৬০ বর্ষ ৪০ সংখ্যা / ১৯ মে, ২০২৩ / ৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
আইন মান্যকারীদের ওপরেই আক্রমণ হানছে আইন রক্ষকরা!
অম্বিকেশ মহাপাত্র
‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড পুলিশ’-র সঙ্গে তুলনীয় ‘কলকাতা পুলিশ’ গত ৭ বছর আমায় খুঁজে পাচ্ছেন না! সেইরকম তথ্য (ফেরার/পলাতক চার্জশিট) সহি, সিলমোহর এবং তারিখ সহ জমা পড়েছে আলিপুর ফৌজদারি আদালতে। সেকারণে মহামান্য আদালত আমায় গ্রেফতার করে, আদালতে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রজাতান্ত্রিক ভারতের নাগরিক হিসেবে ভারতীয় পাসপোর্ট পুনর্নবীকরণ প্রক্রিয়ায়, ‘কলকাতা পুলিশ’-র জমা দেওয়া রিপোর্ট থেকে জানতে পেরেছি, এইসব তথ্য। ফলশ্রুতিতে আপাতত পাসপোর্ট পুনর্নবীকরণ স্থগিত! মর্মার্থে - ‘অপরাধী জানিল না কী তাহার অপরাধ’; অথচ সাজা হয়ে গেল! হেঁয়ালি মনে হচ্ছে? সেকারণেই স্বল্প পরিসরে তথ্যের উত্থাপন জরুরি।
প্রাক্কথন
পূর্ব যাদবপুর থানাঃ ফৌজদারি মামলা ১
নজিরবিহীন ঘটনা। ভারতের সংসদে রেল বাজেট পেশ করলেন এক রেলমন্ত্রী; বাজেট পাশের সময় অন্য রেলমন্ত্রী! বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার, বাঙালির গর্ব সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ ছায়াছবির কয়েকটি কথোপকথন ব্যবহার করে, সমকালীন ঘটনার উপর তৈরি হলো হাস্যরসাত্মক বুদ্ধিদীপ্ত নিরীহ অথচ গভীর অর্থবহ কোলাজ কার্টুন। কার্টুনটি বন্ধুদের ই-মেলে শেয়ার করার কারণেই শাসকদলের রোষানলে! ১২ এপ্রিল, ২০১২, শাসকদল-শাসকদল আশ্রিত দুষ্কৃতী এবং পুলিশ প্রশাসনের যৌথ বোঝাপড়া এবং পরিকল্পনায় শারীরিক নিগ্রহ, প্রাণনাশের হুমকি, মুচলেকা, গ্রেফতার, লকআপ, ফৌজদারি মামলা দায়ের! আঞ্চলিক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে নানাভাবে প্রতিবাদ ধ্বনিত হলো। তা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক দেশের আইন ও সংবিধান মেনে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যের সরকার বা কেন্দ্রের সরকার কেউই মামলা প্রত্যাহারে কোনও উদ্যোগগ্রহণ করেনি। উপরন্তু আইনের রক্ষক পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে এবং বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে, সুপ্রিমকোর্টে বাতিল হয়ে যাওয়া ধারায় নিম্ন আদালতে মামলা চললো ৩,৯৩৩ দিন! ১৮ জানুয়ারি, ২০২৩ শেষমেষ জেলা আদালতের রায়ে মামলা থেকে বেকসুর নিষ্কৃতি মিললো।
হেয়ার স্ট্রিট থানাঃ ফৌজদারি মামলা ২
৩ ডিসেম্বর ২০১৪, হেয়ার স্ট্রিট থানার সাব-ইন্সপেক্টর সত্যজিৎ কর্মকার মিথ্যা (পুলিশকে ধাক্কা ও ঘুসি মেরেছি, কাজে বাধা দিয়েছি... ইত্যাদি) ভিত্তি করে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন হেয়ার স্ট্রিট থানায়! থানার অফিসার ইন-চার্জ শান্তনু সিং বিশ্বাস অভিযোগপত্রকে এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করে ব্যাঙ্কশাল আদালতে ৭টি ধারায় ফৌজদারি মামলা দায়ের করেন। আদালতের নির্দেশে তদন্ত সাপেক্ষে থানার তদন্তকারী অফিসার সাব-ইন্সপেক্টর বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য দেড় মাসের মধ্যে কোর্টে চার্জশিট জমা করেন। চার্জশিটে ‘ফেরার/পলাতক’ দেখানো হয়। ওই সময়কালে ‘আক্রান্ত আমরা’ মঞ্চের তরফে দিল্লিতে মাননীয় রাষ্ট্রপতি মহোদয়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন, জাতীয় মহিলা কমিশনে স্মারকলিপি জমা দেওয়া; যন্তর মন্তরে অবস্থান বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করা; ইউজিসি-র আমন্ত্রণে দিল্লিতে ইউজিসি দপ্তরে শিক্ষা সংক্রান্ত কাজে অংশগ্রহণ সহ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত কাজে ছিলাম। অথচ ‘ফেরার/পলাতক’ চার্জশিটের ভিত্তিতে মহামান্য আদালত গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করার জন্য, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। তখনই জানতে পারি আমার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা সহ গ্রেফতারি পরোয়ানার বিষয়! তার আগে ঘুণাক্ষরেও নয়! ফলত আদালতে আত্নসমর্পণ করে জামিন নিতে বাধ্য হতে হয়। ১,২৬৩ দিন পর, ১৮ মে, ২০১৮ সেই ফৌজদারি মামলা থেকে বেকসুর নিষ্কৃতি মিলেছিল।
প্রসঙ্গত হরিদেবপুর থানাঃ ফৌজদারি মামলা ৩
২য় ফৌজদারি মামলা থেকে নিষ্কৃতি মিলেছিল ২০১৮ সালে। ১ম ফৌজদারি মামলা অর্থাৎ কার্টুনকাণ্ডের মামলা থেকে নিষ্কৃতি কিছুতেই নয়। তেমনই পরিকল্পনা ও ইচ্ছে রাজ্য সরকারের। তবুও শেষমেষ বেকসুর নিষ্কৃতি মিললো ৩,৯৩৩ দিন পর সম্প্রতি ১৮ জানুয়ারি, ২০২৩। সারা রাজ্যের সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমি, আমার পরিবার এবং আমার আত্মীয়স্বজন স্বস্তিবোধ করেছিলাম। শেষমেষ সত্যের জয় হলো। গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রের জয় হলো। মনে মনে বললামঃ ‘শাসনে যতই ঘেরো আছে বল দুর্বলেরও’। যাক এবার ভারতীয় পাসপোর্টের স্বাভাবিক পুনর্নবীকরণে আর কোনও বাধা রইল না। কিন্তু পুনর্নবীকরণ প্রক্রিয়ায়, পাসপোর্ট অফিস থেকে জানতে পারলাম, পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট বিরূপ! ফলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পাসপোর্ট পুনর্নবীকরণ সম্ভব নয়! কী কারণে বিরূপ? কলকাতা পুলিশ জানিয়েছে, ৩০ এপ্রিল, ২০১৬ থেকে হরিদেবপুর থানার দায়ের করা ফৌজদারি মামলা আলিপুর ফৌজদারি আদালতে সক্রিয়! ৭ বছর আগের মামলা! অথচ অভিযুক্ত জানিল না! অবাক কাণ্ড! অগত্যা পাসপোর্ট অফিস থেকে মামলার প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করে আইনজীবীর কাছে। আইনজীবী মাধ্যমে আলিপুর ফৌজদারি আদালতে দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর, মামলার সার্টিফায়েড কপি সংগ্রহ করে জানলাম ব্যক্তিজীবনে তৃতীয় বিস্ময়কর ষড়যন্ত্রের ইতিবৃত্ত! বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মহাবিস্ময়! ৩০ এপ্রিল, ২০১৬, ৫টি ফৌজদারি অপরাধ করার পর, পুলিশের গ্রেফতারি এড়াতে আমি নাকি ‘ফেরার/পলাতক’! সে কারণেই ৮ জানুয়ারি, ২০১৯ থেকে আমার বিরুদ্ধে জারি, আদালতের ‘গ্রেফতারি পরোয়ানা’! পাঠক ভাবছেন, আবারও হেঁয়ালি করে কথা বলছি। না, আদালতের দস্তাবেজ ও সরকারি নথি বলছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ‘মেরা ভারত মহান’-এর ‘অমৃতকাল’ সময়ে এই নথি হস্তগত। এই অবস্থায় আদালত তথা বিচারব্যবস্থার নথি-তথ্য কিছুটা খোলসা করে পাঠককে জানানো দরকার।
৩০ এপ্রিল, ২০১৬। ওইদিন বেহালা পূর্ব বিধানসভার নির্বাচন ছিল। সমস্ত বিধানসভা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি। আমি বামফ্রন্ট, প্রদেশ কংগ্রেস এবং অন্যান্য বামদল সমর্থিত নির্দল প্রার্থী ছিলাম। সকাল থেকে নির্বাচনী এলাকার বুথে ঘুরে ঘুরে নির্বাচন প্রক্রিয়া দেখেছি; এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচন প্রক্রিয়া মিটে যাওয়ার পর সন্ধেবেলা আমার এবং আমার গাড়ির উপর হামলা হয়েছিল; যা সংবাদমাধ্যমে সম্প্রচারিতও হয়েছিল। ওইদিনই দুপুরের মধ্যে হরিদেবপুর থানার জনৈক অধিবাসী, তৃণমূল কর্মী সুব্রত ব্যানার্জি (পিতা বিশ্বনাথ ব্যানার্জি) আমার বিরুদ্ধে হরিদেবপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগপত্রে লেখা হয়ঃ কুৎসিত কুরুচিকর গালাগাল দিয়েছি, মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছি, চড় কিল ঘুসি মেরেছি, পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা ছিনতাই করেছি এবং রাত্রিবেলায় পরিবারের সবাইকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করে খালের জলে ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছি! ওই দিনই অ্যাডিশনাল অফিসার ইনচার্জ তীর্থঙ্কর দে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে অভিযোগপত্রকে এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করে ৫টি (143, 341, 323, 379, 506 of IPC) ধারায় আলিপুর ফৌজদারি আদালতে ফৌজদারি মামলা দায়ের করেন। পরে আদালতের নির্দেশে, তদন্ত সাপেক্ষে, মামলার তদন্তকারী অফিসার সাব ইন্সপেক্টর পি তামাং ৫ মার্চ, ২০১৮ আলিপুর আদালতে চার্জশিট জমা করেন। জানানো হয়; গ্রেফতার এড়াতে অম্বিকেশ মহাপাত্র অ্যাবস্কন্ডেড অর্থাৎ ফেরার। ফেরার/পলাতক-চার্জশিটের ভিত্তিতে আলিপুর আদালতের মাননীয় অ্যাডিশনাল চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (এসিজেএম) ৮ জানুয়ারি, ২০১৯ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। সেই গ্রেফতারি পরোয়ানার মেয়াদ মহামান্য আদালত ৭ বার বৃদ্ধি করেন। ফলত বর্তমান অবস্থান? ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত ফেরার/পলাতক আসামী! ৭ বছর পর ফৌজদারি মামলার বিস্তারিত জানার পর, অগত্যা আইনজীবীর পরামর্শে আলিপুর আদালতে আত্মসমর্পণ করে, জামিন নিতে হয়েছে। স্বাভাবিককারণে পাসপোর্ট পুনর্নবীকরণ বিশবাঁও জলের তলায়। এই অভিজ্ঞতাই আমার জ্ঞানেন্দ্রিয় উন্মেষের প্রধান কারণ।
বিচ্ছিন্ন ঘটনা? মোটেই না। রাজ্যব্যাপী সাধারণ নাগরিকের সাংবিধানিক তথা নাগরিক অধিকার হরণের জন্য রাজ্য প্রশাসনের উদ্যোগে পুলিশ প্রশাসন-দুষ্কৃতী-শাসকদলের যৌথ বোঝাপড়ায় পরিকল্পনামাফিক রাষ্ট্রের দ্বারা সাধারণ নাগরিক আক্রান্ত হচ্ছেন। পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণ কাণ্ড, তপন দত্ত খুন, বরুণ বিশ্বাস খুন, সাগর ঘোষ খুন, হিমানী বর্মণ খুন, রাণু বিশ্বাস ধর্ষণ ও খুন, শিপ্রা ঘোষ ধর্ষণ ও খুন, সুদীপ্ত গুপ্ত খুন, সাইফুদ্দিন মোল্লা খুন, আশমিরা বেগম খুন, মইদুল ইসলাম মিদ্যা খুন, আনিস খান খুন, দেবু দাস-উষা রানি দাসকে পুড়িয়ে খুন, শিলাদিত্য চৌধুরী, দিলীপ দে সরকার নিগ্রহ,... ইত্যাদি অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়। এর মোকাবিলা বিচারব্যবস্থার মধ্যদিয়ে সম্ভব? মাননীয় বিচারপতি জানেন, অম্বিকেশ মহাপাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, প্রায়শই সংবাদমাধ্যমে দেখা যায়, আক্রান্তদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে থানায়, এসপি, সিপি, ডিজি প্রমুখ পুলিশ প্রশাসনের আধিকারিকদের কাছে স্মারকলিপি দেন। তবুও অম্বিকেশ মহাপাত্রের ফেরার/পলাতক চার্জশিটের উপর নির্ভর করে, বিশ্বাস করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন! এবং সেই গ্রেফতারি পরোয়ানার মেয়াদ ৪ বছরে ৭ বার বৃদ্ধি করা হয়েছে! অর্থাৎ এখানে বোঝা যাচ্ছে শাসকদল,শাসকদল আশ্রিত দুষ্কৃতী এবং পুলিশ প্রশাসনের সুন্দর বোঝাপড়া তো রয়েছে। তারসঙ্গে বিচারব্যবস্থার একাংশও যুক্ত নাগরিক অধিকার হরণে। এমতাবস্থায় উপায়? আগাপাশতলা দুর্নীতিগ্রস্ত, দুষ্কৃতীদের দল পরিচালিত সরকারকে না সরালে নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে না।
প্রাসঙ্গিকতায় উল্লেখ্য, সত্যজিৎ রায়ের ছায়াছবির সেই অমোঘ সংলাপ -
‘‘অনাচার কর যদি
রাজা তবে ছাড় গদি।
যারা তার ধামাধারী
তাদেরও বিপদ ভারী।
করিবে শোষণ-পাপ
ক্ষমা চেয়ে নাহি মাফ।’’