E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪০ সংখ্যা / ১৯ মে, ২০২৩ / ৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

শতবর্ষ পেরিয়ে এক চিরতরুণ শিক্ষক

পার্থ রাহা


সময়টা ১৯৭২। এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে মৃণাল সেন তাঁর ছবি তৈরির গোড়ার কথা বলেছেন, এক বিষম পৃথিবীর সামনে মুখোমুখি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ম্যাটিনি শো’র গৃহবধূ আকুল ছবির দীর্ঘ লাইনের বাইরে দাঁড়িয়ে একমাত্র অন্য ছবি তৈরির আন্দোলনে শামিল হওয়ার কথা বলেছিলেন, সঙ্গে আরও একটি কথা বার বার উচ্চারণ করেছিলেন। সে কথা হলো, এই শহর কলকাতার সঙ্গে তাঁর নিবিড় আত্মীয়তার কথা। কলকাতা যে তাঁকে শুধু আনন্দই দিয়েছে তাই নয়, দুঃখও দিয়েছে। হতাশ করেছে কিন্তু হতাশায় ভেঙে পড়তে দেয়নি। সামনের হা হা অনিশ্চয়তার ভিতরে দু’কোল ভরে আশ্রয় দিয়েছে। মায়ের মতন সাহস জুগিয়েছে। প্রায় পঁচিশ বছর পর জার্মান চলচ্চিত্রকার রেনার্ড হফ একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন মৃণাল সেনকে নিয়ে। এখানেও মৃণাল সেন বলছেন, কলকাতা ছাড়া আমি আমাকে ভাবতেই পারি না... কলকাতা আমার 'এল ডোরাডো'। আমার প্রতিবাদ, আমার সাফল্য বা ব্যর্থতা, আমার আবেগ আমার উত্তেজনা সবই জড়িয়ে আছে এই শহরকে নিয়ে, আমার প্রিয় কলকাতাকে নিয়ে। এই সেদিনই মৃণাল সেন ছবি করলেন কলকাতাকে নিয়ে, ছবির নাম ‘ক্যালকাটা মাই এল ডোরাডো’।

চল্লিশের দশক ইতিহাসের গতানুগতিক ধারায় একটা প্রবল ধাক্কা দিয়েছিল। মন্বন্তর, মানুষের তৈরি আকাল, এলো ভাইয়ের বুকে বেঁধা ভাইয়ের রক্তাক্ত ছুরির ভিতর দিয়ে দু’টুকরো স্বাধীনতা। মৃণাল সেনের যৌবনও শুরু এই উত্তাল অস্থির এবং অনিশ্চিত নাগরিক জীবন থেকে। দূর ফরিদপুর থেকে এসেছেন কলকাতায়। এই সময়েই দেশভাগ, নৌবিদ্রোহ, দুর্ভিক্ষ। অগ্রজের মার্কসীয় দর্শনের প্রতি বিশ্বাস তাঁকে অবোধ্য আকর্ষণে টেনে নিয়ে গেল ধর্মতলা স্ট্রিটের 'গণনাট্য সংঘ'র আড্ডায়। এদিকে দারিদ্র্যের ভয়াবহতা, দিন কাটে ক্ষুধায় অপমানে। কখনো গৃহশিক্ষকতা কখনো বা মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভের চাকরি। যেমন করেই হোক টিকে থাকার, অস্তিত্ব রাখার সংগ্রাম। এরই মাঝে ডি-সিকা, রোসেলিনির নতুন ধারা - নব্য বস্তুবাদের প্রতি অলঙ্ঘ্য টান, অনতিক্রম্য আকর্ষণ। ১৯৫৫-এ প্রথম ছবি করেন ‘রাতভোর’। চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের সঙ্গে আমার পরিচয় ‘নীল আকাশের নিচে’ থেকে। আমার মতো আমার প্রজন্মের অনেকেরই। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিতর দিয়ে দুই দেশের দুই ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের একাত্মতা। এই ছবিতেই আমরা এক তরুণ চলচ্চিত্রকারের দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এক আন্তর্জাতিকতা বোধের মননকে পাই। ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবিটি তৈরির কয়েকমাস আগে স্বাধীন ভারতের ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’ ঘটে গেছে কলকাতার রাস্তায়। দু'মুঠো ভাতের দাবিতে আসা নিরন্ন নিঃসহায় কৃষকের উপর প্ররোচনাহীন সরকারি হিংসায় শহিদ হয়েছেন আশি জনেরও বেশি মানুষ। তারই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ‘বাইশে শ্রাবণ'। সমাজবিজ্ঞানী ল্যাউটন জানিয়েছেন, ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতার স্পর্শ শিল্পে কখন জানি সংগোপনে প্রবেশ করে। মৃণাল সেনের পরবর্তী ছবি ‘পুনশ্চ’। নিজের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে নিয়ে। পরবর্তী ত্রিশ বছর ধরে যাদের তিনি বিশ্লেষণ করেছেন। নিজেকেও সমালোচনা করতে পিছিয়ে আসেননি।

