৫৯ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৯ নভেম্বর, ২০২১ / ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
তাহেরপুর
বামফ্রন্টের নেতৃত্বে এগিয়ে চলার কাহিনি
সুপ্রতীপ রায়
তাহেরপুর পশ্চিমবাংলার উদ্বাস্তু অধ্যুষিত এলাকাগুলির মধ্যে অন্যতম। লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে একটি এলাকাকে যে কীভাবে গড়ে তোলা যায়, তার প্রমাণ তাহেরপুর কলোনি। ২০১৫ সালের পৌরসভা নির্বাচনে তাহেরপুর পৌরবোর্ড পরিচালনার দায়িত্ব পায় বামফ্রন্ট। ১৯৯৫ সাল থেকে (মাঝের কয়েকটি বছর বাদ দিলে) ধারাবাহিকভাবেই বোর্ড পরিচালনা করে এসেছে বামফ্রন্ট। বর্তমানে পৌর প্রশাসকমণ্ডলী কাজ পরিচালনা করছে।
আমরা জানি ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতে আসা শরণার্থীদের আগমন চলতে থাকে। লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভারতে আসতে থাকে। পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন ত্রাণ শিবিরে তারা নিদারুণ কষ্টের মধ্যে থাকতে বাধ্য হয়। দেশভাগ হওয়ার পর মোট এক কোটি ২০ লাখ মানুষ ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় শরণার্থী হিসাবে থেকে গেল। মাথা গোঁজার জায়গা হিসাবে পরিত্যক্ত ফাঁকা জমিতে তাঁরা গড়ে তোলেন জবর-দখল কলোনি।
এখানে উল্লেখ্য যে, দেশভাগের ফলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতে শরণার্থী আসতে থাকেন দলে দলে। শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৮ লক্ষ। দু’বছরের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের পুনর্বাসনের কাজ সম্পূর্ণ করে। এর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ব্যয় করেছিল ৪৫৬ কোটি টাকা এবং পাকিস্তানে তাদের ফেলে আসা সম্পত্তির জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ অতিরিক্ত ১৯১ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করে ভারত সরকার। ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবাংলায় প্রথম যুক্তফ্রন্টের সরকার কেন্দ্রের কাছে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য ২৫০ কোটি টাকার একটি প্রস্তাব পেশ করে। ১৯৭৭ সালে রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার ষষ্ঠ পরিকল্পনা কমিশনের কাছে পুনর্বাসনের জন্য ৫০০ কোটি টাকা দাবি পেশ করে।
পরবর্তীকালে সমর মুখার্জির নেতৃত্বে ১০ সদস্যযুক্ত পুনর্বাসন কমিটি নিযুক্ত হয়। কমিটি ৩১ আগস্ট, ১৯৮১ রিপোর্ট পেশ করে। পুনর্বাসন কমিটির সুপারিশ অনুসারে কেন্দ্রের কাছে বামফ্রন্ট সরকার ৭৫০ কোটি টাকার প্রস্তাব পাঠায়। ১৯৯৪ সালে রাজ্যের উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে রাজ্য সরকার ১,৭২৬ কোটি টাকা দাবি পেশ করে।
বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার মতো ব্যক্তিও বারংবার কেন্দ্রের কাছে পশ্চিমবাংলার উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের জন্য আবেদন করেও সাড়া পাননি। পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের জন্য ধারাবাহিক লড়াই করে এসেছেন বামপন্থীরা। ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। রাজ্যের বামপন্থী নেতৃত্বের উপস্থিতিতে ১৯৫০ সালের ১২ আগস্ট গঠিত হয় 'সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ' (UCRC) উদ্বাস্তুদের প্রতি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে ১৯৫১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতা ময়দানে সুবিশাল সমাবেশ হয়। জ্যোতি বসু ওই সমাবেশে ঐতিহাসিক বক্তব্য রাখেন।
