৬০ বর্ষ ৪০ সংখ্যা / ১৯ মে, ২০২৩ / ৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
ভারতীয় দর্শন প্রসঙ্গে (এগারো)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
বেদান্ত দর্শন
● উত্তর মীমাংসার নামান্তর হলো বেদান্ত দর্শন। ভারতীয় ছয়টি দর্শনের মধ্যে বেদান্ত দর্শনকে শ্রেষ্ঠ ভাববাদী দর্শন বলে বিবেচনা করা হয়। কেন না ভাববাদের চূড়ান্ত রূপ এই বেদান্ত দর্শনের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। বেদান্ত বলতে বোঝায় বেদের অন্ত বা শেষ। বেদের চারটি অংশ - মন্ত্র বা সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। সুতরাং বেদের অন্ত অর্থ উপনিষদকেই মুখ্যত বেদান্ত নামে অভিহিত করা হয়। উপনিষদ তত্ত্বের দার্শনিক ব্যাখ্যা ও সমর্থনই বেদান্ত দর্শন। বেদান্তকে অনেক সময়ে বেদান্ত মীমাংসা বলা হয়।
● উপনিষদ কোনো প্রণালীবদ্ধ গ্রন্থ নয় বা উপনিষদে আলোচিত দার্শনিক মতামত কোনো ঐকতান রচনা করে না, তবে বেদান্ত সূত্র বা ব্রহ্মসূত্রের রচনায় একক ধারাবাহিক দর্শন বিকশিত করার চেষ্টা হয়েছিল। ব্রহ্মের চরম বাস্তবতার অন্য নাম উপনিষদ, তাই ব্রহ্মসূত্র। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে বাদরায়ন এই ব্রহ্মসূত্রের মূল ভাষ্যকার। পরবর্তীকালের সমস্ত বেদান্তবাদী ব্রহ্মসূত্রকে মৌলিক বেদান্ত দর্শনের স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু সূত্রগুলি এতটাই দুর্বোধ্য যে, দর্শন সম্পর্কে কোনো স্বচ্ছ ধারণা দেয় না। এর ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল। পরস্পর থেকে পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এই ব্যাখ্যাগুলি নিজেরাই শক্তিশালী দর্শনের প্রসার ঘটায়।
● বিভিন্ন ব্যাখ্যাকার যেভাবে ব্রহ্মসূত্রকে বিশ্লেষণ করেছেন তার মধ্যে গুরুতর প্রভেদ থাকলেও শংকরাচার্য লিখিত প্রাচীনতম ব্যাখ্যা যা সর্বাধিক ও বিস্ময়কর খ্যাতি অর্জন করেছে, একদিকে তার মধ্যে সূক্ষ্ম ও গভীর ধারণার উপস্থিতির জন্য, অপরদিকে শংকরাচার্যের ন্যায় খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত এই কারণে। শংকরের দ্বারা প্রস্তাবিত ও তাঁর খ্যাতিমান শিষ্যদের দ্বারা ব্যাখ্যাকৃত এই দর্শনের প্রভাব এত বেশি ছিল যে যখনই আমরা বেদান্ত দর্শন নিয়ে কথা বলি, আলোচনা করি, আমরা শংকরের দ্বারা প্রচারিত বেদান্ত দর্শনকে বোঝাই। অন্য ব্যাখ্যা উপস্থিত করতে হলে আমরা তাকে ‘রামানুজমত’, ‘বল্লভমত’ হিসাবে চিহ্নিত করি। ভারতীয় দর্শনে অন্য ধারাগুলিতে (যেমন যামিনী সূত্র, ন্যায় সূত্র) মূল গ্রন্থগুলিতে আমরা সূত্রগুলি লক্ষ করতে পারি। বেদান্ত দর্শনে প্রকৃত উৎস হলো উপনিষদ এবং সূত্রগুলি হলো পদ্ধতিগতরূপে অত্যন্ত ঘনীভূত সারাংশ। শংকর প্রচারিত বেদান্ত মতের সর্বাপেক্ষা বিরোধী ছিলেন মীমাংসাবাদীরা। মীমাংসাবাদীরা মনে করতেন বেদ কোনো দর্শনের প্রচার করেনি, কার্যধারার ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশ উপস্থিত করেছে।