এই নাগরিক জীবনেরই সৃষ্টি মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তারাও সমানভাবেই শোষিত। কিন্তু আত্মবিস্মৃত। প্রতিমুহূর্তের স্বপ্ন পুঁজিবাদী হবার অসম্ভব কল্পনা। এই কথাই শুনি ‘আকাশ কুসুম’-এ। গল্প বলার ভঙ্গিমায় মৃণাল সেন নতুন পথ ধরলেন। অপেক্ষা করতে হলো আরও কিছুদিন।

'ইন্টারভিউ' আমাদের প্রবল ধাক্কা দিয়েছিল। 'ইন্টারভিউ'-এর নায়ক সাম্রাজ্যবাদের ভুক্তাবশেষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। হোক না সেই বিদ্রোহ ব্যক্তিগত। তবু প্রতিবাদে নেই কোনো খাদ। বিবস্ত্র ম্যানেকুইন যেন আমাদের এই নাগরিক ভণ্ড তামাশার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আর তখনই সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের মুক্তিকামী ভিয়েতনামী মানুষের সঙ্গে শহর কলকাতা এক আত্মীয় হয়ে গেল। এর পরের ছবি ‘কলকাতা ৭১’। 'কলকাতা ৭১'-এর মতো ক্লাসিক অথচ সময় অনুসারী ছবি আজ পর্যন্ত বাংলা সিনেমায় এসেছে কীনা জানা নেই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমরেশ বসুদের কাহিনি নিয়ে প্রায় কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর মতোই ঘোষণা করলেন, “আমাদের ইতিহাস দারিদ্র্যের ইতিহাস”। পরের ছবি ‘পদাতিক’। অতি বামপন্থী নায়ককে সামনে রেখে সেইসব মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও অতি বামপন্থার সমালোচনা করলেন। বাবা-ছেলের আন্দোলনের সমালোচনা করলেন। কোনো উঁচু আসনে বসে নয়। নিজেও আন্দোলনের সঙ্গে থেকে আশীর্বাদ করলেন - ‘Be brave’ - সাহসী হও। এখানেই মৃণাল সেনের রাজনৈতিক সচেতনতা। প্রকৃতপক্ষে বাংলা চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ছবি ‘পদাতিক’। মৃণাল সেন চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সাহস হারাননি। নাগরিক যুক্তিবাদী মনে জানতেন তাঁর পথ ফুলে সাজানো নয়। জনপ্রিয়তা তাঁর জন্য নয়।

মৃণাল সেন আমাদের প্রবাদপ্রতিম তিন চলচ্চিত্রকারের মধ্যে একমাত্র, যিনি সারা ভারতে ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর কর্মকাণ্ড। কখনও ওড়িয়ায়, কখনও তেলুগুতে, কখনও বা হিন্দিতে। ‘ভুবন সোম’ আজও ভারতীয় নতুন সিনেমার পথ প্রদর্শক বলে চিহ্নিত। তরুণ প্রজন্মকে নতুন ভাবনায় ছবি করার জন্য তিনি উদ্দীপিত করেছেন। মুম্বাইতে নতুন ধারা এনেছেন।

