E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৯ নভেম্বর, ২০২১ / ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

ভারতীয় দর্শনের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

বিশ্বম্ভর মণ্ডল


দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ১৯১৮ সালের ১৯ নভেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। দর্শন নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দু’টি ক্ষেত্রেই তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। কবিতা, কিশোর সাহিত্য, ব্যঙ্গরচনা, নানান বিষয়ে বই লিখতে শুরু করে ‘Progressive Writers Association’ (যার নাম পাল্টে পরবর্তীকালে হয়েছিল ‘Anti Fascist Writers Association)-এ যোগ দিয়েছিলেন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, দু’টো বই তাঁকে জগৎ সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোকিত করে - ‘Communist Manifesto’ ও ‘Dialectical and Historical Materialism’। এর আগে অবধি দর্শনচর্চায় তাঁর কোনো নির্দিষ্ট অভিমুখ ছিল না। সাধারণভাবে ভাববাদ খণ্ডন ও বস্তুবাদ প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। এছাড়াও ভবানী সেন, বঙ্কিম মুখার্জি, রাধারমণ মিত্র, সমর সেন প্রমুখের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে থাকতে থাকতে মার্কসীয় দর্শনকে প্রয়োগ করে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনকে ব্যাখ্যা করার কাজে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত হন। তিনি এই সময়ে ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন ধারাগুলোকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে থাকেন এবং ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে বহুল প্রচলিত জনপ্রিয় ধারণাকে পরিবর্তন করতে অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ কালজয়ী অবদান রাখতে শুরু করেন। এরই ফলশ্রুতিতে পরবর্তীকালে তিনি ভারতীয় দর্শন, লোকায়ত দর্শন, বিজ্ঞানের ইতিহাস, ভারতের বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, ভাববাদ খণ্ডন, বিজ্ঞান কী ও কেন?, জানবার কথা (১০টি খণ্ডে) ইত্যাদি শিক্ষামূলক ও চিরায়ত কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন।

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ভারতীয় দর্শনে নিহিত বৈজ্ঞানিক প্রবণতাকে অনুসন্ধান করে এই দর্শন সম্পর্কে প্রচলিত মনোভাবের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে নিজের অবস্থান তুলে ধরেছিলেন। ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে প্রচলিত মনোভাব ছিল মূলত ভাববাদ এবং ঈশ্বরকেন্দ্রিক এবং এই দর্শনকে ধর্মীয় ভাব এবং বিশ্বাসের আধার হিসাবে চিহ্ণিত করা হতো। প্রচলিত এই মনোভাবগুলির বিপ্রতীপে তিনি দেখান যে, ভারতীয় দর্শনে নিহিত রয়েছে বস্তুবাদী, নাস্তিকতা এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা। তিনি ভারতীয় দর্শনের বস্তুবাদী, যুক্তিবাদী, নাস্তিক এবং বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষিতটিকে সজীব বা প্রাণবন্ত দিক হিসাবে চিহ্ণিত করেন এবং ভাববাদী, ভণ্ড, কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রেক্ষিতটিকে নিষ্প্রাণ দিক হিসাবে চিহ্নিত করেন। এই বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা করেন ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত “Lokayata: A Study in Ancient Indian Materialism” গ্রন্থে। এই গ্রন্থটিকে ভারতীয় দর্শনে নিহিত বস্তুবাদীতার আবিষ্কারের একটা সংহত ও অনবদ্য প্রচেষ্টা হিসাবে অনেকেই গণ্য করেন। ভাববাদ সম্পর্কে দেবীপ্রসাদ বলেছিলেন, ‘‘একে দেখতে লাগে শুম্ভ-নিশুম্ভের সেই পৌরাণিক সেনাপতির মতো - যার মাথা কেটে ফেললেই মরণ হয় না কাটা মাথা থেকে ছিটকে পড়া প্রত্যেক রক্তবিন্দু জন্ম দেয় একেকটি সমতুল্য দৈত্যের... মনে হয় ভাববাদ বুঝি মিশরের সেই পাখি, যুগে যুগে নিজের ভগ্নাবশেষ থেকে যে লাভ করে নবজন্ম।’’১ তিনি ভাববাদের মধ্যে দু’টো সত্তার উল্লেখ করেছিলেন - কিছু ভাববাদী চিন্তা কাঠামো রয়েছে, যেগুলি, বস্তুর বাস্তব অস্তিত্বকে অস্বীকার করে; এবং পাশাপাশি তার সাথেই রয়েছে ভাববাদের প্রতিবাদ, যা বস্তুবাদী চিন্তা কাঠামো। তিনি অদ্বৈত-বেদান্ত, যোগাচার বৌদ্ধমত এবং মাধ্যমিক বৌদ্ধমত প্রধানত এই তিনটি চিন্তা গোষ্ঠীকে ভাববাদী রূপে চিহ্নিত করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি ন্যায়–বৈশেষিক, সাংখ্য, পূর্ব মীমাংসা এবং লোকায়ত দার্শনিক ঘরানাকে ভাববাদের প্রতিবাদী ধারা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি এই তিন ঘরানার মধ্যে লোকায়ত ধারাকেই সবথেকে উন্নত প্রতিবাদী ঘরানা রূপে বিবেচনা করেছেন।

