৫৯ বর্ষ ২ সংখ্যা / ২০ আগস্ট, ২০২১ / ৩ ভাদ্র, ১৪২৮
কলকাতা জেলা স্থায়ী পার্টি স্কুলে আলোচনাসভা
‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং: ফিরে দেখা’
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ দেশজুড়ে শুরু হয়েছে স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ উদ্যাপন। যদিও আমাদের দেশে এই ‘স্বাধীনতা’ একা আসেনি, একথা কারই বা অজানা? এসেছিল দাঙ্গার বীভৎসতায়, দেশভাগের যন্ত্রণায়। সেই স্মৃতি মুছে ফেলা তো যায়ইনি, যাওয়া সম্ভবও নয়। তদুপরি সেই ক্ষতে খোঁচা দিয়ে আজও ধর্মজিগিরে রাজনীতির রুটি সেঁকে হিন্দুত্ববাদীরা। সেই লক্ষ্যেই মোদী-শাহরা ১৪ আগস্ট দিনটিকে ‘দেশভাগের বীভৎসতা স্মরণ দিবস’ হিসেবে পালনের পরিকল্পনা করেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের তরফে পরিকল্পনামাফিকভাবে এইবছর এভাবেই পালন করা হয়েছে দিনটিকে। দেশবাসীর চেতনায় উসকে তুলতে চাওয়া হয়েছে ভয়ের স্মৃতি, দেশভাগের একচোখা বিকৃত ইতিহাস।
এই প্রেক্ষাপটেই এদিন ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং: ফিরে দেখা’ শীর্ষক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ জে সি বোস রোডে সিপিআই(এম) কলকাতা জেলা কমিটির স্থায়ী পার্টি স্কুলে এই আলোচনাসভায় মূল বক্তা ছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আশিস কুমার দাস। সভা পরিচালনা করেন 'যুবশক্তি' পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক অর্ণব ভট্টাচার্য।
সেদিনের কলকাতা দাঙ্গার ৭৫তম বর্ষপূর্তির দিনে, অর্থাৎ এই ১৬ আগস্ট, সিপিআই(এম) কলকাতা জেলা স্থায়ী পার্টি স্কুলে আয়োজিত এই আলোচনাসভার শুরুতে পার্টির কলকাতা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রাহুল ভট্টাচার্য বলেন, কলকাতা প্লেনাম পার্টি সদস্যদের রাজনৈতিক চেতনার মানোন্নয়নের যে নির্দেশ দিয়েছে তা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে পার্টি শিক্ষার প্রসারে জেলা পার্টি স্কুলটিকে স্থায়ী পার্টি স্কুলে পরিণত করেছি আমরা। ধারাবাহিকভাবেই আমাদের পার্টি শিক্ষার কাজ পরিচালনা করতে হবে। পার্টি সদস্যদের জন্য মৌলিক-বুনিয়াদি বিষয়ে ক্লাস ব্যতীতও গুণমানের পার্টি শিক্ষক গড়ে তোলার লক্ষ্যে তাঁদের আত্মপাঠ, আত্মশিক্ষাকে সাহায্য ও সমৃদ্ধ করতে লাগাতারভাবেই এই স্কুলে নানান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা সংগঠিত করা হবে। এই প্রক্রিয়ার সূচনা হিসেবেই আজকের এই আলোচনাসভার আয়োজন।
অধ্যাপক আশিস কুমার দাস বললেন, খুন ও হিংস্রতার নানা ঘটনার পাশাপাশি ছেচল্লিশের কলকাতায় মানবিকতারও অনেক অনেক দৃষ্টান্ত ছিল। কোথাও হিন্দুরা নিজের বাড়িতে বা পাড়ায় আর্ত,বিপন্ন মুসলিমদের আশ্রয় দিয়েছেন, আবার কোথাও মুসলিমরা বাঁচিয়েছেন তাদের হিন্দু সহনাগরিকদের। শিখ সম্প্রদায়ের মানুষেরাও অসংখ্য নজির রেখেছেন মানবিকতার। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো ট্রামলাইন শ্রমিকদের ভূমিকা। যাঁরা ছিলেন মুখ্যত কমিউনিস্ট পার্টির মতাদর্শে অনুপ্রাণিত। আজকের কমিউনিস্টদের পক্ষে মানবিকতার এই প্রকৃত দৃষ্টান্তগুলো খুব বেশি করে মানুষের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন।
এদিনের আলোচনায় তিনি প্রচলিত একচোখা আখ্যানের বদলে অনেকগুলি দিক থেকে সেই ইতিহাসকে তুলে ধরেন। ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট মুসলিম লিগের ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’-এ কলকাতায় যে বীভৎস দাঙ্গা সংগঠিত হয়, সামগ্রিকতাতেই সেই ইতিহাস চর্চার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন অধ্যাপক দাস।
আলোচক অধ্যাপক আশিস কুমার দাস তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই এই দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতটি তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, বিশ শতকের চারের দশকে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হচ্ছে, দেশে একের পর এক উত্তাল গণআন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বুঝতে পারছে যে, ভারত থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে তাদের চলে যেতে হবে।ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পর কলকাতায় একের পর এক গণআন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সংগ্রামী জনতার অপূর্ব ঐক্য দেখা যাচ্ছে। রশিদ আলি দিবস, আইএনএ-র যোদ্ধাদের বিচার, নৌবিদ্রোহের সংহতিতে আন্দোলন এবং ২৯ জুলাই ডাক-তার বিভাগের শ্রমিকদের অভূতপূর্ব ধর্মঘট সংগঠিত হয়। অন্যদিকে এই ২৯ জুলাই তারিখেই মুসলিম লিগ ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’-এর ডাক দেয়। ২৯ জুলাই থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে তারা উসকানি ছড়ায় এবং ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন’-এর প্রস্তুতি নিতে থাকে। নির্দিষ্টভাবে এই দাঙ্গায় এবং সাধারণভাবে দেশভাগের প্রক্রিয়ায় মুসলিম লিগের এই ভূমিকার কথা প্রচলিত ন্যারেটিভে আলোচিত হলেও এই সময়পর্বে হিন্দু মহাসভাও যে হিংসা সংগঠিত করার যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছিল সে ইতিহাসকে গোপন রাখা হয়। গোপন রাখা হয় হিন্দু জনমানসকে আতঙ্কিত ও প্ররোচিত করার লক্ষ্যে তাদের গৃহীত একের পর এক পদক্ষেপের কথা। প্রচলিত ইতিহাস চর্চায় এই দাঙ্গাকে সফলভাবে সংগঠিত করার জন্য ব্রিটিশের ভূমিকাকেও সেভাবে তুলে ধরা হয় না। অধ্যাপক দাস এই দিকগুলিকেও তুলে ধরেন এবং এই সামগ্রিকতাতেই ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-কে ফিরে দেখার প্রস্তাব করেন।
আলোচনার শেষাংশে সেই ঘটনাপ্রবাহের সময় কমিউনিস্টদের অত্যুজ্জ্বল ভূমিকা, দাঙ্গা রোধে শ্রেণি ঐক্য ও শ্রেণি আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার প্রতি শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। একই সাথে উঠে আসে শান্তি কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় কমিউনিস্টদের ভূমিকা এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সরে দাঁড়ানোর কথাও।
কলকাতা জেলায় পার্টি শিক্ষকের ভূমিকাপালনকারী কমরেডদের পাশাপাশি অনেক উৎসাহী ও আগ্রহী পার্টি সদস্যও এই আলোচনাসভায় অংশ নেন। তাঁদের প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক দাস কংগ্রেসের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। দাঙ্গার দিনগুলিতে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে একমাত্র কমিউনিস্টরাই দাঙ্গা রোধে ভূমিকা পালন করেন। অত্যন্ত জোরের সাথেই তিনি জানান, কংগ্রেস এরকম কোনো ভূমিকা পালন করেনি। তিনি আরও বলেন, সাম্প্রদায়িকতা একটি মতাদর্শ এবং দাঙ্গা হলো তার সঙ্কটকালীন চেহারা। তাই দাঙ্গা হলেই শুধু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়ার প্রশ্ন আসে না। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নটি সব সময়ের।
সভার সভাপতি অর্ণব ভট্টাচার্য সমাপ্তি ভাষণে বলেন, আমরা কমিউনিস্টরা সাম্প্রদায়িকতার শ্রেণিউৎস সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারি না। তিনি যোগ করেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিদায় যখন ঘনিয়ে এসেছে, দেশে গণআন্দোলন যখন জোরদার, তখন ভারতীয় শাসকশ্রেণির দুই প্রতিনিধি কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়েই চিন্তিত। শাসক-শোষক শ্রেণি জনতার অভ্যুত্থানে ভীত। এই প্রেক্ষিতেই দেশভাগের প্রকল্পটিকে বোঝা যেতে পারে। এবং একথাও স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ সংগঠিত করে এবং পরে সেই ঘটনার উদাহরণ দেখিয়েই কার্যত বাংলাভাগকে নিশ্চিত করা হয়েছে। সাধারণ গরিব-মধ্যবিত্ত জনতাকে বস্তুত বৈষয়িক জীবনের দারিদ্র্য থেকে মুক্তির লোভ দেখিয়েই এই প্রক্রিয়ায় ‘উন্মত্ত জনতার দঙ্গল’-এ পরিণত করা হয়েছিল।
এদিন আলোচনাসভায় শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত পার্টি কমরেডদের ধন্যবাদ জানিয়ে এবং এ জাতীয় আলোচনা কমরেডদের আত্মপাঠ-আত্মচর্চা-আত্মশিক্ষায় উৎসাহিত করবে এই আশার কথা বলে তিনি আলোচনার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
পার্টি স্কুলে উপস্থিত কমরেডদের নাম, হোয়াটস্অ্যাপ নম্বর রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা ছিল। ওই নম্বরের মাধ্যমে কমরেডদের এই বিষয় সংক্রান্ত বিভিন্ন রেফারেন্স বই, নথি ইত্যাদির পিডিএফ সরবরাহ করা হবে বলে উদোক্তাদের তরফে জানানো হয়েছে।