৫৯ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৯ নভেম্বর, ২০২১ / ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর বৈঠক
পেট্রোপণ্যের উপর থেকে সেস ও সারচার্জ প্রত্যাহার, কৃষকদের ফসলের সহায়ক মূল্য প্রদানসহ বিভিন্ন দাবি উত্থাপন
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ গত ১৩-১৪ নভেম্বর, শনি এবং রবিবার সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর দু’দিনব্যাপী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠক হয়েছে দিল্লিতে। বৈঠক থেকে পেট্রোল-ডিজেলের উপর থেকে সমস্ত বর্ধিত সারচার্জ এবং সেস অবিলম্বে প্রত্যাহার করার দাবি জানানো হয়েছে। একই সাথে দাবি জানানো হয়েছে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বিনিময়ে কৃষকদের কাছ থেকে সমস্ত ফসল ক্রয় করার ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর যে আক্রমণ চলছে তার তীব্র নিন্দা করে বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পলিট ব্যুরো দাবি জানাচ্ছে অবিলম্বে এই সমস্ত আক্রমণ বন্ধ করতে হবে। পলিট ব্যুরো সংযুক্ত কিষান মোর্চা এবং কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ২৬ নভেম্বরে দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচিকেও সমর্থন জানিয়েছে।
১৪ নভেম্বর বৈঠকের আলোচনার ভিত্তিতে রবিবার একটি বিবৃতি দিয়েছে পলিট ব্যুরো। সেই বিবৃতিতেই এই দাবিগুলি তুলে ধরা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পেট্রোপণ্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির পরিণতিতে সাধারণ মানুষের উপর বোঝা ক্রমশ বেড়েছে। কেন্দ্র লিটার প্রতি পেট্রোলে যে ৫ টাকা ও ডিজেলে যে ১০ টাকা উৎপাদন শুল্ক কমিয়েছে, তা দেশবাসীকে কোনো স্বস্তিই দিতে পারেনি। তারপরে এখনও প্রতি লিটার পেট্রোল ও ডিজেলে কেন্দ্রীয় উৎপাদন শুল্কের পরিমাণ যথাক্রমে ৩৩টাকা এবং ৩২টাকা। রাজ্যগুলিকে যে শুল্কের ভাগ দেওয়ার কথা, সেই শুল্ক সামান্য কমিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু কেন্দ্র বিশেষ অতিরিক্ত উৎপাদন শুল্কের নামে সারচার্জ হিসাবে ৭৪ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা ও সেস হিসাবে ১ লক্ষ ৯৮ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য সারচার্জ ও সেস বাবদ ১৫ হাজার ১৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে চলেছে পেট্রোল ও ডিজেল থেকে। সব মিলিয়ে এর পরিমাণ ২ লক্ষ ৮৭ হাজার কোটি টাকা, যার কোনো ভাগ দিতে হয় না রাজ্যগুলিকে। সাধারণ মানুষকে অর্থপূর্ণ স্বস্তি দেওয়ার জন্য কেন্দ্রকে অবশ্যই অবিলম্বে এই অতিরিক্ত সেস ও সারচার্জ প্রত্যাহার করে নিতে হবে।
কেন্দ্রীয় গুদামে আর জায়গা না থাকার দোহাই দিয়ে মোদি সরকার নির্দিষ্ট কয়েকটি রাজ্য থেকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ধান না কেনার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিবৃতিতে তার তীব্র নিন্দা করেছে পলিট ব্যুরো। এই প্রসঙ্গে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গুদামে গুদামে খাদ্যশস্য পচে যাওয়ার অবস্থা। পচে নষ্ট হওয়ার আগে এই খাদ্যশস্য বিনামূল্যে বিতরণ করতে হবে গরিবদের মধ্যে। লক্ষণীয় যে, এমন সময়ে কেন্দ্র এই নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যখন এক বছর ধরে কৃষকরা নয়া কৃষি আইন বাতিল ও সমস্ত ফসল ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে বিক্রি করার আইনি অধিকারের দাবিতে ঐতিহাসিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। কেন্দ্রকে অবশ্যই সমস্ত ফসল ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে সংগ্রহ করতে হবে।
