৫৯ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৯ নভেম্বর, ২০২১ / ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে দেশব্যাপী দু’দিনের ধর্মঘট
শ্রমিক সংগঠনগুলির জাতীয় কনভেনশন থেকে সফল করার আহ্বান
‘দেশ বাঁচাও, দেশের মানুষকে বাঁচাও’ - শ্রমিক কনভেনশন থেকে সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনে নেতৃবৃন্দের আহ্বান।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ দেশ এবং দেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। পরাস্ত করতে হবে বিজেপি সরকারের মানুষ মারা নীতি সমূহকে। তাই কেন্দ্রীয় সরকারকে নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করতে সর্বস্তরের শ্রমজীবী মানুষকে আগামী ফেব্রুয়ারিতে আসন্ন বাজেট অধিবেশন চলাকালীন দেশব্যাপী দু’দিনের ব্যাপক সাধারণ ধর্মঘটে শামিল করতে হবে। ১১ নভেম্বর দিল্লির যন্তর মন্তরে বিজেপি’র জনবিরোধী নীতির প্রকোপে জর্জরিত শ্রমজীবীদের জাতীয় শ্রমিক কনভেনশন থেকে উচ্চারিত হয় এই আহ্বান। সংযুক্ত কিষান মোর্চার প্রতিনিধিরাও এই কনভেনশনে অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। কনভেনশনে দশ দফা সংবলিত খসড়া দাবিপত্র পেশ করা হয়।
সাধারণ ধর্মঘটের প্রস্তুতির জন্য কনভেনশন থেকে আইএনটিইউসি, এআইটিইউসি, এইচএমএস, সিআইটিইউ, এআইইউটিইউসি, টিইউসিসি, এসইডব্লিউএ, এআইসিসিটিইউ, এলপিএফ এবং ইউটিইউসি - এই দশটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের যুক্তমঞ্চ সহ প্রত্যেকটি সেক্টর-এর স্বাধীন বিভিন্ন ফেডারেশন এবং অ্যাসোসিয়েশন সমূহের এক যৌথ বিবৃতিতে রাজ্য এবং জেলাস্তরে ‘দেশ বাঁচাও, দেশের মানুষকে বাঁচাও’- এই স্লোগানের ভিত্তিতে প্রতিবাদী কর্মসূচি সংগঠিত করার সংগ্রামী বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, কোভিড-১৯ মহামারী সংক্রান্ত বিধিনিষেধের দরুন বড়ো মাপের জনসমাগমে বিধিনিষেধ রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ট্রেড ইউনিয়নগুলি এই কনভেনশনে রাজ্যস্তরের নেতা এবং কর্মীদের অংশগ্রহণ সীমায়িত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ঠিক হয়, আগামীদিনে রাজ্যস্তরের কর্মীদের মাধ্যমেই কনভেনশনের বার্তা সাধারণ সদস্য এবং শ্রমিকদের কাছে পৌঁছে দেবেন।
তবে কনভেনশনে যদিও মাত্র ৫০০ জনের জমায়েতের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তবুও বহু শ্রমিক এবং ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত, এমনকি তামিলনাডু, কেরালার মতো দূরবর্তী রাজ্যগুলি থেকে এবং বিমা, ব্যাংক, রেল, টেলিকম সহ বিভিন্ন সেক্টরের রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী এবং তাদের সঙ্গে শিল্প ক্ষেত্রের শ্রমিক এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা কনভেনশনে যোগ দেন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে সংযুক্ত কিষান মোর্চার নেতারা যারা তিনটি কৃষি আইন, বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল এবং এমএসপি আইনি গ্যারান্টি করার দাবিতে লাগাতার লড়াই করছেন, তারাও এই কনভেনশনে যোগ দেন।
