সভাপতি তড়িৎবরণ তোপদার বলেন, চটশিল্পে সংকটের বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার হস্তক্ষেপ করছে না। চটশিল্প সূর্যোদয়ের শিল্প। রাজ্যের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটা বিরাট জায়গা আছে। রাজ্য সরকার চটশিল্পের ক্ষেত্রে সঠিক ভূমিকা পালন করছে না। চটশিল্প ও তার শ্রমিকদের রক্ষার্থে আগামীদিনে ঐক্যবদ্ধভাবে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন সারা ভারত কৃষক সভার রাজ্য সভাপতি বিপ্লব মজুমদার, সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের নেতা সত্য কপাট, আইএনটিইউসি নেতা মাস্টার নিজাম, এআইটিইউসি নেতা দেবাশিস দত্ত, বিএমএস নেতা বিনোদ সিং, এআইইউটিইউসি নেতা অমল সেন, ইউটিইউসি নেতা সুধাংশু মণ্ডল, টিইউসিসি নেতা তাপস বিশ্বাস, এআইসিসিটিইউ নেতা শম্ভু ব্যানার্জি এবং অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি নেপালদেব ভট্টাচার্য।

সম্মেলনে শ্রমিক প্রতিনিধিরা আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, চটকলে মালিকের জুলুম বাড়ছে। তৃণমূলের মদতে মালিকরা এই জুলুম বাড়িয়ে চলেছে। কাজের বোঝা বাড়াচ্ছে। উৎপাদন একটু কম হলেই কাজ থেকে দুই থেকে তিন ঘণ্টা হাজিরা কেটে নেয়। এর প্রতিবাদ করলে মিল থেকে বেআইনিভাবে বার করে দেয়। মিলে তৃণমূল এবং বিজেপি’র ইউনিয়ন মালিকের হয়ে দালালি করছে। তৃণমূলের লোকজন মিলে ঠিকাদারি করছে। এর বিরুদ্ধে সমস্ত শ্রমিককে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

রাজ্যের ৫০টা চটকল থেকে ৩৪৮ জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। ৫০টি চটকলের ইউনিট থেকে ৪৫ জন শ্রমিক প্রতিনিধি প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় অংশ নেন।

শ্রমিক বিরোধী শ্রমকোড বাতিল, মূল্যবৃদ্ধি সহ জনবিরোধী আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে, বিলগ্নিকরণ ও বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতা-জাতপাত সমস্যা এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও সংবিধানের মর্যাদা রক্ষার স্বার্থেই পুলওয়ামা (২০১৯) হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনের দাবিতে মোট পাঁচটি প্রস্তাব সম্মেলনে গৃহীত হয়।

এছাড়াও সম্মেলন থেকে ১২ দফা আগামী কর্মসূচি নির্ধারিত হয়েছে।

সম্মেলন থেকে অনাদি সাহুকে সভাপতি, গার্গী চ্যাটার্জিকে কার্যকরী সভাপতি, মঙ্গলবেন বংশীকে সাধারণ সম্পাদক, তীর্থঙ্কর রায়কে সাংগঠনিক সম্পাদক, রঞ্জিত মণ্ডল ও জুলফিকার আলিকে যুগ্ম সম্পাদক এবং বিশ্বকর্মা যাদবকে কোষাধ্যক্ষ করে ৩১ জনের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলী ও ১৫১ জনের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়।

সম্মেলনের শেষদিন ১৪ মে জগদ্দলের গোলঘর বাজার ময়দানে প্রকাশ্য সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তিনি আহ্বান জানান, বিভাজনের রাজনীতিকে হাতিয়ার করে শ্রমিকের ঐক্য ভাঙতে চাইছে বিজেপি এবং তৃণমূল। এই দুটো দল দেশে ও রাজ্যে লুট চালাচ্ছে। এরা মিলেমিশে লুটের রাজত্ব কায়েম করেছে। মানুষের ঐক্যকে ধর্মীয় ভাবাবেগ দিয়ে ভাঙতে চাইছে। এর বিরুদ্ধে লাল ঝান্ডা হাতে সমস্ত শ্রমজীবী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

তিনি বলেন এই রাজ্যে লুটের টাকার ভাগ কোথায় কত যাবে সব ঠিক করে দিচ্ছে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি। তৃণমূলের ঝান্ডা নিয়ে কাটমানি, তোলাবাজি, লুট চলছে। মোদি ও মমতা মিলেমিশে লুটের রাজত্ব কায়েম করেছে। তৃণমূল না থাকলে বিজেপি এই রাজ্যে থাকবে না। মমতা ব্যানার্জি আরএসএস-এর কথায় চলে। আরএসএস মমতা ব্যানার্জিকে মা দুর্গা বলেছিল। বিজেপি'র এই রাজ্যে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতির পথে বাধা ছিল বামপন্থীরা। লাল ঝান্ডাকে খতম করতে আরএসএস মমতা ব্যানার্জি’র দলকে ভাড়ায় খাটানোর মতো এই রাজ্যে ব্যবহার করছে। তৃণমূলের এই রাজনীতি মানুষ বুঝে ফেলেছে। মানুষ এখন লাল ঝান্ডা হাতে নিয়ে তৃণমূল এবং বিজেপি-কে রাজ্য থেকে উৎখাত করতে লড়াই আন্দোলনে শামিল হচ্ছে।

তিনি বলেন, রাজ্যে সমস্ত নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয়েছে। এর সঠিক তদন্ত হওয়া উচিত। গোটা দেশের মানুষ সত্যটা জানতে চায়। মুখ্যমন্ত্রী এই দুর্নীতির তদন্ত ধামাচাপা দিতে চাইছেন। বারো বছর ধরে এই দুর্নীতি চলছে। তৃণমূলের নেতা,মন্ত্রীদের বাড়ি থেকে টাকার পাহাড় উদ্ধার হয়েছে। তিনি জানেন না এটা হতে পারে না। তিনি সব জানেন। তিনি সব জানেন বলেই সুপ্রিমকোর্টে গিয়ে বাঁচতে চাইছেন। আমরা সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে এই রাজ্যের এক কোটি মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে পাঠাবো।

তিনি বলেন বিজেপি যখন বিপদে পড়েছে তৃণমূল নেত্রী তখনই ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। গোয়া, মেঘালয়, ত্রিপুরা তার জ্বলন্ত উদাহরণ। সেখানে ভোট ভাগাভাগি করে বিজেপি-কে জিততে সুবিধা করে দিয়েছে তৃণমূল। বিজেপি’র বিরুদ্ধে তৃণমূল নয়, আবার তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপি নয়। এই দুটো দল ভাগাভাগির রাজনীতি করছে। তৃণমূল এবং বিজেপি-কে হটাতে লাল ঝান্ডা অর্থাৎ বামপন্থীরাই পারে। মানুষ এটা বুঝতে পারছে। লাল ঝান্ডার তলায় মানুষ সমবেত হচ্ছেন। বিভাজনের রাজনীতির অবসান ঘটাতে মানুষ জোটবদ্ধ হচ্ছেন।

এদিনের প্রকাশ্য সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন তড়িৎবরণ তোপদার। অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রেখেছেন অনাদি সাহু,গার্গী চ্যাটার্জি, নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক মঙ্গলবেন বংশী সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।