● শংকরের সময়কাল ৭০০ থেকে ৮০০ খ্রিস্টাব্দ। তিনি দক্ষিণ ভারতের মালাবার অঞ্চলের মানুষ ছিলেন। শংকর তাঁর গুরু গোড়পদর কাজকেই আরও এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তিনি দশটি উপনিষদ (যথাক্রমে কেনা উপনিষদ, কথা উপনিষদ, প্রশ্ন উপনিষদ, মুণ্ডকা উপনিষদ, মাণ্ডুক্য উপনিষদ, ঐত্রেয় উপনিষদ, তত্তিরিয় উপনিষদ, বৃহদ অরণ্যক উপনিষদ এবং চাণ্ডোগ্য উপনিষদ) এবং ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন যে, ওর মধ্যেই রয়েছে পরম ধর্ম।
● প্রসঙ্গত, তিনটি মৌলিক বেদান্ত গ্রন্থ হলো যথাক্রমে, উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র এবং ভগবদ্গীতা, বদরায়নের ব্রহ্মসূত্র সম্পর্কে বিভিন্ন মতাবলম্বীদের (Schools) ব্যাখ্যা চর্চা থেকে বোঝা যায় যে, সকলেই এই সূত্রগুলিকে উপনিষদের শিক্ষার মূল অন্তর্বস্তু বলে বিবেচনা করেছেন। শংকর বেদান্ত দর্শনের আলোচনায় অন্য সমস্ত দার্শনিক চিন্তা যেমন সাংখ্য, যোগ, ন্যায়-বৈশেষিকা বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতিগুলিকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছেন।
● শংকর যে অদ্বৈতবাদী দর্শন (বেদান্ত)-এর প্রচার করলেন তার মূল কথা হলো, চরম ও সর্বশেষ সত্য হলো ‘স্বয়ং’ (Self), যেটা বিভিন্ন ব্যক্তির মধে বহুরূপে আবির্ভূত হলেও, তা হলো এক (One)। ব্যক্তি স্বয়ং-দের বাদ দিয়ে এই বিশ্বের কোনো বাস্তবতা নেই। সমস্ত ঘটনা - মনোগত বা শারীরিক, ক্ষণস্থায়ী বহিঃপ্রকাশ (appearance) ছাড়া কিছুই নয়।
● জগৎ হলো মিথ্যা - মায়ার সৃষ্টি। মিথ্যা জগতের অস্তিত্ব ততক্ষণই যতক্ষণ না সঠিক জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে। যে জগৎকে আমরা দেখছি (জগৎ প্রপঞ্চ), তার উপলব্ধি হলো ভ্রমাত্মক। প্রকৃত জ্ঞানের উন্মেষ এই ভ্রমাত্মক জগৎ ধারণা (World Appearance)-এর অবসান ঘটবে। প্রকৃতকে উপলব্ধি করার অর্থ হলো জগতের চেহারা সংক্রান্ত উপলব্ধির অবসান ঘটানো।
● বেদান্ত দর্শনে অজ্ঞানতাকে সমস্ত ভ্রান্তির উৎস বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে একে ইতিবাচক বলা হয়েছে কারণ জ্ঞানের সাহায্যে অজ্ঞানতার অবসান ঘটানো সম্ভব। বেদান্ত দর্শনে দুইটি রূপকে উল্লখ করা হয়েছে। একটি হলো প্রকৃত রূপ অর্থাৎ স্ব-আলোকিত ব্রাহ্মণ। অপরটি হলো অনির্দিষ্ট (Indefinite) রূপ। অনির্দিষ্ট রূপের অর্থ হলো অপরিবর্তনীয় ব্রাহ্মণ-এর ভ্রান্ত প্রকাশ (Manifestation)। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, শংকর যাঁকে শংকরাচার্য হিসাবে অভিহিত করা হতো তিনি ছিলেন অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের মূল তত্ত্বকার। ব্রহ্মসূত্র, উপনিষদ ও ভগবদ্গীতার ব্যাখ্যা তিনি করেছিলেন। অসংখ্য রচনা ছিল তাঁর।
