E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৯ নভেম্বর, ২০২১ / ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

কমরেড বাদল শেখের হত্যাকারীদের শাস্তি চাই

দাবিতে প্রতিবাদমুখর গোটা রাজ্য


বাদল শেখের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে নানুরে মিছিল।

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ বীরভূমের বালিগুনি গ্রামের সিপিআই(এম) কর্মী কমরেড বাদল শেখের বর্বরোচিত হত্যার ঘটনায় রাজ্যজুড়েই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সংগঠিত হচ্ছে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং দোষীদের শাস্তির দাবিতে ইতিমধ্যেই উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ - সর্বত্র প্রতিবাদ মিছিল-বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছে।

এলাকায় জনপ্রিয় পার্টি কর্মী, পেশায় খেতমজুর বাদল শেখের ‘অপরাধ’ ছিল তিনি এলাকায় গরিব শ্রমজীবী মানুষের ওপর শোষণ-বঞ্চনার প্রতিবাদে এবং তাদের অধিকার ও দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। তাই সত্তরোর্ধ্ব এই গরিব পার্টিকর্মী বাদল শেখের উপর শাসকদল তৃণমূলের ক্ষোভ জমেছিল। ওদের ব্যাপক ‍‌চোখ রাঙানি ও হুমকি সত্ত্বেও অন্যান্য বছরের মতো এবারেও তিনি ৭ নভেম্বর ১০৫তম নভেম্বর বিপ্লব বার্ষিকীতে অন্যান্য পার্টি কর্মীদের নিয়ে নিজের গ্রামে রক্তপতাকা উত্তোলন করেছিলেন। তাই নিজেদের খাসতালুক ভেবে নেওয়া অনুব্রত মণ্ডলের ‘উন্নয়ন বাহিনী’ প্রথমে ‘কেন পতাকা তুলেছে’ - এই কৈফিয়ত চায়, তারপর যথেচ্ছ মারধর করে তাঁকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। শাসকদলের ভৈরব বাহিনী, এতটাই নৃশংস যে ভয়ঙ্কর আক্রমণের জেরে অচৈতন্য হয়ে পড়া বাদল শেখকে হাসপাতালে ‍‌চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতেও বাধা দেয়। এভাবেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বাদল শেখ। সেদিন কমরেড বাদল শেখের পাশাপাশি তৃণমূলের ভৈরব বাহিনীর হাতে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হন অপর দুই পার্টিকর্মী নিশিকান্ত থান্ডার, এবং শেখ পিটার। পৃথিবীর শোষিত-নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের প্রেরণা সঞ্চারকারী ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লব দিবসে মুক্তির দিশারি রক্তপতাকা উড্ডীন রাখতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিলেন বীরভূমের গ্রামের খেতমজুর বাদল শেখ। আর এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস আবারও বীভৎস হিংসার কদর্য ইতিহাসের নজির রাখলো।

রাজ্যের অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহধন্য অনুচর অনুব্রত মণ্ডলের যেন অনুগত স্তাবক বাহিনীতে পরিণত হয়েছে পুলিশ বাহিনী। সেদিন তৃণমূলের হিংস্র বাহিনীর হাতে মারাত্মকভাবে জখম মৃতপ্রায় বাদল শেখকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাধা পেয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে বার বার পুলিশকে ফোন করা হয়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে পুলিশ তখন ছিল নীরব। অনেক পরে যখন বাদল শেখ মৃত্যুর দরজায় তখন পুলিশের তৎপরতা দেখা যায়।

তৃণমূলের নৃশংস অত্যাচারের বলি হওয়া এবং ওদের বাধায় তি‍‌লে তিলে মৃত্যু হওয়া স্বামীকে দেখা স্ত্রী জরিনা বিবি সেদিন স্পষ্টতই অভিযোগ করেছিলেন, ‘আমরা সিপিএম করি। তাই তৃণমূলীরা মেরেছে আমার স্বামীকে গতকাল পতাকা তুলেছিল বলে। মারার পর ভ্যানে করে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেয়নি।’

কিন্তু এই ঘটনার কয়েকদিন পর (১২ নভেম্বর) রাজ্য বামফ্রন্টের প্রতিনিধিরা যেদিন শহিদের গ্রাম বালিগুনিতে যান, সেদিন সেখানে ছিল শ্মশানের নিস্তব্ধতা। শহিদ বাদল শেখের শোকে মুহ্যমান স্ত্রী জরিনা বিবি ছিলেন নিশ্চুপ-নির্বাক। স্বামীর মৃত্যুর মতো ভয়ঙ্কর বিহ্বলতার মধ্যেও শোকের পাথর বুকে চেপে সেদিন জরিনা বিবি অকুতোভয়ে তৃণমূলের নৃশংসতা-বর্বরতার কথা তুলে ধরেছিলেন। অথচ মৃত্যুর মাত্র ৪ দিনের মাথায় শুধু তিনি নন, নির্বাক গোটা গ্রাম। এটাই এখন তৃণমূলী জমানার ‘গণতন্ত্র’, ‘উন্নয়নের পরিবেশে’র বাস্তব চিত্র। আসল সত্য হলো, প্রকাশ্যে পিটিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবার পরও আরও বেলাগাম, বেপরোয়া শাসকদল। খুনের ঘটনাকে যে কোনো মূল্যে চাপা দিতে উদ্যত ওরা। তাই খুনিদের অবিরত হুমকি, শাসানি। ঘটনার সত্যতা যাতে কোনোভাবে প্রকাশ না পায় সেজন্য চলে গ্রামে টহলদারি, সঙ্গে দোসর পুলিশ বাহিনী। ঘটনার পর থেকেই গ্রামজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অনুব্রত-র বাহিনী, সঙ্গে র‍‌য়েছে পুলিশ তাই অদ্ভূত নীরবতায় আচ্ছন্ন বালিগুনি গ্রাম। অপরাধীদের ধরা তো দূরের কথা, পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত মামলা রুজু করে দায় সেরেছে, তাতে নেই হত্যার বিবরণ।

১২ নভেম্বর সন্ত্রাসবিদ্ধ বালিগুনি গ্রামের এই বাস্তব চিত্রই বামফ্রন্ট প্রতিনিধি দলের সামনে উঠে এসেছিল। এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন সিপিআই(এম) নেতা রবীন দেব, সুজন চক্রবর্তী, রামচন্দ্র ডোম, আভাস রায়চৌধুরী, শ্যামলী প্রধান, গৌতম ঘোষ, সিপিআই নেতা উজ্জ্বল চৌধুরী, তপন গাঙ্গুলি, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা জীবন সাহা, আরএসপি নেতা দেবাশিস মুখার্জি, এমএফবি নেতা আশিস চক্রবর্তী, আরসিপিআই নেতা প্রবীর অধিকারী সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। এদিন তাঁরা শহিদের স্ত্রীর হাতে ৫০ হাজার টাকার চেক মূলে দেন।

সেদিন শহিদ পত্নীর মৌনতায় গ্রামের ভয়াবহ সন্ত্রাসের আবহ যেন বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল। বামফ্রন্টের প্রতিনিধি দলের গ্রামে আসার খবরে তৎপর হয়ে উঠেছিল তৃণমূলীরা। ওরা কেবল হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, সিপিআই(এম) কর্মীসহ গ্রামবাসীদের বাড়িতে বাড়িতে গি‍‌য়ে হুমকি দেওয়া হয় - কেউ যাতে জরিনা বিবির আঙিনায় যেতে না পারে সেজন্য ফতেয়া জা‍‌রি করা হয়। বামফ্রন্টের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দেখা করলে ফল খারাপ হবে বলে শাসানো হয়।

এমনই শ্বাসরুদ্ধকর সন্ত্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন দেব এদিন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘জরিনা বিবিই প্রমাণ এরাজ্যের গণতন্ত্র হত্যার নির্লজ্জ চেহারার। এরাজ্যে ডেঙ্গুতে মারা গেলে, করোনায় মারা গেলে তা চাপা দেওয়া হয়। খুন করেও চাপা দেওয়া হচ্ছে শাসকদল, প্রশাসন ও পুলিশের মিলিত ঘৃণ্য কৌশলে। তবে এভাবে বেশিদিন অপরাধীদের আড়াল করা যাবে না। যেভাবে গ্রামকে নিস্তব্ধ করে রাখা হয়েছে, সেভাবে রাজ্যবাসীর কণ্ঠস্বর বন্ধ করা যাবে না। প্রতিবাদ হবেই।’

সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘তৃণমূলের এই ফোঁসফোসানি তো স্রেফ পুলিশের জন্যই। পুলিশ সরে গেলেই তৃণমূল গর্তে ঢুকে যাবে। স্বামীকে হারিয়েও এক বৃদ্ধাকে ভয়ে দিন কাটাতে হবে! স্বামীর খুনের অভিযোগটুকুও করতে পারবে না! মানুষই এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাবেন।’

বামফ্রন্টের প্রতিনিধিদল ছাড়াও এদিন সেভ ডেমোক্র্যাসি ফোরামের সদস্যরাও জরিনা বিবির বাড়িতে যান। তাঁরা নানুর থানার সামনে অবস্থানও করেছেন। এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন আইনজীবী সব্যসাচী চ্যাটার্জি, ফিরদৌস শামিম প্রমুখ। তাঁরা বলেছেন, বাদল শেখের ‍‌হত্যার ন্যায়বিচারের দাবিতে লড়াই আমরা ‍‌শেষ পর্যন্ত লড়ব। সর্বতোভাবে তাঁর পরিবারের পাশে থাকব।

মুখ্যমন্ত্রীর একান্ত অনুগত বীরভূমের ‘উন্নয়নের কারিগর’ অনুব্রত মণ্ডলের বদান্যতায় এমনই গণতন্ত্র চলছে সেখানে! কেবল বীরভূমই নয়, তৃণমূলী শাসনে বিভিন্ন জেলাতেই প্রায় এই একই পরিস্থিতি বিরাজমান। রাস্তায় ‘উন্নয়ন দাঁড় করিয়ে রাখা’ বীরভূমে কীর্তিমান অনুব্রত সম্প্রতি দলীয় সভায় এমন একটি মন্তব্য করেছেন, যা তৃণমূলী জমানায় কীভাবে গণতন্ত্রের অন্তর্জলি যাত্রা ঘটছে, তারই প্রমাণ দেয়। তিনি তাঁর বক্তব্যে বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ‘অন্যায়’ হয়েছে বলে স্বীকারোক্তি করেছেন। বলেছেন, ‘অন্যায় হয়েছে, ভয়ঙ্কর অন্যায় করেছি। এবার মানুষের রায় নেব। আপনারা পাশে থাকবেন। মানুষ ভোট দেবেন।’ পুরভোট প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘ভোট কিন্তু হবে, ভোট করব। পুরসভার ভোট করব, পঞ্চায়েতেরও করব। মানুষের রায় নেওয়াটা দরকার। প্রশ্ন করতে পারেন কেন, তাহলে ২০১৯ সালে ভুল করেছিলেন?’ উত্তরে নিজেই ‘অন্যায়’ হয়েছে বলে ওই মন্তব্য করেছেন।

অনুব্রতর এই মন্তব্যে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, তার মধ্যে অন্যায়ের জন্য অনুশোচনাবোধ জাগ্রত হয়ে উঠেছে বা তিনি এইসব উক্তি করে তার পাপস্খালন করতে চাইছেন। আসলে তারই ভাষায় আসন্ন পুরভোটকে কেন্দ্র করে আবারও ‘রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড় করানো’রই হয়তো নতুন ছক তবে তার মন্তব্যে এটা স্পষ্ট, নির্বাচনের সময়গুলিতে ওই জেলায় অনুব্রতর সৌজন্যে কীভাবে গণতন্ত্রের চর্চা হয়েছে! বিরোধীরা বার বার যে অভিযোগে সোচ্চার হয়েছিলেন, সেই অভিযোগের সত্যতা কিন্তু প্রমাণ হয়ে গেছে। নানুরের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রমাণ দিচ্ছে, মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার, গণতন্ত্রের পরিবর্তে কোন্‌ অন্ধকারের শাসন চলছে রাজ্যজুড়ে।