শুরুতেই এই কনভেনশনে কোভিড ১৯ জনিত কারণ সহ অন্যত্র মৃত ৭০০ কৃষক, যাঁরা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং হাজার হাজার শ্রমিক, ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব, সাধারণ সদস্য এবং এলপিএফ-এর সভাপতি প্রয়াত ভি সুব্বারামানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রস্তাব পাশ হয়।
কনভেনশনের সভাপতিমণ্ডলী গঠিত হয় দশটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষে আইএনটিইউসি’র পক্ষে সঞ্জয় সিং, এআইটিইউসি’র সুকুমার দামলে, এইচএমএস’র রাজা শ্রীধর, সিআইটিইউ সভানেত্রী হেমলতা, এআইইউটিইউসি’র রমেশ পরাশর, টিইউসিসি’র শিব শংকর, এসইডব্লিউএ’র ফরিদা জালিস, এআইসিসিটিই’র পক্ষে শৈলেন্দ্র কুমার শর্মা, এলপিএফ’র আর কে মৌর্য এবং ইউটিইউসি’র নাজিম হোসেনকে নিয়ে।
কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে উপস্থাপিত খসড়া প্রস্তাব সমর্থন করে এদিন বক্তব্য রাখেন আইএনটিইউসি’র পক্ষে সহ-সভাপতি অশোক সিং, এআইটিইউসি’র সাধারণ সম্পাদক অমরজিৎ কৌর, এইচএমএস’র সাধারণ সম্পাদক হরভজন সিং সিধু, সিআইটিইউ’র সাধারণ সম্পাদক তপন সেন, এআইইউটিইউসি’র জাতীয় সম্পাদক সত্যভান, এআইটিইউসিসি’র সাধারণ সম্পাদক জি দেবরাজ, এসপিডব্লিউএর জাতীয় সম্পাদক সোনিয়া জর্জ, এআইসিসি ইউর সাধারণ সম্পাদক রাজীব ডিমরি, এলপিএফ’র জে পি সিং, ইউটিইউসি’র পক্ষে শত্রুজিৎ।
বক্তারা তাঁদের বক্তব্যে দেশের বীরত্বপূর্ণ কৃষক আন্দোলনের উল্লেখ করে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে তাঁদের সমর্থন এবং সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেন। কনভেনশনে উপস্থিত প্রতিনিধিদের কাছে তাঁরা কনভেনশনের দাবিসমূহ দেশের তৃণমূলস্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রস্তাবে উল্লিখিত বিভিন্ন যৌথ কর্মসূচির মধ্যদিয়ে ধর্মঘটের প্রচারের বিষয়টি উল্লেখ করেন। আসন্ন বাজেট অধিবেশনের সময় দেশব্যাপী ধর্মঘটকে সর্বাত্মক করতে খসড়ায় যে আহ্বান রয়েছে তা তুলে ধরে শ্রমিক প্রতিনিধিদের কনভেনশন থেকে ফিরেই স্থানীয় স্তরে দ্রুত প্রচার কর্মসূচী সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
তপন সেন কনভেনশনের দাবি সমূহের সঙ্গে বিজেপি সরকারের বিভিন্ন নীতির বিরোধিতার বিভিন্ন ইস্যুর যোগসূত্র ব্যাখ্যা করে বলেন যে, বর্তমান মোদি সরকার শুধুমাত্র শ্রমিক বিরোধী নয় এই সরকার কৃষক বিরোধী এবং একই সঙ্গে জনবিরোধী। বিজেপি সরকারকে দেশবিরোধী বলে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, দেশের সম্পদ বড়ো কর্পোরেট সহ বিদেশি একচেটিয়া কোম্পানিগুলির হাতে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে বেচে দিচ্ছে এই সরকার। তিনি কনভেনশনে আগত প্রতিনিধিদের আহ্বান জানিয়ে বলেন বিজেপি-কে পরাজিত করার কাজ সম্পন্ন করতে ‘মিশন ইন্ডিয়া’ সংক্রান্ত কাজ গ্রহণ করতে হবে যেখানে মিশন উত্তরপ্রদেশ, মিশন উত্তরাখণ্ড এবং মিশন পাঞ্জাব হবে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি বলেন, যাঁরা দেশের সম্পদ উৎপাদন করে সেই শ্রমিক এবং কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম অপ্রতিরোধ্য এবং পৃথিবীর কোনো শক্তি তাকে পরাস্ত করতে পারবে না। তিনি প্রতিনিধিদের এই ঐক্যকে শক্তিশালী করতে আহ্বান জানিয়ে বলেন, শ্রমিকদের ভেতরে ধর্ম এবং জাতের নামে যে বিভাজন তৈরির কল করেছে বিজেপি এবং আরএসএস, তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
কনভেনশন থেকে যে দশ দফা দাবিসমূহ গৃহীত হয় তা হলোঃ
● শ্রম কোড বাতিল
● নয়া কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল বাতিল
● রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র বেসরকারিকরণ বন্ধ করা এবং এনএমপি বাতিল
● দেশের সমস্ত আয়করহীন পরিবারকে বিনামুল্যে খাদ্য ও মাসে ৭,৫০০ টাকা আর্থিক সাহায্য দিতে হবে
● গ্রামীণ এলাকায় রেগায় অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং কর্ম সৃষ্টিকারী প্রকল্প চালু এবং প্রসারিত করতে হবে
● অসংগঠিত ক্ষেত্রে সকলের জন্য সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের সুযোগ দিতে হবে
● আইসিডিএস, আশা, মিড ডে মিল এবং অন্যান্য প্রকল্প শ্রমিকদের বিধিবদ্ধ আইন অনুযায়ী ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ দিতে হবে।
● স্বাস্থ্য পরিষেবার ফ্রন্টলাইন কর্মীরা, যারা মহামারীর সময় ঝুঁকি নিয়ে জনগণের মধ্যে থেকে কাজ করেছেন, তাদের উপযুক্ত সুরক্ষা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা এবং ইনসিওরেন্সের সুযোগ দিতে হবে
● পেট্রোল ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের উপর থেকে কেন্দ্রীয় শুল্ক ও কর কমাতে হবে এবং নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমাতে দৃঢ় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে
● বিত্তশালীদের সম্পদ কর বৃদ্ধি করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পরিষেবায় অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে
কনভেনশন থেকে মূলত এই সমস্ত দাবিকে ভিত্তি করে এবং ইতিমধ্যে গৃহীত অন্যান্য দাবিগুলিকে যুক্ত করে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সমূহ, ফেডারেশন এবং অ্যাসোসিয়েশনগুলির যৌথ মঞ্চের মাধ্যমে প্রচারে জোর দেবার প্রসঙ্গটি তুলে ধরা হয়।
কনভেনশন থেকে বলা হয়েছে, প্রচার পরিকল্পনায় গত বছরের ২৬ নভেম্বর আয়োজিত দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট এবং দিল্লি অভিমুখে কৃষকদের যাত্রার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ব্যাপক মিটিং-মিছিল এর মাধ্যমে প্রচার সুচি নিতে হবে। এক্ষেত্রে যেখানে সম্ভব সেখানে কৃষক সংগঠনগুলির সঙ্গে গঠিত যৌথ মঞ্চের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি নিতে হবে। নভেম্বর এবং ডিসেম্বরের মাঝামাঝি জুড়ে রাজ্য পর্যায়ের যৌথ কনভেনশন আয়োজন করতে হবে। সমস্ত রাজ্যগুলিতে এবং এক্ষেত্রে জেলা স্তরেও প্রচার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। বিজেপি সরকারের বিভিন্ন জনবিরোধী এবং অগণতান্ত্রিক নীতি সমূহের বিরুদ্ধে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত নিবিড় প্রচার নিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে সই সংগ্রহ, পথসভা, ধরনা ইত্যাদি বিভিন্ন পদ্ধতি বেছে নিতে হবে। রাজ্য এবং জেলা স্তরের এই সমস্ত কর্মসূচি সম্পন্ন করতে হবে ডিসেম্বরের থেকে জানুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত। ধরনা, জাঠা, পদযাত্রার মত বিভিন্ন কর্মসূচি এক্ষেত্রে নিয়মিত এবং ধারাবাহিকভাবে করতে হবে।