E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৯ নভেম্বর, ২০২১ / ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

মাইক্রো ফিনান্সের ঋণের ফাঁসে জেরবার পূর্ব বর্ধমান জেলার গ্রামীণ মানুষ

শংকর ঘোষাল


মাইক্রো ফিনান্সের একাধিক কোম্পানির ঋণের চাপে বেগুট গ্রামের মানুষ সরকারের কাছে বাঁচার আর্তি জানাচ্ছেন।

ঋণের ফাঁসে চোরাবালিতে ডুবে গেছি, আমরা বাঁচতে চাই। মুখ্যমন্ত্রী আমাদের মাইক্রো ফিনান্সের হাত থেকে বাঁচান। গোটা পূর্ব বর্ধমান জেলার গ্রাম, শহরের গরিব কৃষক, শ্রমজীবীর এমনই আকুতি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। বেগুট গ্রামের ঋণগ্রস্ত ছোটো কৃষক সুফল মণ্ডল, সুমনা মণ্ডলদের কাতর আবেদন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে, আমাদের রক্ত জোঁকের মতো চুষে খাচ্ছে মাইক্রো ফিনান্স, ফিরিয়ে দিন আমাদের পরিবারকে স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার। পূর্ব বর্ধমান জেলার ২৩টি ব্লকের আড়াই হাজারেরও বেশি গ্রামের ঋণগ্রস্ত কৃষকের এই কান্না কি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাবে?

লকডাউনের সময় থেকে এখানকার কৃষকদের আয় বাড়েনি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে আর শোষক পোকায় ফসলের সর্বনাশ হয়ে গেছে। সুদ আর কিস্তি মেটাতে না পেরে একের পর এক মাইক্রো ফিনান্সের ঋণের মালায় ফেঁসে পাওনাদারদের তাড়ায় এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সুফল মণ্ডল, তপন সরকার, অচিন্ত্য সাঁতরার মতো বহু ছোটো কৃষক, ভাগচাষি। ঋণের এই চোরাবালি থেকে মুক্তির আশায় সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন বর্ধমান সদর-২ ব্লকের বোধপুর, পলসা, হৈড়গ্রাম, আউশা, নবস্থা, চাকুন্দি, শালিগ্রাম, বোরশো, গাঙ্গুয়া সহ একাধিক গ্রামের ঋণগ্রস্ত কৃষক। কিন্তু শাসকের কাছে কৃষকের এই আর্তনাদ পৌঁছাবে কিনা তা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে ! কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকার তো সব জেনেবুঝেই মাইক্রো ফিনান্সের নামে নতুন এই কর্পোরেট মহাজনদের অবাধে লুট করার সুযোগ করে দিয়েছে। তা না হলে এত চড়া সুদে ব্যবসা করছে মাইক্রো ফিনান্স সংস্থাগুলি নিয়মবিধি তোয়াক্কা না করে কাদের মদতে? তৃণমূল এবং বিজেপি দুই দলই গরিবের এই সর্বনাশের সুযোগ নিয়ে বিভাজনের রাজনীতিতে ব্যস্ত। গ্রামবাংলার গরিবের এই চরম হাহাকারের দৃশ্য শাসকের মদতে চিটফান্ডের রমরমার কথাই স্মরণ করাচ্ছে।

