৫৯ বর্ষ ২ সংখ্যা / ২০ আগস্ট, ২০২১ / ৩ ভাদ্র, ১৪২৮
সংখ্যাধিক্যের জোরে অসমে পাশ করানো হলো গোরক্ষা আইন
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ বিরোধীশূন্য বিধানসভায় সংখ্যার জোরে ‘গোরক্ষা’ আইন পাশ করিয়ে নিয়েছে অসমের বিজেপি সরকার। গত ১৩ আগস্ট বিলটি ধ্বনি ভোটে গৃহীত হয়। এই আইন পাশের মধ্য দিয়ে অসমে উন্নয়নের বন্যা বয়ে যাবে বলে দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা। এছাড়া জনতার প্রহার বন্ধ হবে বলে তিনি দাবি করেন। গোরক্ষা বিল পাশ হবার পর বিধানসভায় ‘ভারতমাতা কি জয়’, ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তোলেন বিজেপি বিধায়করা।
বিরোধীরা বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি জানালেও তা মানেনি সরকার। এমনকী বিরোধীদের আনা সংশোধনীও গ্রহণ করেনি। তারপর বিরোধীরা ওয়াকআউট করলে বিলটি ধ্বনি ভোটে গৃহীত হয়। কংগ্রেস, ইউডিএফ এবং সিপিআই(এম) বিধায়করা বিলটিকে সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যা দেন। সিপিআই(এম)’র পক্ষ থেকে বিলটিতে ২০টি সংশোধনী দেওয়া হয়। বিরোধীদের কোনো দাবিই মানেনি সরকার।
দ্বিতীয়বার অসমের ক্ষমতায় এসে গোরক্ষা, জনসংখ্যা ইত্যাদি বিষয়কে সামনে এনে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তীব্র করার ষড়যন্ত্র শুরু করে বিজেপি সরকার। এবারে বাজেট অধিবেশন শুরুর দিন ১২ জুলাই গোরক্ষা বিল বিধানসভায় পেশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। ১৩ আগস্ট ছিল অধিবেশনের শেষ দিন। এদিন বিলের ওপর আলোচনা হয়। এর আগে সরকার পক্ষ মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা করতে চায়। বাধা দেয় কংগ্রেস এবং ইউডিএফ। বিরোধীদের বক্তব্য ছিল, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আলোচনার বিষয় আগে থেকে আলোচ্যসূচিতে ছিল না। এ বিষয়টি একদিনের আলোচনার বিষয় নয়। বিরোধীদের এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা স্থগিত ঘোষণা করে সরকার পক্ষ। তারপরই গোরক্ষা বিল নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব আনেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রী বিলটি উত্থাপন করে বলেন, ১৯৫০ সালের গোরক্ষা আইনে কিছু আইনি ত্রুটি রয়েছে। তাই নয়া আইন এনেছে তার সরকার।
গোরক্ষা বিল নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে সংবাদমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে উত্তেজক মন্তব্য করছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বিলে যা বলা নেই, সে কথা মুখ্যমন্ত্রী নিজে বলে বেড়াচ্ছিলেন। যেমন, কোনো আবাসনে হিন্দু পরিবার থাকলে সেই আবাসনের মুসলিম পরিবার গোমাংস রান্না করতে পারবে না। শহরে গো মাংস কেনাবেচা বন্ধ হবে। এমনকী গো মাংস কেনাবেচা রুখতে হিন্দুদের বেশি করে মন্দির তৈরির ফতোয়া দেন তিনি।
বিরোধীদের অভিমত, এই আইনে একদিকে কৃষিজীবীরা সঙ্কটে পড়বেন, আরেকদিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হবার আশঙ্কা রয়েছে। গোরুকে হাতিয়ার করে উত্তর প্রদেশের মতো পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে বিজেপি সরকার।
বিধানসভায় সিপিআই(এম) বিধায়ক মনোরঞ্জন তালুকদার বিলটি সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি জানিয়ে বলেছেন, এই বিলটি আর্থিকভাবে ক্ষতিকর ও সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই আইনের ফলে ব্যাপক দুর্নীতি এবং পুলিশ প্রশাসনের আক্রোশমূলক কর্মকাণ্ডের পথ প্রশস্ত হবে। গোরু কেনাবেচা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা পালন করে। গরিব কৃষকেরা চিকিৎসা, সন্তানের লেখাপড়া, বিয়ে ইত্যদির জন্য গোরু বিক্রি করেন। তা বন্ধ হলে কৃষিজীবী মানুষ সঙ্কটে পড়বেন। তাছাড়া খাদ্যের অধিকার মৌলিক অধিকার। এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট নির্দিষ্ট রায় দিয়েছে। কিন্তু বিজেপি’র গোরক্ষা আইনে খাদ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে। এই আইনে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হবে।
এই বিলটি পাশ করাতে গিয়ে বিরোধীদের কোনো দাবিই মানেনি বিজেপি সরকার।
প্রসঙ্গত, অসমের বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার গত ১২ জুলাই ‘গোরক্ষণ ২০২১’ বিধানসভায় পেশ করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সিপিআই(এম) সহ ৯টি বিরোধী দল এক যৌথ বিবৃতিতে বিলটির তীব্র বিরোধিতা করে একে আর্থিক এবং সামাজিক - দুই দিক থেকে অত্যন্ত ক্ষতিকারক বলে মন্তব্য করে। ২৭ জুলাই প্রকাশিত এই বিবৃতিতে বিলটিকে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির বিরোধী বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক উদ্দেশে উত্থাপন করা বিলটি অসমের সমাজজীবনে গভীর বিপদ সংকেত বয়ে এনেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, বিলটি গৃহীত হলে এর কুপ্রভাব পড়বে রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনীতিতে এবং হাজার হাজার দরিদ্র পরিবার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রস্তাবিত আইনে প্রশাসনিক স্তরে ব্যাপক দুর্নীতির পথ খুলে দেওয়া ছাড়াও পুলিশ প্রশাসনকেও আক্রোশমূলক আচরণ করতে অধিক সুযোগ করে দেবে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছিল, গো সংরক্ষণের নামে প্রস্তাবিত বিলে দামুরি, চেউরি এবং অনুৎপাদনশীল গোরু বিক্রির পথ সম্পূর্ণ বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরিণতিতে চাষি এবং গোপালকরা ভয়ঙ্কর সমস্যার সম্মুখীন হবেন। গোপালন তাদের জীবিকার পরিবর্তে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
মন্দির, নামঘর বা সত্র’র ৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে গোমাংস ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করার যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা অসমের সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে কোনোভাবে খাপ খায় না। অসমে হিন্দু-মুসলমানেরা যুগ যুগ ধরে শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি বসবাস করে আসছে। রাজ্যের একই গ্রামে হিন্দু প্রতিবেশী ও মুসলমান প্রতিবেশী থাকার অসংখ্য উদাহরণ আছে। এমনকী মুসলমানপ্রধান বিধানসভা সমষ্টিগুলিতেও ৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে হিন্দু বসতি এবং তারসাথে স্বাভাবিকভাবে মন্দির, নামঘর, সত্র না থাকা অঞ্চল নেই বললেই চলে। মুসলমান সম্প্রদায় ছাড়াও আমাদের অসমে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যাও কম নয়। রাজ্যের সমতলভূমিতে আদিবাসী এবং জনজাতীয় মানুষের একাংশ ছাড়াও পাহাড়িয়া দু’টো জেলাতে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী অনেক মানুষ আছেন এবং তাঁরাও যুগ যুগ ধরে মন্দির, নামঘর ইত্যাদির কাছাকাছি শান্তিতেই সহাবস্থান করে আসছেন। প্রস্তাবিত আইনে জনসাধারণের খাদ্যাভ্যাসের মৌলিক অধিকারকেও খর্ব করবে।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এই বিলের মধ্য দিয়ে কেবল সন্দেহের বশে পুলিশ আধিকারিক বা পশুবিভাগের আধিকারিককে যে কোনো বাড়ি বা অঞ্চলে প্রবেশ করে খানাতল্লাশি করার যে অবাধ অধিকার দিতে চাওয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ রূপে স্বৈরাচারী এবং কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। একইভাবে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া সত্ত্বেও গোরু, মোষ বাজেয়াপ্ত করা এবং বাজেয়াপ্ত করা সেই সমস্ত গোরু, মোষের লালনপালনের খরচ অভিযুক্তকেই বহন করার প্রস্তাব সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং আইনের পরিপন্থী। তদুপরি কোন্ কোন্ গোরু, মোষ বধ করার জন্য উপযুক্ত সেই সম্পর্কে পশুবিভাগের আধিকারিকদের অভিমতই চূড়ান্ত এবং এই সম্পর্কে কেউ আদালতে যেতে পারবে না বলে যে ধারার প্রস্তাব করা হয়েছে, তা ভারতীয় ন্যায়ব্যবস্থার মৌলিক নীতির পরিপন্থী।
ওই বিবৃতিতে পরিশেষে বলা হয়েছিল, এমনই এক প্রেক্ষাপটে অসমের বিরোধী দলগুলি সামগ্রিকভাবে অদূরদর্শী, আর্থিকভাবে ক্ষতিকারক, স্বেচ্ছাচারী এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনবাদী ‘অসম গো সংরক্ষণ বিল, ২০২১’-এর তীব্র বিরোধিতা করছে। বিজেপি সরকার ধর্মীয় বিশ্বাসের অজুহাতে অসমকে যাতে বিভাজিত এবং ধ্বংস করতে না পারে, তার জন্য সজাগ, সরব এবং ঐক্যবদ্ধ হতে রাজ্যের সমস্ত অংশের জনসাধারণের কাছে আবেদন জানানো হচ্ছে।
এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করে কংগ্রেস, সিপিআই(এম), সিপিআই, আঞ্চলিক গণমোর্চা, এআইইউডিএফ, সিপিআই(এম-এল), জিমচাঁয়া (দেউরি) পিপলস পার্টি (জেপিপি), আদিবাসী ন্যাশনাল পার্টি, অসম (আনপা) এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দল।
বিরোধীদের সমস্ত অভিযোগ ও দাবিকে উপেক্ষা করে সংখ্যাধিক্যের জোরে অসমের বিজেপি সরকার বিধানসভায় গোরক্ষা আইন পাশ করে নেয়। এর পরিণামে কী পরিস্থিতি তৈরি হয় - এখন দেখার বিষয় সেটাই।