E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪০ সংখ্যা / ১৯ মে, ২০২৩ / ৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

শুরু হলো মৃণাল সেন জন্মশতবর্ষ পালন

‘মৃণালের ভুবনে মৃণাল-সন্ধান’

শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়


সিনেমায় একরৈখিক গল্প বলার চেয়েও জরুরি সিনেমার পদ্ধতিকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রকাঠামোটাকে প্রশ্ন করা। চালু ব্যবস্থার বিচ্ছিন্ন ঘটনাসমূহকে সিনেমার ভাষায় গেঁথে মানুষের কাছে নিয়ে যাও। তাঁদের আবিষ্ট করে সংযোগ স্থাপন করো। তারপর তোমার ভানহীন অনুচ্চারিত প্রশ্নের পরিসরে দর্শককে বাধ্য করো উত্তরের জন্য মাথা কুটতে। এটাই মৃণাল সেনের ঘরানা। এটাই তাঁর গণনাট্য সংঘের আদর্শবাহী উত্তরাধিকার। ১৪ মে মৃণাল সেনের শততম জন্মদিনে কলকাতার সরলা মেমোরিয়াল হলে মৃণাল সেন জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন কমিটি আয়োজিত ‘মৃণালের ভুবনে মৃণাল-সন্ধান’ অনুষ্ঠানের আলোচনা পর্বে একথা বলেন বিশিষ্টজনেরা।

অনুষ্ঠান থেকে এদিন দু’টি দাবি পেশ করেন উদ্যোক্তারা সাধারণের অনুমোদনের জন্য। তার মধ্যে রয়েছে রাধা স্টুডিয়োর নামকরণ করতে হবে মৃণাল সেনের নামে এবং রাজ্য সরকারকে মৃণাল সেনের নামে একটি সংগ্রহশালা করতে হবে। দুটি দাবিতেই প্রবল করতালি দিয়ে সম্মতি জানান দর্শকরা।

এদিনের অনুষ্ঠানের সূচনা পর্বে এক অভুতপুর্ব অভিজ্ঞতার সাক্ষী হন দর্শকরা। শুরুতেই আনুষ্ঠানিক ঘোষণার বালাই না রেখে প্রেক্ষাগৃহের আলো কমে আসার সাথে সাথেই মাইক থেকে আপাত সম্পর্কহীনভাবে ছিটকে আসতে থাকে বিশিষ্ট অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মৃণাল সেন সম্পর্কে করা নানা উক্তি। নাসিরুদ্দিন শাহ থেকে শাবানা আজমি, গোবিন্দ নিহালনি, এম কে রায়না, সুহাসিনী মুলে থেকে অঞ্জন দত্তদের টুকরো মন্তব্যগুলি নিমেষে মনোযোগ কেড়ে নেয় প্রেক্ষাগৃহের। দর্শক-শ্রোতা সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন উদ্‌যাপনের আয়োজনের এই উদ্ভাবনী অনুষঙ্গের সাথে।

উদ্বোধনী পর্বের রেশ ধরে রেখেই রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন শামা রহমান। বাংলাদেশের এই শিল্পীর দুটি নিবেদনই সমাদর পায় দর্শকদের।

এরপর বিশিষ্ট পরিচালক মনীষ ঘোষের ‘ইন কোয়েস্ট অব মৃণাল সেন’ তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। ১৭ মিনিটের টানটান এই তথ্যচিত্র মৃণাল সেনের বহুমাত্রিক সৃষ্টির ভুবনকে আরও একবার ঝালিয়ে নিতে স্মৃতিমেদুর করে তোলে আমাদের। এই তথ্যচিত্রটি মৃণাল সেন চর্চার সূচক হিসেবে মাইলস্টোন হতে পারে। তথ্যচিত্রটির ধারাবিবরণী লেখক, প্রবীণ গণনাট্য কর্মী সুদীপ সরকারও চমৎকার কাজ করেছেন।

এরপর আলোচনা পর্বে প্রবীণ চলচ্চিত্র পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল, অভিনেতা-পরিচালক অঞ্জন দত্ত, মৃণাল সহযোগী পথিক ভাট, অভিনেত্রী মমতাশঙ্কর, বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র এবং মৃণাল সেনের পুত্র কুনাল সেন বক্তব্য রাখেন।

