৫৯ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৯ নভেম্বর, ২০২১ / ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
বিহার বিধানসভা উপনির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে
অরুণ মিশ্র
বিহারের দু’টি উপনির্বাচনের ফলাফল হঠাৎই রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি করেছে। ২০২০ সালে কুশেশ্বরাস্থান এবং তারাপুর— এই দুই বিধানসভা কেন্দ্রেই জনতা দল (সংযুক্ত)জিতেছিল। কোভিড ১৯-এ ওই দুই কেন্দ্রের বিধায়কের মৃত্যু হলে নির্বাচন অনিবার্য হয়ে পড়ে। রাজ্যে ক্ষমতাসীন এনডিএ’র শরিকরা যখন উপনির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ এবং যৌথভাবে লড়াই করেছিল, তখন কংগ্রেস এবং আরজেডি’র মধ্যে ঐক্য বজায় থাকেনি। প্রকাশ্যে ওই দুই পার্টি পরস্পরের বিরুদ্ধে তীব্র দোষারোপ করতে শুরু করেছিল, আর ওই দুই আসনে আরজেডি পরামর্শ না করে প্রার্থী ঘোষণা করায় কংগ্রেস আসরে নেমে আরজেডি-কে দোষারোপ করে। ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের খারাপ ফলাফলের প্রেক্ষিতে বামপন্থী দলগুলি দু’টি আসনেই সর্বসম্মতভাবে আরজেডি-কে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয়। ওই নির্বাচনে কংগ্রেস বরাদ্দ ৭০টি আসনের মধ্যে মাত্র ১৯ টিতে জেতে এবং বিহারে এনডিএ সরকার গঠনের রাস্তা প্রশস্ত করে। বামপন্থীরা যদি বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পেত, তাহলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারত।
জনতা দল (সংযুক্ত)’র উপনির্বাচনের এই জয় ব্যাপক জাঁকজমক করে উদ্যাপন করা হয় এবং তাদের পার্টির মুখপাত্ররা বলতে আরম্ভ করেন যে, বিহার নীতীশ কুমারের মতো ক্যারিশমাওয়ালা নেতা কখনও দেখেনি এবং লালুপ্রসাদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা তাঁর তুলনায় কিছুই নন। এই কানে তালা ধরানো উচ্চগ্রামের প্রচারে বাস্তবিক পরিস্থিতি সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি। মূল ধারার সংবাদমাধ্যম স্বস্তির শ্বাস ফেলে যখন তারা দেখে তারাপুর কেন্দ্রে জেডি(ইউ) প্রার্থী গণনার শেষ পর্বে আরজেডি’র প্রার্থীর চেয়ে তিন হাজার ভোট বেশি পেয়ে এগিয়ে যায়। ততক্ষণে কুশেশ্বরাস্থান কেন্দ্রে জেডিইউ ১০ হাজারেরও বেশি ভোটে জয়ী হয়েছে।
দু’টি কেন্দ্রেই জেডি(ইউ) প্রতিটি পঞ্চায়েতে দলের সমস্ত মন্ত্রী, বিধায়ক এবং সাংসদদের নামিয়ে দিয়ে কোনওক্রমে আসন দু’টি ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে। তখন দু’টি কেন্দ্রেই কংগ্রেস প্রার্থী দেওয়া সত্বেও আরজেডি’র ভোট শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে নির্বাচন খুব ব্যয়সাপেক্ষ এবং যে সমস্ত আঞ্চলিক দল ক্ষমতায় নেই তারা ক্ষমতাসীন দলের তুলনায় আর্থিকভাবে অত্যন্ত হীনবল। কেউই এটা জানতে পারেনি যে, উপনির্বাচনে এই দু’টো আসন ধরে রাখতে কত টাকা খরচ হয়েছে, আধিকারিকরা তাদের রাজনৈতিক প্রভুদের স্বার্থ বজায় রাখতে কী ভূমিকা পালন করেছেন।
বর্তমান সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে যদিও উপনির্বাচনের ফলাফলের কোনো রাজনৈতিক তাৎপর্য নেই, কিন্তু এটা জেডি(ইউ)’র কাছে একটা বলার সুযোগ এনে দিয়েছে যে নীতীশকুমার উন্নয়নের প্রতীক।
জেডি(ইউ)’র এই নির্বাচনী সাফল্য এমন একটা সময়ে এলো যখন নীতি আয়োগের রিপোর্টে নীতীশকুমারের নেতৃত্বে থাকা এনডিএ সরকারের বিহারের উন্নয়নের দাবিগুলির অন্তঃসারশূন্যতাকে তা বেআব্রু করে দিল। এবং এই রিপোর্ট বিহারের তথাকথিত বেশ কয়েক বছরের দুই অঙ্কের জিডিপি বৃদ্ধির হার সত্ত্বেও সামাজিক-অর্থনৈতিক সূচকের ভিত্তিতে শ্লথ উন্নয়নের গতি বিবেচনা করে এই রাজ্যের প্রকৃত অবস্থান রুগণ রাজ্যগুলির মধ্যে সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছে।
কৃষিতে সংকটের দরুন গ্রামীণ যুবকদের দারিদ্র্য, ব্যাপক অপুষ্টি, শিশু মৃত্যু, বৃহৎ সংখ্যায় পরিযায়ী হওয়ার হার, ডিজিটাল বিভাজনের দরুন শিক্ষা থেকে ৮০ শতাংশ শিশুদের বঞ্চিত করা এবং শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য নানা কারণে নীতীশ কুমারের সাধারণ মানুষের ওপর যে প্রভাব তা দুর্বল হয়েছে এবং এর দরুন বিহারে তার দুই শক্তিশালী গড়ে ভোট শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এই ফলাফল আরও একবার দেখিয়ে দিলো যে, কংগ্রেস তার সাংগঠনিক কাঠামো এবং গণভিত্তি হারিয়েছে। তাদের নতুন পাওয়া শক্তি শুধুমাত্র ভুল জায়গায় প্রয়োগ হয়েছে তাই নয়, গোটাটাই নির্ভরশীল ছিল কানহাইয়া কুমার এবং জিগনেশ মেবানির ওপর, যারা নিরলসভাবে এই দু’টো কেন্দ্রে প্রচার চালিয়েছেন। কংগ্রেস এই দুটো কেন্দ্রের একটিতে পাঁচ হাজার এবং আরেকটিতে তিন হাজার ভোট পেয়েছে।