কৌটিল্যের মতে লোকায়ত হলো এক অনুসন্ধিৎসা যা জ্ঞানের মাধ্যম রূপে যুক্তিবাদীতাকে গ্রহণ করে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় কৌটিল্য-এর মধ্যে লোকায়ত দর্শনের দৃঢ় সমর্থনকে খুঁজে পেয়েছেন। তিনি ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘Popular Introduction to Indian Philosophy’ গ্রন্থে চার্বাক বা লোকায়ত ধারা ও অদ্বৈত-বেদান্ত ধারাকে যথাক্রমে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন জায়গায় রাখেন। তিনি এইভাবেই ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্যে বস্তুবাদের সম্মানজনক স্থানকে নির্দিষ্ট করেছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘Indian Atheism: A Marxist Analysis’ শীর্ষক গ্রন্থে নাস্তিকতার স্থান ও ভূমিকাকে আলোচনা করেছিলেন ।তিনি ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত ‘What is Living and What is Dead in Indian Philosophy’ গ্রন্থে ভারতীয় দর্শনে নিহিত প্রধান বিতর্কের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর মতে, এই বিতর্কমূলত বস্তুজগতের অস্তিত্ব কেন্দ্রিক। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত ‘Science and Society in Ancient India’ এবং ‘History of Science and Technology in Ancient India’ (vol I, II – 1991 , 1996) গ্রন্থ দু’টিতে যথাক্রমে আয়ুর্বেদ ও মহাকাশ বিদ্যার ধারণা ও ঐতিহ্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। চার্বাক বিরোধীরা চার্বাক দর্শনকে ভোগ-সুখ-ইন্দ্রিয়বাদী রূপে চিহ্নিত করেছেন। তিনি চার্বাক বিরোধীদের এই প্রবণতাকে চার্বাক দর্শনের বিকৃতিসাধনের অপচেষ্টা ব্যতীত আর কিছুই নয় বলে ব্যাখ্যা করেছেন।

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-এর মতে, “কোনো দর্শনে যখন জীবনকে প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং তার নিন্দা করা হয়, তখন বুঝতে হবে জীবন থেকে পালিয়ে গিয়েই এই দর্শনের চর্চা করা হয়েছিল।... উপনিষদের যুগে ভারতে বস্তুগত জগৎকে ধিক্কার জানানো হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল এইগুলি কোনো কিছুই স্থায়ী নয়, এই সবই ছিল ‘বিশুদ্ধ যুক্তি এবং বিশুদ্ধ জ্ঞান’-এর উপর ভিত্তি করে দার্শনিক প্রশ্নগুলি যতদূর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া - এই ধরনের জ্ঞানচর্চা তখনই হয়, যখন সমাজের কোনো একটা অংশ সমাজের বাকি অংশের তৈরি করা উদ্বৃত্ত সম্পদের ওপর নির্ভর করে বেঁচে নিজেদেরকে সরিয়ে নেয় এবং যার ফলে বস্তুগত জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় অথচ একমাত্র শ্রমপ্রক্রিয়াই পারে চেতনা সম্পর্কিত তত্ত্বের উপরে বস্তুগত সংঘাত তৈরি করতে। যে তত্ত্ব প্রয়োগ থেকে বিচ্ছিন্ন তা হয়ে দাঁড়ায় ‘বিশুদ্ধ তত্ত্ব’। এর ফলে চিন্তাপ্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায় নিছকই কতকগুলি ধারণা...”২। ‘‘বস্তুবাদ সম্পর্কে সাধারণ দার্শনিক সমাজের ভঙ্গিটাও লক্ষ করার মতোঃ সাদর সম্ভাষণ তাঁর কপালে কোনদিনই জোটেনি, বরং জুটেছে শুধু প্রতিবন্ধ আর বিড়ম্বনা। যখন সে দুঃসাহসীর মতো বড়ো বেশি দুর্বিনীত হইচই শুরু করেছে, তখন তাঁকে দর্শনের আঙিনার এক কোনায় বড়োজোর একটুখানি আসন করে দেওয়া হয়েছে অস্পৃশ্যের মতো, কিন্তু সেই সঙ্গেই চক্রান্ত পরামর্শ চলেছে, কেমন করে তাঁকে একেবারে একঘরে করে তার ভিটেমাটি পর্যন্ত উচ্ছেদ করা যায়। কখনও বা তাঁকে খোলাখুলি গালাগালি করে একেবারে উচ্ছন্নে পাঠানোর ব্যবস্থা, কখনও বা তাকে সংস্কার করে জাতে তুলে নেওয়ার অজুহাতে একেবারে সর্বস্বান্ত করে দেবার কৌশল’’৩ নেওয়া হয়েছে।

প্রচ্ছন্ন ভাববাদী, বর্ণচোরা ভাববাদীর ছড়াছড়ি। যুগে যুগে মানুষ মুক্তি পায়নি ভাববাদের সম্মোহনী দাসত্ব আর একচ্ছত্র আধিপত্য থেকে। তাঁর মতে, ‘‘এতদিন ধরে এমনিতরো ঘটনা না ঘটে যেন উপায়ই ছিল না! কেননা যাকে আমরা ‘দর্শন’ বলে মেনেছি, তার জন্ম শ্রেণিবিভক্ত সমাজের গর্ভে, সে লালিত হয়েছে শ্রেণিবিভক্ত সমাজের ক্রোড়ে, তার দেহ থেকে শ্রেণিবিভাগের চিহ্ন মোছা যাবে কেমন করে? ভাববাদ বা চেতন-কারনবাদ- সেই শ্রেণিবিভাগের চিহ্ন! সমাজে শ্রেণিবিভাগকে উচ্ছেদ না করলে তাই ভাববাদের হাত থেকে মুক্তি পাবার প্রশ্ন ওঠেনা’’৪। উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনার সিদ্ধান্ত হিসাবে বলা যায়, দেবীপ্রসাদ ভারতের দর্শনের বিভিন্ন ধারার নির্মোহ পর্যালোচনা করেছেন। তিনি প্রাচীন ভারতের ভাববাদী দর্শনের শিকড় সন্ধান করেছিলেন এবং ব্যাখ্যা করেছিলেন কীভাবে ভারতীয় দর্শনে বস্তুবাদী দর্শনের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছিল।


তথ্যসূত্রঃ
১। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভাববাদ খণ্ডন - মার্কসীয় দর্শনের পটভূমি, অনুষ্টুপ, কলকাতা, ১৯৫৪, পৃঃ-১
২। www.khaboronline.com, ২৬.১২.১৯
৩। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ-২৭
৪। তদেব, পৃঃ-৩১