বাংলাদেশের বিশিষ্ট পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল বলেন, মৃণাল সেন হলেন সেই প্রজন্মের প্রতিনিধি যাঁরা দেশভাগ, দাঙ্গা এবং দুর্ভিক্ষ দেখেছেন এবং তিনি শুধু দেখেনইনি পরিচালক হিসেবে তাঁর ছবিতেও এসব বিষয় এনেছেন। আমরা তাঁকে পেয়েছি সমাজ সংবেদনশীল একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে। যুগে যুগে আমাদের মৃণাল সেন প্রয়োজন। আমার মতো যারা নব প্রজন্মের নির্মাতা তারা নানাভাবে ওঁনার কাছে কৃতজ্ঞ। বাংলা ছবির গল্প বলার যে একরৈখিক বয়ান তার বিপরীতে তিনি যাত্রা শুরু করেছেন যা নতুনধারা হিসেবে ইয়োরোপে শুরু হয়েছিল। যেখানে গল্প বলাটাই মূল নয়, গল্পটা আসলে একটা বয়ান, যার মূল লক্ষ্য হলো উপনিবেশবাদের ফেলে যাওয়া কাঠামো এবং যে সমাজ তীক্ষ্ণভাবে শ্রেণিবিভক্ত তাকে প্রশ্ন করা।

তিনি বলেন, মধ্যবিত্তের দ্বিচারিতাকে তিনি নানাভাবে পরখ করেছেন। তার ছবিতে এসেছে শ্রমশোষণ থেকে অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। যেমন ‘ওকা উরি কথা’ নামের ওড়িয়া ছবিতে গ্রামীণ শ্রমিকরা বলে ওঠে, তারা আর শ্রম করবে না। কারণ শ্রম করলে সেটা মালিকের বিত্ত বাড়াবে।

তানভীর মোকাম্মেল বলেন, তিনি চলচ্চিত্রের ভাষাকে সম্পূর্ণভাবে আত্মস্থ করেছেন। ছবি পরিচালনায় তাঁর দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তাঁকে পশ্চিমে বলা হতো মার্কসিস্ট বা রাডিক্যাল। সাম্যের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তার ওঠাপড়া আছে, কিন্তু স্বপ্নটা চিরন্তন। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে তিনি উস্‌কে দিয়ে গেছেন এই স্বপ্ন দেখতে। যতদিন মানুষের সামাজিক সাম্যের স্বপ্ন থাকবে, মৃণাল সেন আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন।

অঞ্জন দত্ত বলেন, মৃণাল সেন এমন একজন চলচ্চিত্রকার যার বেঁচে থাকাটা তাঁর ছবির মধ্যে ফুটে উঠেছে। বেঁচে থাকাটা নিয়েই তাঁর ছবি। তিনি ভারতের একমাত্র চলচ্চিত্রকার যিনি কী বলছেন তার চেয়েও কিভাবে বলছেন সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের নিটোলভাবে গল্প বলার সিনেমার দেশে ওঁনাকে ইনহেরিট করা খুব মুশকিল। গল্প নয়, গল্প দেখানোর ভঙ্গিটা এমনই যে, সেটা আরেকটা গল্প বলছে, তাঁর সিনেমাতে ঢুকে পড়ছে। ‘কলকাতা ৭১’ ছবি থেকে তাঁর অধিকাংশ সিনেমার নায়কের চরিত্ররা সবাই নানান মাত্রার মৃণাল সেন।

'মহাপৃথিবী' সিনেমার নির্মাণ নিয়ে তাঁর সঙ্গে মৃণাল সেনের মতভেদ হয়েছিল। সে প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তিনি বলেন, আমার সঙ্গে তাঁর ৪৩ বছরের সম্পর্ক। তাঁর সঙ্গে আমার তর্ক হতো। এই তর্ক মানে ‘কন্ট্রোভার্সি’ নয় ‘ডিবেট’। এসব উনি প্রশ্রয় দিয়েছেন, দিতেন। প্রশ্ন করাটা, তাঁর পরিসরটা তিনি মেনে নিচ্ছেন, থামিয়ে দিচ্ছেন না - এটাই মৃণাল সেন।

অঞ্জন দত্ত বলেন, আজকের এই পরিস্থিতিতে বলতে বা প্রশ্ন করতে না পারাটা এত আধুনিক একটা ক্রাইসিস যেটা আমাদের সকলের সংকট। আমাদের সবক’টা প্রশ্নের উত্তর এখনই পেতে হবে সেটা নয়, কিন্তু প্রশ্ন করার মধ্যদিয়েই বেঁচে থাকা যায়। যতক্ষণ আপনি প্রশ্ন করছেন আপনি জীবন্ত। যখন ‘মনোলিথিক সোসাইটি’ হয়ে যাবে তখন আর কিছু থাকে না। কিন্তু উত্তর না পেয়েও প্রশ্ন করে যাওয়া - এটাই জরুরি। এটাই করে গেছেন, শিখিয়ে গেছেন মৃনাল সেন। যে প্রশ্ন তিনি তুলেছেন বা তাঁর চরিত্ররা তুলেছে বা অব্যক্ত রেখেছে, আজকের প্রেক্ষিতে যদি আমরা সেই প্রশ্নগুলো করতে শুরু করতে পারি তাহলেই এই শতবার্ষিকী উদ্‌যাপন আমার কাছে অর্থবহ হবে।

বিশিষ্ট সিনেমা পরিচালক পথিক ভাট মৃণাল সেনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, আমি মৃণালদার সঙ্গে 'জেনেসিস' সিনেমায় সংলাপ লেখক হিসেবে কাজ করেছি। ফিল্ম সম্পর্কে আমার প্রকৃত শিক্ষা শুরু মৃণালদার কাছেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে আমি দেখেছি, সিনেমা কেন্দ্রিক ইনস্টিটিউশন বা মানুষের মধ্যে মৃণালদা ও তাঁর সিনেমা সম্পর্কে কি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা এবং পরিচিতি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আমি দেখেছি ভাষার ব্যবধান সত্ত্বেও খেটে খাওয়া মানুষের কাছে তাঁর সিনেমার বার্তা কেমন অবলীলায় পৌঁছে যেত।

বিশিষ্ট অভিনেত্রী এবং নৃত্যশিল্পী মমতাশংকর বলেন, মৃণালদার সঙ্গে আমার পরিচয় 'পদাতিক' ছবির নির্মাণ পর্ব থেকে। আমার দাদা (আনন্দশংকর) ওই ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেছিলেন। ওই ছবির আবহসংগীতে অংশগ্রহণ করার সূত্রেই আমার সিনেমা থেকে প্রথম রোজগার। মৃণালদার ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে আমার ছবি করা শুরু। মৃণাল সেন আমার কাছে একজন সম্পূর্ণ মানুষ।

মৃণাল সেনের পুত্র কুনাল সেন স্মৃতিচারণ করে বলেন, বাবাকে আমি বন্ধু বলে ডাকতাম। বাবার কাছে গোটা জগৎটা ছিল একটা গল্প তৈরির ফ্যাক্টরি যার ভিত্তিতে আরও ভালো থাকার দিকনির্দেশ নির্ভর ছবি তৈরির কথা তিনি ভাবতেন সবসময়।

বিশিষ্ট সংগীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র বলেন, মৃণালদার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ‘আকালের সন্ধানে’ ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর রেকর্ডিং-এর সময়। আমি ওঁনার শেষের দিকের বেশ কিছু ছবিতে সংগীত পরিচালনার কাজ করেছি। তিনি এবং তাঁর সিনেমা আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে।

আলোচনা পর্বের পর অনুষ্ঠিত হয় সঙ্গীতানুষ্ঠান। মৃণাল সেনের বিভিন্ন ছবিতে ব্যবহৃত সংগীত সহ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যকে অক্ষুণ্ণ রেখে সংগীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্রের পরিচালনায় পরিবেশিত হয় দেশ-বিদেশের গান।

বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী রজত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঞ্চালনা অনুষ্ঠানটিকে আগাগোড়া অন্যতর মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। সব মিলিয়ে শততম জন্মদিনে মৃণাল স্মরণের এই আয়োজন প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিল।