৫৯ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৯ নভেম্বর, ২০২১ / ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
ত্রিপুরার চিঠি
বিজেপি শাসনে ত্রিপুরায় সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিক আক্রান্ত
নিন্দা ও প্রতিবাদ বামপন্থীদের
হারাধন দেবনাথ
ত্রিপুরায় প্রতিদিন গণতন্ত্র ধর্ষিত হচ্ছে। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যম আক্রান্ত। প্রথমে ‘ডেইলি দেশের কথা’ পত্রিকা আক্রান্ত হয়। সাংবাদিক, সংবাদকর্মী এমনকী ‘ডেইলি দেশের কথা’ পত্রিকার হকার পর্যন্ত আক্রান্ত হয়। গাড়ি করে পত্রিকা পাঠাতেও বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। বার কয়েক পত্রিকার বাণ্ডিল জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর ‘ডেইলি দেশের কথা’র প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল জেলা শাসকের আদেশে। কোর্টের অন্তবর্তী আদেশে পত্রিকা ১০ দিন পর চালু হয়।
শুরুতে ডেইলি দেশের কথা পত্রিকা আক্রান্ত হলেও সরকার বিরোধী, জনগণের স্বার্থে কথা বলার দায়ে বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যম ‘আকাশ ত্রিপুরা’, ‘চ্যানেল দিনরাত’ মৃণালিনী ই এন এন, পি বি ২৪ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারের সমালোচনা করে সংবাদ পরিবেশন করায় ডেইলি দেশের কথা সহ অন্য একটি পত্রিকা দপ্তরে হামলা করেছে গেরুয়াবাহিনী। আরও কয়েকটি পত্রিকার বেশ কয়েকজন সাংবাদিক দৈহিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিলিতি মদের দোকানের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় খোয়াই প্রেস ক্লাবের সভাপতি আক্রান্ত হয়েছেন। কার্যত অলিখিতভাবে ফরমান জারি করা হয়েছে বিজেপি-র বিরুদ্ধে কিছু লেখা যাবে না। এককথায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিপন্ন।
সর্বশেষ দিল্লি থেকে আসা দু’জন মহিলা সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন। এই ঘটনায় আসাম পুলিশের নামও জড়িয়েছে। ত্রিপুরা পুলিশের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৬ নম্বর ধারা ভঙ্গের অভিযোগ তুলেছে দিল্লির এইচ ডব্লিউ নিউজ নেটওয়ার্ক নামের একটি ওয়েব পোর্টাল। ওই সংবাদমাধ্যমের দুই সাংবাদিক সমৃদ্ধি সাকুনিয়া (২৫) ও স্বর্ণা ঝা (২৪) আসামের করিমগঞ্জ জেলার নিলামবাজার থানায় বসে জানান, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর মৌলবাদীদের হামলা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুরের ঘটনার পাল্টা হিসেবে ত্রিপুরায় সংখ্যালঘু মুসলিমদের ঘরবাড়ি, মসজিদ জ্বালিয়ে দেওয়া, দোকান ভাঙচুর ইত্যাদি সংঘটিত করে বিশ্বহিন্দু পরিষদ ও বজরঙ দল। এই ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে এক সপ্তাহ আগে দিল্লি থেকে তাঁরা দুইজন ত্রিপুরা আসেন। রাজ্যের যেখানে যেখানে সাম্প্রদায়িক হিংসা সংঘটিত হয়েছে, সেসব এলাকা ঘুরে তারা ছবি ও ভিডিয়ো তুলে তা তাদের চ্যানেলে পাঠিয়েছেন। তাদের পাঠানো প্রতিবেদন ধারাবাহিকভাবে প্রচার করেছে এইচ ডব্লিউ নিউজ নেটওয়ার্ক। সাম্প্রদায়িক হিংসা বন্ধ করতে ত্রিপুরার বিজেপি সরকার যে ব্যর্থ হয়েছে, তাও তাদের চ্যানেলে প্রচারিত হয়। বিপ্লব দেব সরকারের আইনের শাসন বেআব্রু হওয়ায় সাংবাদিকদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। দুই সাংবাদিক বলেন, আগরতলা হোটেলে একদল পুলিশ এসে তাদের হাতে একটি এফআইআর ধরিয়ে দেয়। কিন্তু ওয়ারেন্ট দেখাতে পারেনি। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, সম্প্রীতি বিনষ্ট, সরকারের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো ইত্যাদির অভিযোগ এনে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০ (বি), ১৫৩ (এ) ও ৫০৪ ধারায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে ত্রিপুরা পুলিশ। জানা গেছে, তাদের সংগঠনের নামে মিথ্যা প্রচার করার অভিযোগ তুলে ত্রিপুরার ঊনকোটি জেলার ফটিকরায় থানায় ওই দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন কাঞ্চন দাস নামের বিশ্বহিন্দু পরিষদের এক কর্মী। এই মামলা পেয়ে তৎক্ষণাৎ এফআইআর করে পুলিশ।
সাংবাদিকদ্বয়ের হাতে এফআইআর কপি তুলে দিয়ে গত এক সপ্তাহের তাদের রিপোর্টের কপি দেখাতে বলে পুলিশ। কিন্তু তা পুলিশকে দেখাতে বাধ্য নয় বলে সাফ জানান সাংবাদিকরা। এরপর পুলিশ চলে যায়। পুলিশ চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর একটি গাড়ি করে আগরতলা থেকে আসামের শিলচর বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন দুই সাংবাদিক। শিলচর থেকে দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গাড়ি করে আসামের করিমগঞ্জ জেলায় ঢোকার পর নিলামবাজার পুলিশ তাদের আটক করে থানায় নিয়ে আসে। নিলামবাজার পুলিশ সাংবাদিকদ্বয়কে জানায় তারা তাদের গ্রেপ্তার করেনি, আটক করে রেখেছে। ত্রিপুরার গোমতী জেলার পুলিশ সুপার এসে তাদের নিয়ে যাবেন। ত্রিপুরার একদল পুলিশ নিলামবাজার থানায় এসে আটক সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে চায়। তখনই স্থানীয় সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের বাধার মুখে পড়ে ত্রিপুরা পুলিশ। কারণ, সন্ধ্যার পর মহিলাদের গ্রেপ্তার করা বেআইনি। এমনকী গ্রেপ্তার করার কোনো ওয়ারেন্ট দেখাতে পারেনি পুলিশ। ক্ষোভের মুখে পড়ে পিছু হঠে ত্রিপুরা পুলিশ। সাংবাদিকদের আইনি সহায়তা করতে কয়েকজন আইনজীবী এগিয়ে এসেছেন।
এই ঘটনার কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছেন সিপিআই(এম) ত্রিপুরা রাজ্য কমিটির সম্পাদক জীতেন্দ্র চৌধুরী। তিনি জানান, বিজেপি শাসনে ত্রিপুরায় আইনের শাসন প্রায় ভেঙে পড়েছে। সরকারের ব্যর্থতার দিক যে সব সাংবাদিক তথ্যনিষ্ঠ সহকারে প্রকাশ ও প্রচার করছেন, তাদের উপর দমন-পীড়ন নামিয়ে এনেছে বিজেপি সরকার। সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনায় ১০২ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে ত্রিপুরা পুলিশ। এদের মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক, আইনজীবী ও বিশিষ্টজনেরা। তিনি বলেন, দিল্লির দুই মহিলা সাংবাদিক ত্রিপুরার বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরায় তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে সরকার। সাংবাদিকদের উপর দমন-পীড়ন চালিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা ধামাচাপা দিতে পারবেন না বিপ্লব দেব সরকার, বলেন চৌধুরী।
সাম্প্রদায়িক হিংসার খবর সংগ্রহ করতে যাওয়া দুই মহিলা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ত্রিপুরা পুলিশের দায়ের করা দুটি এফআইআর অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটি।
এক বিবৃতিতে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, একটি সংবাদ পোর্টালের সাংবাদিক সমৃদ্ধি কে সাকুনিয়া এবং স্বর্ণা ঝা গিয়েছিলেন ত্রিপুরায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হিংসার খবর সংগ্রহ করতে। সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, তাঁরা ফিরে আসার পথে আসাম পুলিশ তাদের আটক করে সংবাদ পোর্টালে সাম্প্রদায়িক হিংসার খবর পোস্ট করার অভিযোগে। ত্রিপুরা পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে দুটি এফআইআর দায়ের করে এবং ত্রিপুরায় নিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। পরে অবশ্য আদালত তাদের জামিনে মুক্তি দেয়।
এআইডিডব্লিউএ বলেছে, এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করল আসাম ও ত্রিপুরার বিজেপি সরকারের গণতন্ত্র, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বাক্ স্বাধীনতার প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। সংগঠন মনে করে দুই মহিলা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যা ঘটেছে তা মহিলাদের অবাধে কাজ করার অধিকারের উপর আক্রমণ। কিছুদিন পূর্বে সুপ্রিম কোর্টের একদল আইনজীবী ঘটনার তথ্য জানতে গেলে ত্রিপুরা সরকার তাদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ আইনে মামলা দায়ের করে। মহিলা সমিতি অবিলম্বে মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকদের সম্ভ্রস্ত করার এই কৌশলের অবসান এবং দুই মহিলা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে রুজু করা এফআইআর প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।