তাহেরপুর কলোনি প্রতিষ্ঠার ইতিহাস রয়েছে। ১৯৫১ সালের ৩ এপ্রিল ধুবুলিয়া থেকে উদ্বাস্তুদের নিয়ে একটি রিলিফ ট্রেন বীরনগর স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। উদ্বাস্তুদের আগেই জানানো হয়েছিল বীরনগরে তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। স্থায়ী ঠিকানা একটা পাওয়া যাবে, এটা জেনে উদ্বাস্তুরা খুশি হলেন। কিন্তু এই খুশি বেশিক্ষণের জন্য ছিল না। কারণ কিছুক্ষণ পরেই জানানো হলো - বীরনগর নয়, তাহেরপুরে তাঁদের জন্য ‘শহর’ তৈরি হয়েছে।, খোলা ট্রাকে করে উদ্বাস্তুদের তাহেরপুর কলোনিতে এনে ফেলা হলো। পাণ্ডববর্জিত এলাকা ধুধু মাঠ, ধুলো আর জঙ্গল, হাট-বাজার নেই। ছিল নবাবি আমলের বৃক্ষের জঙ্গলে আচ্ছাদিত ভগ্নপ্রায় একটি রাস্তা ও স্টেশনহীন রেলপথ।
১৯৫১ সালের এপ্রিলে তাহেরপুর আরবান কলোনির গোড়াপত্তন হয় ধুবুলিয়া, কুপার্স ক্যাম্প, মেদিনীপুরের দুধকণ্ঠী ক্যাম্পের উদ্বাস্তুদের নিয়ে। দুঃসহ ক্যাম্প নামক লঙ্গরখানায় অনভ্যস্ত জীবনের অখাদ্য কুখাদ্য গ্রহণ করে জীবনমৃত মানুষগুলোর চোখের জল আর শুকোনোর অবকাশ পেলো না। কতজনের আপনজনেরা প্রায় বিনা চিকিৎসায় চোখের সামনে ধুঁকতে ধুঁকতে শেষ হয়ে গেল।
কলোনিতে যাঁদের ঠাঁই হলো, তাঁরা পেলেন সাড়ে বাইশ টাকা ঋণ। হাউস-বিল্ডিং আর স্মল ট্রেডিং অর্থাৎ গৃহ নির্মাণ আর ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য সাকুল্যে ২,২৫০ টাকা ঋণ। চাল ফুটিয়ে নেবে এমন সামর্থ্য যাঁদের নেই, তাঁরা শোধ করবেন যৎসামান্য টাকায় ব্যবসা করে! উদ্বাস্তু মানুষদের কপালে জুটলো ‘বাঙ্গাল’ তক্মা।
যাই হোক তাহেরপুরের পরিশ্রমী, সংগ্রামী মানুষ নিজের তাগিদেই স্থাপন করলেন বাজার, বিদ্যালয়, ডাক্তারখানা, কিছু রাস্তা। উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের দাবিতে ইউসিআরসি এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে গণ-আন্দোলন গড়ে উঠলো।
আন্দোলন, সংগ্রাম চলতে থাকল। প্রতিষ্ঠিত হলো যুক্তফ্রন্ট সরকার। তাহেরপুরের মানুষ যুক্তফ্রন্ট সরকারকে জানালেন, ‘টাউন স্কিমে’ তাহেরপুর গড়ে দেবার নামে কেন্দ্রীয় সরকার তাহেরপুরের উদ্বাস্তুদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। কোনো উন্নয়ন নেই। তাহেরপুরের বেহাল অবস্থা দেখে তৎকালীন পৌরমন্ত্রী ঘোষণা করলেন তাহেরপুরকে পৌরসভা ঘোষণা করা হবে। কিন্তু অগণতান্ত্রিক উপায়ে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ভেঙে দেওয়া হলো। ১৯৭২-১৯৭৭ পর্যন্ত ধারাবাহিক আন্দোলন, রক্ত, অশ্রু, আত্মবলিদানের বিনিময়ে গড়ে উঠল বামফ্রন্ট সরকার।
উদ্বাস্তুদের নিয়ে লড়াই করার মতো একমাত্র নীতি, সদিচ্ছা-সামর্থ্য সবকিছুই যাদের আছে, সেই বামপন্থীরাই অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে ১৯৭৭ সালে রাজ্যের ক্ষমতায় এসেই প্রথমে কলোনির উদ্বাস্তুদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে অসম্মানজনক লিজ ব্যবস্থাকে তুলে দিয়ে। ১৯৮৭ সালে শুরু হয় নিঃশর্ত দলিল বিলির কাজ।
পলিক্লিনিক
বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাহেরপুরে পৌরসভা প্রতিষ্ঠা করার জন্য শুরু হলো সংগ্রাম - নেতৃত্বে সিপিআই(এম)। ১৯৯৩ সালের ১১ জুন এক আদেশবলে তাহেরপুরকে 'নোটিফায়েড এরিয়া' বলে ঘোষণা করা হয়।