● এছাড়াও রামানুজ, যাঁকে রামানুচার্য বলেও অভিহিত করা হতো, তিনিও বেদান্ত দর্শনের অন্যতম ব্যাখ্যাকার।
● পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, শংকর অদ্বৈত বেদান্ত বা মায়াবাদের প্রচারক। সেই সময়ে আস্তিকদের মধ্যে, শৈবরা শিবকে এবং বৈষ্ণবেরা বিষ্ণুকে ব্রহ্ম হিসাবে গণ্য করত। শৈব ও বৈষ্ণবেরা নিজস্ব ঘরানার সাথে ব্রহ্মসূত্রকে একীভূত করে ব্রহ্মসূত্রের বিশ্লেষণ শুরু করেছিল। এমন একজন বৈষ্ণব দার্শনিক ‘বিশিষ্টাদ্বৈত’ প্রচার করেছিলেন। রামানুজের এক শিষ্য এটি পরিমার্জন করে ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদ’ প্রচার করেন। মাধব নামের আর একজন দার্শনিক ‘দ্বৈতবাদ’ প্রচার করেন। বল্লভ নামের অন্য আর একজন দার্শনিক ‘শুদ্ধাদ্বৈতবাদ’ প্রচার করেন। কাত্যায়ণ নামের এক বৈষ্ণব দার্শনিক ‘অচিন্ত্য ভেদাভেদবাদ’ প্রচার করেন।
● বেদান্ত দর্শন ও তাঁর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। এটা আমাদের বিশেষভাবে স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, এই দার্শনিক ধারণাগুলি সেই সময়ে মানুষের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
● বেদান্ত দর্শন মানেই উপনিষদের দর্শন - বৈদান্তিকদের মত একান্তভাবেই তাই। অবশ্যই উত্তরকালের বৈদান্তিক আচার্যরা বিপক্ষ খণ্ডনের উদ্দেশে এমন অনেক দার্শনিক প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন যার পরিচয় উপনিষদগুলির মধ্যে পাওয়া যায় না। দৃষ্টান্ত হিসাবে প্রমাণ-প্রমেয় প্রভৃতি প্রসঙ্গে পরবর্তী বৈদান্তিকদের আলোচনা উল্লেখ করা যায়। কেননা অন্যান্য সম্প্রদায়ের দার্শনিকরা এ জাতীয় প্রসঙ্গের অবতারণা করে এমত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চেয়েছেন যার সঙ্গে উপনিষদ-প্রতিপাদ্য দার্শনিক তত্ত্বের সঙ্গতি হয় না। স্বভাবতই উপনিষদের সমর্থনে এ জাতীয় প্রসঙ্গেরও প্রত্যুত্তর রচনা করার প্রয়োজন হয়েছে। তবে এখানেও মনে রাখা দরকার, উত্তরকালের বৈদান্তিকেরা যত নতুন ও জটিল দার্শনিক আলোচনার অবতারণাই করুন না কেন, তার সবটুকুই একটি মূল কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ। অর্থাৎ, স্বাধীন যুক্তি বা বিচার-বিশ্লেষণের উপর নির্ভর করে তাঁরা কেউই বিশ্বের কোনো নতুন ব্যাখ্যা খোঁজেননি; তার বদলে উপনিষদ-প্রতিপাদ্য পুরানো ব্যাখ্যাটিরই নতুন সমর্থন অন্বেষণ করেছেন।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ঃ
● ছয়টি আস্তিক দর্শনের মধ্যে বেদান্ত দর্শন ব্যতিরেকে বাকি পাঁচটি দর্শনে বলিষ্ঠ বস্তুবাদী ধারণা রয়েছে। প্রকৃত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাবে (যা সেই সময়ে আশা করা যায় না) অথবা শাসকশ্রেণির সাথে আপসকামী মনোভাবের জন্য কিংবা বৈদিক পুরোহিত শ্রেণির আক্রমণ প্রতিহত করতে এই পাঁচটি দর্শন বৈদিক সংস্কারকে গ্রহণ করে। তবে ওই পাঁচটি দর্শনে ব্যবহৃত বহু যুক্তি আমাদের বর্তমান সংগ্রামে প্রয়োজন হতে পারে। আমাদের যুক্তিবাদের মধ্যে দেশীয় অর্থাৎ ভারতীয় প্রেরণার স্পর্শ, আমাদের দেশীয় ধারণার গভীরে চিরন্তন ঐতিহ্যের সন্ধান কার্যকরভাবে হিন্দুত্ববাদী প্রচারকে খর্ব করতে পারে।
ভারতীয় দর্শনের সাধারণ বৈশিষ্ট্যঃ
● ভারতীয় ষড়্দর্শন অর্থাৎ সাংখ্য, মীমাংসা, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিকা ও বেদান্ত দর্শন প্রসঙ্গে আমরা প্রাথমিক আলোচনা করলাম। ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন সম্প্রদায়গুলির মধ্যে নানা ধরনের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এদের মধ্যে কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। এরকম কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিচে দেওয়া হলো।
(১) দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা - এটি ভারতীয় দর্শনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। ভারতীয় দর্শনের ক্রমবিকাশের ধারাকে অনুসরণ করলে দেখা যায় ভারতীয় দার্শনিকরা পরস্পর পরস্পরের দার্শনিক মতবাদের ব্যাখ্যা ও সমালোচনা করেন এবং একে অপরকে ভালোভাবে জানতে আগ্রহী হন। ফলে প্রতিটি দর্শন সম্প্রদায় নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করার আগে সর্বপ্রথম বিরোধী পক্ষের মতবাদটি ব্যক্ত ও ব্যাখ্যা করেছেন। একে বলা হয় পূর্বপক্ষ। এরপর যুক্তির সাহায্যে পূর্বপক্ষকে সমালোচনা ও খণ্ডন করা হয়েছে। একে বলা হয় উত্তরপক্ষ বা সিদ্ধান্ত।
এভাবেই পারস্পরিক ব্যাখ্যা ও সমালোচনার মাধ্যমে ভারতবর্ষে একটি পূর্ণাঙ্গ দর্শন-চিন্তার উদ্ভব ঘটেছে। আর তাই আমরা ভারতীয় দর্শনের একটি বিশেষ মতবাদ জানতে গিয়ে অন্যান্য মতবাদগুলিরও পরিচয় পেয়ে যাই। যেমন ন্যায় দর্শনের কোনো মূল গ্রন্থ অধ্যয়ন করতে গিয়ে আমাদের চার্বাক, জৈন, বৌদ্ধ, সাংখ্য, মীমাংসা প্রভৃতি দর্শনেরও বক্তব্য জানার সুযোগ হয়।
(২) চিন্তা ও মননের ব্যাপক বিষয় ভারতীয় দর্শনে আলোচনা করা হয়েছে। এই জ্ঞান কেবলমাত্র বুদ্ধিকেই তৃপ্তি করে তাই নয়, আমাদের সমগ্র সত্তার প্রকৃত তাৎপর্য ও মূল্যবোধকে জাগ্রত করে এক উচ্চতর চেতনায় উন্নীত করে। বহু ভারতীয় ঋষি ও দার্শনিকরা দর্শনের তত্ত্বজ্ঞানকে জীবনের উপলব্ধি ও আচরণে পরিণত করার চেষ্টা করেছেন।
(৩) সংশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি - সংশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি ভারতীয় দর্শনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। পাশ্চাত্য দর্শনে দেখা যায়, বিভিন্ন দার্শনিকরা দর্শনের সমস্যাগুলি পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করেছেন। অর্থাৎ তত্ত্ববিদ্যা, জ্ঞানবিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা, নীতিবিদ্যা, সৌন্দর্যবিদ্যা, মনোবিদ্যা প্রভৃতি বিভিন্ন শাখার সমস্যাগুলি স্বতন্ত্রভাবে আলোচিত হয়ে থাকে। কিন্তু ভারতীয় দর্শন এক সর্বব্যাপক শাস্ত্র। এখানে বিভিন্ন শাখার সমস্যাগুলি পৃথকভাবে আলোচনা না হয়ে বরং পরস্পরের সঙ্গে।
(৪) ভারতীয় দর্শনে কেবলমাত্র তত্ত্বের আলোচনাই করা হয়নি। দর্শন চর্চার মূল উদ্দেশ্য হলো দূরদৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে কীভাবে জীবনকে পরিচালিত করলে জীবনের পরমার্থ লাভ করা যায় - তা জানা। মোটকথা মানবজীবনের পরম উদ্দেশ্য বা পুরুষার্থ সিদ্ধির জন্যই ভারতবর্ষে দর্শনচর্চার উদ্ভব। আবার যেহেতু জ্ঞানবিদ্যা, অধিবিদ্যা এবং তর্কশাস্ত্র সম্বন্ধেও তাত্ত্বিক আলোচনার সমৃদ্ধি ভারতীয় দর্শনে কম নয়, তাই বলা যায়, তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয়দিক থেকেই ভারতীয় দর্শন অতীব বৈচিত্র্যপূর্ণ।
(৫) ভারতীয় দর্শনে যারা ভাববাদী অর্থাৎ ঈশ্বর, আত্মা, মোক্ষ প্রভৃতি অতিন্দ্রীয় সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী তাদের মধ্যেও ঈশ্বর, আত্মা, মোক্ষ এই বিষয়গুলির স্বরূপ সম্পর্কে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে।
(৬) চার্বাক ছাড়া অন্যান্য ভারতীয় দর্শনে চতুর্বিধ পুরুষার্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। মানুষের সাধারণ যা কামনা তাকে ভারতীয় দার্শনিকরা চার ভাগে ভাগ করেছেন - ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। চার্বাক ছাড়া বাকি সব দর্শন সম্প্রদায় মোক্ষকে পরম পুরুষার্থ বলে গ্রহণ করেছে। তাদের মতে মোক্ষলাভই জীবনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য। এই মোক্ষকেই মুক্তি, কৈবল্য, অপবর্গ প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়েছে। মুক্তির অর্থ হলো দুঃখের আত্যন্তিক বা চরম নিবৃত্তি। এই মুক্তিকে প্রধানত দুইটি ভাগে ভাগ করা হয় - জীবন্মুক্তি ও বিদেহ মুক্তি।
(৭) চার্বাক ছাড়া আর সব আস্তিক দর্শনে স্বীকার করা হয় যে, সমগ্র জগৎ এক নৈতিক নিয়মের দ্বারা পরিচালিত। ঋগ্বেদে এই নিয়মকে বলা হয়েছে ঋত। ঋত বলতে প্রাকৃতিক ও নৈতিক উভয় প্রকার নিয়ম শৃঙ্খলাকে বোঝাত। এই ঋতের ধারণাই পরবর্তীকালে ভারতীয় দর্শনে বিভিন্ন নামে অভিহিত হয়েছে। মীমাংসা দর্শনে একে বলা হয়েছে অপূর্ব। অপূর্ব হলো এমন এক নৈতিক নিয়ম যার দ্বারা এই আশ্বাস পাওয়া যায় যে, বর্তমানে অনুষ্ঠিত যাগযজ্ঞের ফল আমরা ভবিষ্যতে ভোগ করতে পারব। আর ন্যায় বৈশেষিক দর্শনে এই নিয়মকে বলা হয় অদৃষ্ট। এই অদৃষ্ট আত্মাতে অদৃশ্যভাবে থাকে এবং যথাসময়ে জীবের কৃতকর্মের ফলাফল দান করে।
(ক্রমশ)