বেগুষ গ্রামের তপন সরকার জানিয়েছেন, আগে আমরা ভালোই ছিলাম। নবস্থা সমবায় সমিতি থেকে কম সুদে ঋণ নিয়ে চাষ করতাম। সময়ে সেই ধার শোধও করে দিতাম। কখনো এইভাবে ‘বউ বন্ধক ঋণে’র ফাঁসে জড়িয়ে পড়িনি। ২০১১ সালে সরকার বদলের পর গাঁয়ের সমবায় গায়ের জোরে দখল নিল শাসকদল। এখন সেখানে নির্বাচিত বোর্ড নেই। এই সমবায়ের যে সাবমার্সিবলগুলো ছিল সেখান থেকে শাসকদল ৮লক্ষ টাকা নয়ছয় করেছে। এই সমবায়ের দরজা গরিব কৃষক, ভাগচাষি, বর্গাদারের জন্য বন্ধ হলো। এখন আর মাথা ঠুকলেও সমবায় থেকে গরিবরা ঋণ পায়না। এই অঞ্চলে সমবায় লুট হবার পর আমাদের মাইক্রো ফিনান্সের দরজায় ঠেলে দিল শাসকদল । প্রথমে বন্ধন ব্যাঙ্ক থেকে চড়া সুদে ধার করতে বাধ্য হলাম। সেই টাকা সুদ ও আসলে বেড়ে যেতে লাগল। মহাজনের চাপও বাড়ছে। বাঁচার জন্য আমরা একের পর এক আশীর্বাদ মাইক্রো ফিনান্স লিমিটেড, সত্যা মাইক্রো ফিনান্স, উজ্জীবন স্মল ফিনান্স ব্যাঙ্ক, অন্নপূর্ণা, বেদিকা, আহরণ, আলতোরা, জনলক্ষ্মী, আশা প্রভৃতি এমন অনেক ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা মাইক্রো ফিনান্সের ঋণের ফাঁসে জড়িয়ে পড়েছি। ক্ষুদ্র চাষি তপন সরকার চোখের জল ফেলে জানিয়েছেন, আমাদের কান্না কে শুনবে? শাসকদল, পঞ্চায়েত বাবুরা ওদের কেনা গোলাম। বর্তমানে তাঁর দেনা ৪ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। সাধ করে তাঁরা এই ঋণ নেয়নি। অচিন্ত্য সরকার জানিয়েছেন তাঁর ঋণের পরিমাণ ৫টি মাইক্রো ফিনান্সের কাছে প্রায় প্রায় ৪ লক্ষ টাকা। প্রতি মাসে কিস্তি গুনতে হয় ৭ হাজার ২০০ টাকা। এত টাকা কোথায় পাব বলুন? পাওনাদারের ভয়ে ঘরে থাকতে পারছি না, পালিয়ে বেড়াচ্ছি। পরিবারে হাড়ি চড়ছে না। মাইক্রো ফিনান্স জোঁকের মতো আমাদের মতো গরিবদের রক্ত চুষে খাচ্ছে। ভাগচাষি রবি মান্ডি বলেছেন, আমি সমবায়ের কাছে গিয়েছিলাম ঋণ চাইতে, আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, তাহলে কোথায় যাব বলুন? কী খেয়ে বাঁচব? এটা কোনো একটা গ্রামের চিত্র নয়, গোটা রাজ্যজুড়েই শাসকের মদতে এই মাইক্রো ফিনান্স সংস্থাগুলি ঋণের ফাঁসে লুট করছে গরিবের টাকা।

সরকারকে লেখা গ্রামবাসীদের চিঠি।

সুফল মণ্ডলের এই মুহূর্তে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা ঋণ। ঋণের বোঝা বেড়েছে হুহু করে, একটা ঋণ শোধ করতে অন্য ঋণ নিতে হয়েছে তাঁকে। বর্তমানে তাঁর ৫টি ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার দেনা মাথায়। তিনি জানিয়েছেন, পাওনাদারদের চাপে ঘুমোতে, খেতে পারছি না। মাইক্রো ফিনান্সের এজেন্ট ও বাউন্সাররা হুমকি দিচ্ছে - বিষ খেয়ে মরো, টাকা না পেলে ভিটেয় ঘুঘু চড়াব। আশায় মরে চাষা, আমি ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে চুক্তিতে চাষ বাড়িয়ে ঋণ শোধ করার স্বপ্ন দেখলেও চাষে ক্রমশ লোকসান, অভাবী বিক্রি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্টের জন্য ক্রমশ আমার ঋণ বেড়েই চলেছে। এখন ৫টি মাইক্রো ফিনান্স কোম্পানির কাছে ধারে আমার মাথার চুল পর্যন্ত বিকিয়ে আছে। সুফল মণ্ডল বলছেন, মাইক্রো ফিনান্সের এজেন্টদের ভয়ে বাড়িতে মেয়ে-জামাইদের আসা নিষেধ। এদের ঋণের চাপে ভুবন বাগ আত্মহত্যা করেছেন। এমনই পূর্ব বর্ধমান জেলায় প্রায় ৬৫জন কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ মাইক্রো ফিনান্সের অত্যাচারে আত্মঘাতী হতে বাধ্য হয়েছেন। এখানকার ঋণগ্রস্ত আশপাশের অনেক কৃষকই দেনায় জর্জরিত হয়ে মরছেন। ধীরেন বাস্কে বলেছেন, আমরা সকলেই নবস্থা সমবায়ের সদস্য, আমাদের প্রয়োজনে ঋণ দেয়না, কিন্তু এবার সদস্যদের ডেকে একটা করে কাঁচের গ্লাস দিয়েছে এই সমবায়। কৃষকের পাশে দাঁড়াতে ঋণ যারা দেয়না তাদের এই গ্লাস দিয়ে কী হবে? এটা কি বিষ খেতে দেওয়া হয়েছে? এই প্রশ্নই তুলেছেন অচিন্ত্য সাঁতরা।

পূর্ব বর্ধমান জেলায় ৫২০টি সমবায় সমিতি ছিল। মাত্র ১০ বছরে শাসকদল অধিকাংশের লালবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে। ৮১ বছরের একটি প্রাচীন সমবায় সমিতি শাসকের দুর্নীতি ও লুটের কারণে বর্তমানে দেউলিয়ায় পরিণত হয়েছে। মেমারির গোপগন্তার ইউনিয়ন কো-অপারেটিভ এগ্রিকালচার লিমিটেড শাসকের লুঠের কারণে আজ বন্ধ হবার মুখে। ১৯৪০ সালে এই সমবায় সমিতি গঠন হয়েছিল, ৬ কোটি ২০ লক্ষ টাকা নগদ আমানত রেখে গিয়েছিল আগের বোর্ড। ১০ বছরে তার সর্বনাশ করেছে শাসকদল। শুধু নবস্থা সমবায় সমিতি বা গোপগন্তার সমবায় সমিতি নয়, জেলার প্রায় ৫২০টি এই রকম সমবায় সমিতির মধ্যে ৫০ শতাংশে লালবাতি জ্বলেছে শাসকের লুটের কারণে। বেশিরভাগ সমবায়েই নির্বাচিত বোর্ড নেই। শাসকের লুঠের শিকার এই সমবায় সমিতিগুলি এখন ধুঁকছে। ফলে কৃষক, প্রান্তিক চাষিদের আবার মহাজন আর মাইক্রো ফিনান্সের দরজায় ঠেলে দিয়েছে শাসকদল। এরা কৃষকের রক্ত এখন জোঁকের মতো চুষে খাচ্ছে।

শত শত কোটি নগদ টাকা এই মন্দার বাজারে মাইক্রো ফিনান্স সংস্থাগুলো পাচ্ছে কোথায় - এই প্রশ্নই এখন মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন মাইক্রো ফিনান্স কোম্পানি গজিয়ে উঠছে মফস্‌সলে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মদতেই ২৮-৩০ শতাংশ চড়া সুদে কারবার! সব দেখেও দুই সরকার নীরব কেন? অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন চিটফান্ডের টাকায় মাইক্রো ফিনান্সে বিনিয়োগ হচ্ছে নাতো? এগুলি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশ মেনে কী ব্যবসা করছে? নাকি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মদতেই চলছে লাগামহীনভাবে গরিবকে শোষণ। অনেকেই অভিযোগ করছেন এই মাইক্রো ফিনান্সে ভাইপোর টাকা খাটছে নাতো? বালি খাদের টাকা, কয়লা, লোহা, গোরু পাচারের টাকাও নাকি খাটছে! এমন অভিযোগও শোনা যাচ্ছে বাতাসে কানপাতলেই। মাইক্রো ফিনান্সের সাথে দেওয়া-নেওয়া’র সম্পর্ক এখন দুই শাসকের। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অবাধে লুট করবে গরিবের টাকা এই নতুন কর্পোরেট মহাজনরা আর তাদের মদত দেবে দুই ফুল। তার বিনিময়ে ভোটের সময় গোপনে এই লুটেরা শক্তি শাসকের মিত্র হয়ে কাজ করবে। তা না হলে প্রকাশ্যে বাউন্সররা বলছে গরিবদের ভিটেয় দাঁড়িয়ে টাকা চাই, কীভাবে শোধ করবে জানি না, মেরে ফেলার হুমকিও দিচ্ছে। গরিব কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ বড়ো অসহায় হয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে তাদের জন্য সে দরজাও বন্ধ।