পলিট ব্যুরো সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ বন্ধ করার দাবিও জানিয়েছে। পলিট ব্যুরো বলেছে, সারা দেশ থেকেই সংখ্যালঘুদের উপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে, যা গভীর উদ্বেগের বিষয়। স্পষ্টতই বিভিন্ন রাজ্যে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীগুলি এমন অপরাধ সংগঠিত করে চলেছে। প্রশাসন আক্রান্তদের রক্ষা করার বদলে বাস্তবে তাঁদেরই নিগ্রহ করছে, তাঁদের সমর্থকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছে। দানবীয় আইনে এঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে আসাম ও ত্রিপুরায় হিংসাত্মক আক্রমণ চালানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট রাজ্য প্রশাসনের মদতেই। আর কেউ এমন আক্রমণের খবর প্রচার মাধ্যমে তুলে ধরলে তাঁর বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করা হচ্ছে ইউএপিএ (বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন)। যেমন, উত্তর প্রদেশে মুসলিমদের বিরুদ্ধে এনএসএ বা জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সঙ্গে চালানো হচ্ছে একের পর এক ‘এনকাউন্টার’। গুরগাঁওয়ে আবার প্রার্থনা করার মৌলিক অধিকার খর্ব করা হলো। কয়েকটি মানবাধিকার গোষ্ঠী সম্প্রতি এক রিপোর্টে বলেছে, ২০২১ সালের প্রথম নয় মাসে সারা দেশে খ্রিস্টানদের উপর ৩০০টি আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এমন আক্রমণ চলছেই। কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন, এফআইআর-ও দায়ের করতে দেওয়া হচ্ছে না। আক্রান্তদের অনেকেই দলিত ও আদিবাসী। বহু গির্জাও ভাঙচুর করা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এই সব আক্রমণ ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গঠনকেই আঘাত করছে, লঙ্ঘন করছে সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারগুলিকে। এমন আক্রমণের বিরোধিতায় আগামী ১ ডিসেম্বর সারা দেশে পার্টির সমস্ত শাখাকে প্রতিবাদ দিবস পালনের আহ্বান জানিয়েছে পলিট ব্যুরো।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো রাজ্যগুলির অধিকার এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। কেন্দ্রীয় সরকার অতি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব ও আসামে বিএসএফ’র আওতাধীন এলাকাকে ওই রাজ্যগুলির আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার যে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে, তা সেই মৌলিক বৈশিষ্ট্যকেই গুরুতর আঘাত করেছে। আরও খারাপ হলো, কেন্দ্র এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই। অথচ ভারতীয় সংবিধান অনুসারে, পুলিশি ব্যবস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের তালিকাভুক্ত বিষয়। তাই কেন্দ্রের কাছে এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাতিল করার দাবি জানাচ্ছে সিপিআই(এম)।
রাফালে যুদ্ধবিমান কেনায় দালালি লেনদেনের নতুন যে তথ্য সামনে এনেছে ফরাসি তদন্তমূলক সাময়িকপত্র মিডিয়াপার্ট, এদিনের বিবৃতিতে তার পরিপ্রেক্ষিতে এই কেলেঙ্কারি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের স্বাধীন তদন্তের দাবিও জানিয়েছে পলিট ব্যুরো। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতীয় সেনাকে এই যুদ্ধবিমান বিক্রির ক্ষেত্রে দালালকে যে কমিশন দেওয়া হয়েছে, নথি সহ তার নতুন প্রমাণ হাজির করেছে মিডিয়াপার্ট। তাতে আরও দেখা যাচ্ছে, সরকারি আলোচনায় রাফালের প্রস্তুতকারী সংস্থা দাসাউ এভিয়েশনকে কীভাবে লাভের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। তারপরেও কেন্দ্রীয় সরকার এই কেলেঙ্কারির তদন্ত চালাতে অস্বীকার করছে। রাফালে কেনাবেচায় যে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি হয়েছে, তাকে আড়াল করার এই প্রচেষ্টা অত্যন্ত নিন্দনীয়। এমন ধরনের কেলেঙ্কারিতে অন্য অনেক দেশের সরকার তদন্তের নির্দেশ দিলেও মোদি সরকার তদন্তের দাবি প্রত্যাখ্যানে একগুঁয়ে মনোভাব দেখিয়ে চলেছে। কুকর্মের স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে সেখানেই।
পলিট ব্যুরো কৃষক ও শ্রমিকদের ডাকা আগামী ২৬ নভেম্বরের প্রতিবাদ কর্মসূচিকে পূর্ণ সমর্থনও জানিয়েছে। এদিনের বিবৃতিতে পলিট ব্যুরো বলেছে, সংযুক্ত কিষান মোর্চা নভেম্বরের ২৬ তারিখে সমাবেশের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকী পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেদিন দিল্লির সীমান্তগুলিতে এবং সমস্ত রাজ্যের রাজধানীতে জমায়েতের ডাক দিয়েছে মোর্চা। এই কর্মসূচির প্রতি সংহতি ও সমর্থন জানাচ্ছে সিপিআই(এম)। পাশাপাশি বেসরকারিকরণ ও নয়া শ্রম কোডের বিরোধিতায় এবং অন্যান্য দাবিতে শ্রমিক শ্রেণির ঐতিহাসিক ধর্মঘটের প্রথম বার্ষিকী পালনের যে আহ্বান জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি, তাকেও সমর্থন জানিয়েছে পলিট ব্যুরো।