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ১৯৭৭ সালে আমাদের রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হওয়ার পর উদ্বাস্তু কলোনিগুলির উন্নয়ন ঘটতে থাকে। তাহেরপুর কলোনি এলাকাতেও উন্নয়ন ঘটতে থাকে। বামফ্রন্ট সরকার প্রথম থেকেই উদ্বাস্তু কলোনিতে বসবাসকারী উদ্বাস্তুদের জমির স্বত্ব সহ উন্নয়ন প্রভৃতি দাবি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করে।
বামফ্রন্ট সরকার রাজ্য সরকারের জমিতে গড়ে-ওঠা কলোনিগুলিতে উদ্বাস্তুদের জমির স্থায়ী স্বত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৮৬ সালে বরাহনগর নেতাজিনগর কলোনিতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু প্রথম উদ্বাস্তুদের জমির স্থায়ী স্বত্বের দলিল প্রদানের সূচনা করেন। আমাদের স্মরণে রাখা দরকার, ১৯৫১ সালে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার উচ্ছেদ আইন বিধিবদ্ধ করে জবর-দখল কলোনিগুলি থেকে বলপ্রয়োগের সাহায্যে উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা করেছিল।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বিভিন্ন উদ্বাস্তু কলোনিতে বসবাসকারী প্রায় তিন লক্ষ উদ্বাস্তু পরিবার জমির পাট্টা পেয়েছেন। ২০০৪ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রাজ্যে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য ন্যূনতম ৫ হাজার ১০ কোটি ৬০ লক্ষ টাকার প্রকল্পের দাবি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে করেছিলেন। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ৩০ লক্ষাধিক কৃষক পেয়েছে ১১ লক্ষ ৩০ হাজার একরেরও বেশি জমি। ১৫ লক্ষাধিক বর্গাদারের নাম নথিভুক্ত হয়েছে। এর এক উল্লেখযোগ্য অংশ উদ্বাস্তু।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে শিক্ষা বিস্তারে, শিল্প বিস্তারে, পৌর উন্নয়নে, স্বাস্থ্য পরিষেবার অগ্রগতিতে পশ্চিমবাংলার উদ্বাস্তুদের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তর উদ্বাস্তু জীবনের দুঃখকষ্ট লাঘবের চেষ্টা করেছে। প্রতি বছর ওই দপ্তরের ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের বরাদ্দ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। ২০১০-১১ সালে ব্যয়-বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৭ কোটি একাশি লক্ষ আটানব্বই হাজার টাকা। বিভিন্ন স্বীকৃত কলোনি এবং তার বাইরে হাজারের ওপর কলোনিবাসীর জীবনকে যন্ত্রণামুক্ত করার ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকার প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছিল।
সারা দেশের মধ্যে পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্ট সরকারই প্রথম শহরে বসবাসকারী গরিব মানুষের জন্য মাত্র ১ টাকার বিনিময়ে ৯৯ বছরের লিজে বাস্তু জমি প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। বস্তিবাসীদের জন্য জওহরলাল নেহরু আরবান রিনিউয়াল মিশন প্রকল্পে (জেএনএনইউআরএম) প্রায় ২ লক্ষ আবাসন প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে এনেছিল। এছাড়া বামফ্রন্ট সরকার একই ধরনের বাসগৃহ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছিল।