‘একদিন প্রতিদিন’ আপাতদৃষ্টিতে একেবারেই অন্য ভঙ্গিতে। সত্তর দশকের সেই উত্তাল জীবনের কথা নেই। আবারও 'পুনশ্চ'র মতোই গল্প বলার ভঙ্গি। কলকাতার নগরজীবন এখানে চরিত্র। নিম্নবিত্ত চরিত্রগুলির সীমাবদ্ধতা, নীচতা, স্বার্থপরতা আবার উদ্‌বেলিত আবেগ ক্যামেরার নানা কোণ থেকে বেরিয়ে এসেছে। সমাজবিজ্ঞানী লেভিন বলেছেন, আমাদের চিন্তার সামাজিকীকরণ হয় অন্তরঙ্গ গোষ্ঠীর প্রভাবে। সময়বিশেষে জীবনের বিভিন্ন স্তরে সেটি প্রকাশিত হয়। পিতা একদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের হয়ে কোর্টে ব্রিফ ধরছেন। আবার বড়ো ছেলে যখন সাম্যবাদী আন্দোলনের কর্মী হিসাবে জেলে যাচ্ছে, তখন দেখা পর্যন্ত করছেন না। নিজেই সন্তান মৃণালকে স্টুডিয়ো পাড়ায় নিয়ে যাচ্ছেন, আবার পুত্র কোনো অর্থকরী কাজ না করে সিনেমা করছে বলে ক্রুদ্ধ হচ্ছেন। মধ্যবিত্তের এই অসম আচরণ বারবার মৃণাল সেনের ছবিতে ধরা পড়েছে। সারাজীবন ধরে তাঁর সেই ‘পুনশ্চ’ থেকে ‘আকাশ কুসুম’ হয়ে পরবর্তীকালের ‘একদিন প্রতিদিন’ বা ‘খারিজ’ পর্যন্ত একই ধারা, একই প্রবহমানতা লক্ষ করা যায় - বিষয়বস্তু নগর জীবন, নাগরিক মনন আর তার ফসল মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তিনি একই ঘটনাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেয়েছেন। “কেননা, বুর্জোয়া শ্রেণি এক উলঙ্গ, পাশবিক শোষণ ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে” (কমিউনিস্ট ইশতেহার), তাকে নানাভাবে নিংড়ে দেখাই শিল্পীর কাজ। মৃণাল সেন ঠিক সেই কাজটাই করে চলেছিলেন।


প্রায় নয় বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত। চারপাশের ঘটনা তাঁকে প্রতি মুহূর্তে নাড়া দিয়েছে। তিনি ফিরে এলেন ‘আমার ভুবন’ নিয়ে। প্রায় পঞ্চাশ বছরের শিল্পসৃষ্টির জীবন থেকে একেবারেই আলাদা। ছবি করলেন মুসলিম সমাজকে নিয়ে। এক প্রবীণ পরিচালক তাঁর অতীত নির্মাণের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এক নতুন জায়গায় পা দিলেন। গ্রিফিথ থেকে চ্যাপলিন, বের্গম্যান, গদার কেউই সাহস দেখাতে পারেননি। এমনকী নট ইয়েটের কুরেসোওয়াও না। যতদূর গভীরে তিনি ছুঁতে চেয়েছিলেন, ঠিক ততদূরই তিনি পৌঁছেছেন। তিনি গল্প শুনিয়েছেন। কাহিনি কাঠামোর মধ্যে কোনো জটিলতা নেই। এখানে ভারতের সংখ্যালঘু জীবনের পরিবেশ উপস্থিত। মানুষের পরিচয় তার ধর্মে নয়, জাতিতে নয়, পরিচয় তার মনুষ্যত্বে। দস্তয়েভস্কির মতো তিনিও বলতে পেরেছেন - মানুষের একমাত্র পরিচয় তার মনুষ্যত্বে। ‘আমার ভুবন’ বোধ করি একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ ছবি। চাটুজ্যে মশাইরা আসেন আবার এমনভাবেই চলে যাবেন। আসলে এত সহজ ভঙ্গিমায় একটি ন্যারেটিভ ছবি মূলত এক জটিল অনন্য চিন্তার ফসল। আপাত সরল এই কাহিনি কোনো একটি গল্প নয়, পরিচালকের নিজস্ব দর্শন। ‘আমার ভুবন’ পরিচালকের ধর্মনিরপেক্ষতার নিজস্ব দর্শন। এতদিনের রাগী, প্রতিবাদী মৃণাল সেন আমাদের শিক্ষক হয়েছেন তাঁর ঈপ্সিত জগতের ঈপ্সিত ভুবনে এগিয়ে যেতে।

মৃণাল সেনের একশো বছর পেরিয়ে গেল। কিন্তু প্রতিবাদী মানুষটা আজও যেন ক্যামেরার পিছনে সমান ক্রিয়াশীল। সমানভাবেই আজও আমাদের বিনিদ্র করেছেন।

আমাদের শিক্ষক মৃণাল সেনকে প্রণাম জানাই।