তাহেরপুর পৌরসভার মর্যাদা পাওয়ার পর মাঝের কয়েকটি বছর বাদ দিলে বামফ্রন্ট পৌরসভা পরিচালনা করছে। বামফ্রন্ট পরিচালিত পৌরসভা ধারাবাহিক উন্নয়নের নজির স্থাপন করেছে। গত পাঁচ বছর (২০১৫-২০২০) রাজ্য সরকারের বঞ্চনা, প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও উন্নয়ন করার প্রচেষ্টা বর্তমান বামফ্রন্ট পরিচালিত বোর্ড করে চলেছে।
বামফ্রন্ট সরকারের নীতির ফলেই ৩৪ বছরে (বামফ্রন্ট সরকারের অবস্থানের সময়) তাহেরপুর শহরে উন্নয়ন ঘটেছিল। বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যের বড়ো বড়ো শহরের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্ব দিয়েছিল ছোটো ও মাঝারি শহরগুলির প্রতি। বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কার নীতির ফলে বহু গঞ্জ শহরে পরিণত হয়। তাহেরপুর তার প্রমাণ। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ৩৫টি নতুন পৌরসভা, ৫টি নতুন পৌর কর্পোরেশন এবং বেশ কয়েকটি নোটিফায়েড অথরিটি গঠিত হয়। বামফ্রন্ট সরকারের নীতির ফলেই ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ৭৪০টি সেন্সাস টাউনের আত্মপ্রকাশ ঘটে - যা ভারতের মধ্যে সর্বাধিক।
বামফ্রন্ট পরিচালিত তাহেরপুর পৌরসভা পৌর প্রশাসনকে অনেক বেশি দায়বদ্ধ, স্বচ্ছ, গতিশীল ও দায়িত্বশীল করেছে। ২০১৫-র নির্বাচনে ১৩টি আসনের মধ্যে আটটি আসনে বামফ্রন্ট জয়যুক্ত হয়। আট জন কাউন্সিলারের বিরুদ্ধে এক পয়সা দুর্নীতির অভিযোগ নেই। আট জন বাম কাউন্সিলরকে অর্থের লোভ দেখিয়ে, চাপ সৃষ্টি করে দলত্যাগে তৃণমূল বাধ্য করতে পারেনি। পৌরসভার কাজকে গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক করার সাথে সাথে প্রশাসনে ও পরিষেবা প্রদানে দ্রুতগতিতে কাজ করতে বা নাগরিক হয়রানি হ্রাস করতে কম্পিউটারাইজেশন, জিআইএস, ই-গভর্নেন্সের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
বামফ্রন্ট পরিচালিত তাহেরপুর পৌরসভা উন্নয়নের কাজে অগ্রাধিকার দিয়েছে গরিব শহরবাসীর জীবনের মান উন্নত করার লক্ষ্যে, দারিদ্র্য প্রশমনের স্বার্থে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুস্থ ও দূষণহীন পরিবেশে বসবাস ইত্যাদি পৌরসভার কাজে প্রাধান্য পেয়েছে। পৌরসভাকে যুক্ত করা হয়েছে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, সামাজিক সহ বিভিন্ন মানব উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে। পরিকল্পনা তৈরি করার ক্ষেত্রে নাগরিকরা নিজের মতামত দেবার সুযোগ পান। উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি, অগ্রাধিকারের তালিকা তৈরি এবং এগুলি বাস্তবায়নের সঙ্গে নাগরিকরাও যুক্ত।
পৌরসভা পরিচালনায় গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ, নাগরিকদের প্রতি দায়বদ্ধতা, সততা, স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণধর্মী নীতি নিয়ে চলেছে। গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষদের পৌর-কর, ট্রেড লাইসেন্স, পবিষেবা, গৃহ নির্মাণ পরিকল্পনা অনুমোদন প্রভৃতি ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব ছাড় ও রেহাই দেওয়া হয়েছে। যত বেশি সংখ্যক মানুষকে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় আনার চেষ্টা করা হয়েছে। মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য, সার্বিক স্বাস্থ্য, স্বনিযুক্ত কর্মপ্রকল্প, স্বল্প সঞ্চয় গ্রুপগুলিকে শক্তিশালী করে তোলা হয়েছে।
প্রায় নিঃশব্দেই এক উদ্বাস্তু কলোনি তার যাবতীয় মলিনতা মুছে দিয়ে ধীরে ধীরে আমাদের চোখের সামনেই উঠে দাঁড়িয়েছে। তাহেরপুরের জন্য আজ আমাদের গর্বের অন্ত নেই।
তাহেরপুর প্রজ্ঞাপিত এলাকা ঘোষিত হওয়ার পর মাত্র আড়াই দশকের মধ্যেই তাহেরপুর সমস্ত সুযোগ-সুবিধা সহ পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য পরিচ্ছন্ন শহর হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। উজ্জ্বল আলো-ঝলমলে ঝাঁ-চকচকে পাকা রাস্তা, নলবাহিত পানীয় জল, ব্লকে ব্লকে কমিউনিটি হল, আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ত্রিতল উৎসব ভবন, পুকুর সহ বিশাল বিনোদন পার্ক, ক্রীড়াঙ্গন, রবিতীর্থ - আজ আধুনিক শহরের উপযোগী সমস্ত সুবিধাই পাওয়া যাচ্ছে তাহেরপুরে। উদ্বাস্তু মানুষগুলো এবং তাঁদের সন্তান-সন্ততিরা পেয়েছে একান্ত নিজস্ব আশ্রয়।
কোনো একটি শহরের উন্নয়নের জন্য চাই সুচিন্তিত এবং সমকালকে অতিক্রম করতে পারে, এমন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সমকালের চাহিদা উপযোগী স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা। আবার এই পরিকল্পনায় সমাজের সমগ্র অংশের মানুষের চিন্তা, আবেগ ও প্রয়োজনের প্রতিফলন থাকা চাই। এমন পরিকল্পনাই পারে কোনো সমাজের সমস্ত অংশের মানুষের প্রকৃত মঙ্গল করতে।
তাহেরপুর প্রজ্ঞাপিত অঞ্চল কর্তৃপক্ষের বর্তমান বোর্ড তাহেরপুরের নাগরিকদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করে তাঁদের আশা, চাহিদা, আবেগকে মর্যাদা দিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা রচনা করেছে এবং ধীরে ধীরে এই পরিকল্পনা তাহেরপুরে রূপ পেয়েছে।
তাহেরপুরের রাস্তাগুলিকে সংস্কারের ব্যাপক উদ্যোগ এই সময়ে নেওয়া হয়েছে। রাস্তাগুলিকে সর্বাঙ্গীণ সুন্দর করা হয়েছে। ৫৬ কিলোমিটারের ওপর রাস্তাকে পাকা করা হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাহেরপুরে সমস্ত বাড়িতে এবং রাস্তায় বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলিতে উচ্চ আলোকস্তম্ভ, মাঝারি আলোকস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। তাহেরপুরের প্রতিটি রাস্তার মোড়ে এলইডি লাইট লাগানো হয়েছে। সমস্ত পোলে এলইডি লাইট লাগানো হয়েছে।
তাহেরপুর এলাকার শিশুদের সার্বিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের লক্ষ্যে এবং তাদের সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে শিশু উদ্যান সংস্কার ও সম্প্রসারণ করেছে। বর্তমান শিশু উদ্যানগুলি শিশুদের কাছে আগ্রহের সঞ্চার করেছে। তাহেরপুর প্রজ্ঞাপিত অঞ্চল কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক ভবন আমাদের জেলার গর্ব। একই ছাদের তলায় নাগরিকদের সমস্তরকম প্রশাসনিক পরিষেবা এখান থেকে দেওয়া হয়। এটির ত্রিতলে একটি আধুনিক সভাগৃহ নির্মিত হয়েছে।
নাগরিক পরিষেবার অন্যতম অঙ্গ কমিউনিটি হল। ১৩টি ওয়ার্ডেই কমিউনিটি হল নির্মিত হয়েছে। তাহেরপুরে প্রয়োজন ছিল আধুনিক স্টেডিয়ামের। সেই স্টেডিয়ামের কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। রাজ্য সরকারের পূর্ণ সহযোগিতা পেলে স্টেডিয়ামের কাজ সম্পূর্ণ হতো। অতি সম্প্রতি অত্যাধুনিক মাল্টিজিম চালু হয়েছে।
তাহেরপুরের ‘সুপার মার্কেট’ ও ‘সবজি মার্কেট’ পৌরসভার উদ্যোগেই চালু হয়েছে। ২০০৫ সালে এটি চালু হয়। এটিকে আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত জল সরবরাহ ব্যবস্থা শহরের প্রতিটি পরিবারের জন্য করা হয়েছে। নামমাত্র খরচে নলবাহিত জলের সংযোগ ইতিমধ্যে ৩০০০ পরিবারকে দেওয়া হয়েছে।
এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল শ্মশান নির্মাণ। সমস্ত সুবিধাযুক্ত শ্মশানের দাবি ছিল মানুষের। সাড়ে ১১ বিঘা জমির উপর পৌরসভার উদ্যোগে শ্মশান নির্মিত হয়েছে। শ্মশানে অতিরিক্ত একটি চুল্লি, সোপপিট ও পাকাঘাট নির্মাণ করা হয়েছে।
অত্যাধুনিক 'নীলাঞ্জনা' হল
এই শহরের অন্যতম অহংকার 'নীলাঞ্জনা উৎসব ভবন'। পৌরসভার উদ্যোগে অত্যাধুনিক এই উৎসব ভবনটি। সম্প্রতি ‘নীলাঞ্জনা’র তৃতীয়তলে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত অতিথি নিবাস সম্পন্ন করা হয়েছে। জ্যোতি বসু স্মৃতি কমিউনিটি লাইব্রেরির মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা সুবিধা পায়। সি ব্লক ১৬ নম্বর রাস্তায় নেতাজি পার্কের সামনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মর্মর মূর্তি সহ 'রবিতীর্থ' প্রাঙ্গণ নির্মাণ করা হয়েছে। শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে সাতটি অ্যানিমেল পেন, চারটি রিক্সা স্ট্যান্ড নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে বাসযাত্রী প্রতীক্ষালয়।
তাহেরপুর পৌরসভা ‘শিশুদের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি’ এবং ‘সবার জন্য শিক্ষা’ এই স্লোগান সামনে রেখে ধারাবাহিক ও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এক বলিষ্ঠ ও উন্নততর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার লক্ষ্যে। শিশুশ্রমিকদের পড়াশোনার জন্য শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে।
তাহেরপুর পিকনিক গার্ডেন
তাহেরপুর পৌরসভার পরিচালনায় ‘জ্যোতি কিরণ উদ্যান’ গড়ে তোলা হয়েছে। অনাদরে পড়ে থাকা বটপুকুর সংস্কার করে তার চারপাশের পতিত জমির ওপর (১০ একর) গড়ে তোলা হয় ‘জ্যোতি কিরণ উদ্যান’। এখানে শিশুদের জন্য দোলনা, স্লাইড, মেরিগো সহ নানা ব্যবস্থা আছে। পিকনিক গার্ডেনে ভ্রমণার্থীদের সুবিধার জন্য চারটি সুসজ্জিত শেড তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি শিশু শিক্ষাকেন্দ্রের জন্য পাকা গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে।
তাহেরপুর সি ব্লকের ১৬ নম্বর রাস্তায় নেতাজি পার্কের সম্মুখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মর্মর মূর্তি সহ 'রবিতীর্থ' প্রাঙ্গণ নির্মাণ করা হয়েছে। ১ নম্বর ওয়ার্ডে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মর্মর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। তাহেরপুর সবজি বাজারের দ্বিতল সংস্কার করে বহু-প্রতীক্ষিত 'স্টেট ব্যাঙ্ক' স্থাপনে সহযোগিতা করেছে পৌরসভা। 'হাউসিং ফর অল' প্রকল্পে স্বচ্ছতার সঙ্গে গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে।
রাজ্য সরকারের ধারাবাহিক বঞ্চনা, বিমাতৃসুলভ আচরণের শিকার বামফ্রন্ট পরিচালিত এই তাহেরপুর পৌরসভা। আজ রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে রাজ্য সরকার। তৃণমূলের আমলে পৌর ও নগরোন্নয়ন দপ্তর নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে না। বামফ্রন্ট সরকারের সময় নীতি, পরিকল্পনা দৃষ্টিভঙ্গি, দায়বদ্ধতা, সততা ও স্বচ্ছতার নীতিকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে।