E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২ সংখ্যা / ২০ আগস্ট, ২০২১ / ৩ ভাদ্র, ১৪২৮

স্বাধীনতার ৭৫ বছর, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ও বাঙালি উদ্বাস্তু

নীতীশ বিশ্বাস


স্বাধীনতা সংগ্রাম

ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর শুরু হলো। যদিও স্বাধীনতার প্রকৃত সূচনা ১৯৫০-এর ২৬শে জানুয়ারি। সে যাই হোক এই সময়ে এসে আমাদের বাঙালি সমাজের বুকের বেদনা বার বার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কারণ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী পূর্বপুরুষেরা যে দেশের স্বপ্ন বুকে নিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন, সে ছিলো অখণ্ড ও ঐক্যবদ্ধ ভারত। যেখানে গান্ধীজির নেতৃত্বে যেমন নরম ও চরমপন্থীদের কংগ্রেসের ভূমিকা ছিলো, তেমনি ছিল মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিদ্রোহ; ছিল কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের মতো কমিউনিস্টদের নেতৃত্ব মীরাট ও কানপুর ষড়যন্ত্র নামে মহান প্রচেষ্টা আর শ্রমিক-কৃষক, নৌবাহিনী, ছাত্র-যুব মহিলা আন্দোলন; ছিল নানা স্তরের দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ। ছিল যুগান্তর, অনুশীলন সমিতিসহ নানা সশস্ত্র বিল্পবী গ্রুপের অজস্র আত্ম-উৎসর্গ, ক্ষুদিরাম থেকে ভগৎ সিং-এর আদর্শবাদী আত্মবলিদান। ছিল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম নামে খ্যাত সিপাহি বিদ্রোহ, ছিল চরম বীরত্বে ও আত্মত্যাগে নন্দিত ও রক্তাক্ত নানা আদিবাসী বিদ্রোহ। আর দেশের বাইরে ছিল নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ও তাঁর সেনা দল, আজাদ হিন্দ বাহিনীর অসীম বীরত্বপূর্ণ দেশপ্রেমিক অবদান। এই নানা স্তরের ভারতবাসীর সার্বিক আন্দোলনের ফলে ভারতে আমরা এই রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছি।

বঙ্গভঙ্গ প্রসঙ্গ

নানা বিদ্রোহ ও বিপ্লবী আন্দোলনে ব্রিটিশের চোখের ঘুম কেড়ে নেওয়া বাংলাকে তারা নানাভাবে শাস্তি দিতে চেষ্টা করেছে। করেছে তাদের জাতিসত্তার ওপরে আক্রমণ। তাই তারা ১৮৭৪ সালে আসামের সঙ্গে জুড়ে দেয় বাংলার গোয়ালপাড়া থেকে বরাক অঞ্চল। সেই আমাদের প্রথম বঙ্গভঙ্গ। যে অংশ তারা আসামে জুড়ে দেয় তার ৯৯ শতাংশই ছিল বাংলাভাষী। সেদিন তাদের জন্য আমাদের বনেদি জাতীয়তাবাদী নেতাদের কেউ কোনো বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন করেনি। তাদের সুবিধাভোগী ও অভিলাসি-অংশ মুখ্যত চেষ্টা করেছে ‘ওয়ার্ড-বুক’-পড়ে ছেঁড়া-ফুটো ইংরেজি শিখে ব্রিটিশ প্রভুদের প্রসাদপুষ্ট হতে, তথা কোনো, ‘‘ব্রিটিশ-প্রিয়-বনেদি দেশীয়দের সুপারিশে ডেপুটি হইয়া সুখে দিন কাটাইতে’’।

তারপর বঙ্গভঙ্গ এলো ১৯০৫ সালে। তখন বাংলার লর্ড কার্জন ও মুখ্য সচিব মিঃ আমেত (Cayan Uddin Ahmet)। তারা ঠিক করেন চট্টগ্রাম, ঢাকা, ও রাজশাহী বিভাগ এবং পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্য, সিলেট, কুমিল্লা যাবে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে প্রদেশে। পশ্চিমের হিন্দিভাষী রাজ্য কোটা-নাগপুর (যার মধ্যের Changbhakar, Korea, Surguja), ও জামশেদপুর রাজ্য বাংলা থেকে যাবে মধ্য প্রদেশে, আর সম্বলপুর রাজ্য, আর ওডিশার ৫টা অঞ্চল (যথা বামরা, রাউড়খোল (Rairakhol), সোনেপুর,পাটনা এবং কালাহান্ডি) তৎকালীন মধ্য প্রদেশ থেকে আসবে বাংলায়। মুলত বাংলাকে ভেঙেচুরে খণ্ড বিখণ্ড করার বিরুদ্ধে সে দিন বাংলার বিবেকবান মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। এর নেতা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’-র মতো অসাধারণ সব স্বদেশি সঙ্গীত। অবশেষে এই প্রস্তাব ১৯১১ সালে স্থগিত হয়ে যায়। কারণ তখন বিশাল আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ব্যাপক বুদ্ধিজীবী মহলে। স্মরণে রাখতে হবে এরপরই ব্রিটিশ রাজধানী নিয়ে যায় তাদের বশংবদদের মিলন ক্ষেত্র তথা তাদের জন্য বেশি নিরাপদ দিল্লিতে।

তার কিছুদিন পর আসে ১৯৪৭ সালই স্বাধীনতার নামে বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ। বলা উচিত সবচেয়ে মারাত্মক এই দেশভাগ। এ কেবল পূর্বের মতো রাজ্য ভাগ নয়, ভরতকে ভেঙে একেবারেই ভিন্ন দেশ করে নেওয়া। যার অভিশাপে প্রায় তিন-চার কোটি বাঙালি উদ্বাস্তু আজ সারা দেশে তাদের বাঙালিত্ব হারানো এক অভিশপ্ত প্রজাতি। এর প্রকাশ্য বিরোধিতা গান্ধীজি করলেও মুসলিম লিগ ও কংগ্রেসের সিদ্ধান্তেই এই বিভাজন হয়।

কেন বাংলা?

নবজাগরণের মানবিক চেতনায় ঋদ্ধ বাংলা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বাগ্রে, ব্রিটিশের সেই ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি অনুসরণ করে নেহরু, বিধান রায়, প্যাটেল থেকে শ্যামাপ্রসাদ বাংলার উদ্বাস্তুদেরকে এক্ষেত্রে দুয়োরানি আর পাঞ্জাবের উদ্বাস্তুদেরকে সুয়োরানি করে তুললো। যে নেহরু আসামের বাঙালি উদ্বাস্তুদের একটি পরিবারকেও অন্য রাজ্যে পুনর্বসতিতে রাজি হননি, সেই তিনিই বিধান রায় ও শ্যামাপ্রসাদদের অনুরোধে এই নিম্নবর্ণের বাঙালি উদ্বাস্তুদের দণ্ডকারণ্য আর কালাপানির দেশ আন্দামানসহ প্রায় ভারতের ১৭/১৮টা রাজ্যে সতীর ছিন্ন দেহের মতো ছিঁড়ে-ফুঁড়ে পাহাড়ে জঙ্গলে অনাবাদী পাথুরে জমিতে আর অরণ্যের নানা শ্বাপদ সংকুল স্থানে ফেলে দিলো। এদের বড়ো অপরাধ এরা পশ্চিমবঙ্গে এসে নানা সাম্প্রদায়িক শক্তি হয়ে না উঠে, সমবেত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক শক্তি কমিউনিস্টদের লাল পতাকার তলে। তাই বিধানবাবু তার চোখের বালি দূর করতে এদের নির্বাসনে উঠেপড়ে লাগেন। আর তার সঙ্গে ছিলেন বর্ণান্ধদের দল জনসংঘের শ্যামাপ্রসাদবাবুরা।

নাগরিকত্বের নাগপাশ

দণ্ডকারণ্যে ও মহারাষ্ট্রে প্রথমে কিছু বাংলা স্কুল থাকলেও পরে ১৯৮২-৮৫সালে দণ্ডকারণ্য প্রোজেক্ট গুটিয়ে দেবার নামে প্রথমে ওইসব অঞ্চলকে তিনটি রাজ্যে (ও পরে পাঁচটি রাজ্যে) পাঁচটি ভাষার স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে মাতৃভাষা-হীন করে দেওয়া হলো। তার বিরুদ্ধে নিজস্ব শক্তিতে প্রতিরোধের চেষ্টা করে কিছু করতে পারলো না। আর এরা আবার নানা রাজ্যে গিয়ে নিজস্ব কোনো শক্তিতে পরিণত হতে না পারে তাই তাদের এই নির্বাসনের সময় দেখা হলো যে, কোনো অঞ্চলে যেন একত্রে বেশি সংখ্যায় তাদের পাঠানো না হয়। এমনকী রাজ্য ও কেন্দ্রের কংগ্রেসী সরকার বাঙালি উদ্বাস্তুদের REFUGE Status-ও দেয়নি। - তাই তাদের জন্য বরাদ্দ আসতো ত্রাণ দপ্তর থেকে। রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো এদের জন্য গঠিত হয় ত্রাণের জায়গায় ‘ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তর’। আর রাম রাজত্বে তথা বিজেপি’র চক্রান্তে তাদের নাগরিকত্বই কেড়ে নেবার ভয়ানক চক্রান্ত শুরু হয়েছে। যার জন্য আজ সারা দেশে বাঙালি উদ্বাস্তুদের ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার।

যে গান্ধী বলেছিলেন আমার বুকের উপর দিয়ে দেশ ভাগ করতে হবে, তাকে এক আরএসএস-কর্মী তথা রামভক্ত নাথুরাম হত্যা করলো। এই পশ্চিমাদের সুদূর প্রসারী চক্রান্তে বাঙালি দলিত উদ্বাস্তু সারা ভারতে মরতে মরতে ভাষাহীন, আশাহীন এক অনিকেত জাতি হিসেবে কেবল ভেসে চলেছে। এই ৭৫বছরেও তাদের নেই নাগরিকত্বের যথার্থ নথিপত্র, জমির সুষ্ঠু দলিল, হয়নি জমির সীমা নির্ধারণ। পায়নি সংবিধানের নির্দেশ মতো জাতি পত্র। সব মিলিয়ে আজও তারা এদেশে যেন দ্বিতীয়শ্রেণির নাগরিক। তাই তাদের ভোট ছাড়া নেই দেশের সাংবিধানিক অন্যান্য অধিকার পর্যন্ত। আজও মহারাষ্ট্রে এই জটিলতায় তাদের চাকরি পাবার সব আশা আটবাঁও জলের তলায়।

দাঙ্গা ও দেশভাগ

এ রাজ্যের বর্ণবাদী নেতাদের দুশ্চিন্তা ছিল দরিদ্র মুসলিম ও দলিত বাঙালি হিন্দু ঐক্যবদ্ধ হলে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হবেন ফজলুল হক, অথবা যোগেন মণ্ডলের মধ্যে কেউ। তাই শ্যামপ্রসাদ লিখেছিলেন ব্রিটিশের হাত পা-ধরা সেই চিঠি, ‘দেশ ভাগ না হলেও বাংলা ভাগ অবশ্যই চাই।’ আর সকলেই জানেন দাঙ্গা হয় শাসকদলের মদতে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এজন্যই তারা দুই মৌলবাদীদের গভীর চক্রান্তে ১৬ই আগস্ট, ১৯৪৬ হয় তথাকথিত ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে বা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং। তাদেরই শিষ্য -শিষ্যারা আবার আজ বাংলার আর এক সর্বনাশী চক্রান্তে শামিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাই স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষে লালকেল্লা থেকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস-১৪ই আগস্টকে ‘বিভাজন ও বিভীষিকা স্মারক দিবস’ হিসেবে পালনের ডাক দেন। এই সব প্রয়াসের মাধ্যমে তারা আগামী ২৫ বছর ভারত শাসন করার ঘোষণাও করেছেন। তিনি ওই দিন অনেক ভালো ভালো কথা বলেছেন, যেমন ‘৭৫তম স্বাধীনতা দিবসে সেই অমৃতকালের সূচনা হচ্ছে। এই অমৃতকালের লক্ষ্য হবে এমন ভারত নির্মাণ করা যেখানে শহর এবং গ্রামের সুযোগ সুবিধায় কোনও ভেদাভেদ থাকবে না। অমৃতকালের লক্ষ্য হবে এমন দেশ নির্মাণ যেখানে সরকার নাগরিক জীবনে অকারণ দখলদারি করবে না। অমৃতকালের লক্ষ্য এমন এক দেশ নির্মাণ করা, যেখানে দুনিয়ার সমস্ত আধুনিক পরিকাঠামো থাকবে। যখন ভারত বিশ্বের কোনো দেশের থেকে কম হবে না।

পাঠক স্মরণে রাখুন উনি আগেও অনেক অমৃত কথনের নামে এমন অনৃত ভাষণ করেছেন। কিন্তু ভারতে গত ৪৫ বছরে এমন বেকারত্ব আর আসেনি। এমন জুমলা (মিথ্যা ভাষণ) আগে আর কেউ দেননি। এমন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মধ্যবিত্ত ও নিম্ন বিত্তের জীবনের এমন অনিশ্চয়তা আর সাম্প্রদায়িক পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। অমৃতকালের নামে এ এক নিষ্ঠুরতার অন্ধকার কাল। আর তাতে দলিত দরিদ্র ভারতবাসী ও বাঙালি উদ্বাস্তুর জীবনের ওদের সৃষ্ট মহাসংকট গভীরতর হচ্ছে।

নানা রাজ্যে উদ্বাস্তু বাঙালি এবং আএসএস-এর চক্রান্ত

দুঃখের কথা পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সরকার এই নিম্নবর্ণের উদ্বাস্তুদের সারা ভারতে নানা স্থানে অযত্নে-অবহেলায়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পানীয় জলের ব্যবস্থা না করে ফেলে দিয়ে এসেছিল। পরে আর তাদের দিকে একবার তাকিয়েও দেখেনি। ভাবুন একজন শিখ নাগরিক অন্যত্র আক্রান্ত হলে তাদের জন্য সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত উদ্বেল হয়ে ওঠেন। এই তো আমরা দেখলাম, গত বছর মেঘালয়ে আক্রান্ত পাঞ্জাবি শ্রমজীবীদের জন্য সে রাজ্যের সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব কীভাবে তাদের উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আর বাঙালি উদ্বাস্তুদের বিষয়ে সবাই ভেবেছে ওদের তো এরাজ্যে ভোট নেই তাই তাদের আর কীইবা প্রয়োজন? এইভাবে প্রায় দুই কোটি বাঙালি উদ্বাস্তু আজও বুক ঘষে ঘষে বেঁচে আছে সারা ভারতের আনাচে কানাচে। এই বাঙালি এক ভয়ঙ্কর জীবনের ভিতরে নিমজ্জিত। সাড়ে সাতদশকের স্বাধীনতার পরেও এই মানুষদের এখন সরকার প্রলোভন দিচ্ছে, নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বলে, অর্থাৎ ১৯৫২ থেকে আজও পর্যন্ত নানা কারণে যারা এসেছেন তাদের এক বড়ো অংশকে এখনও নাগরিকত্ব দেওয়া হয়নি। কারা এই পাশবিক অন্যায় সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী, তা আজ বুঝতে হবে। উদ্বাস্তুরা কি জানেন না, ২০০৩ সালে বিজেপি আদবানী-বাজপেয়ীর নেতৃত্বে তাদের নাগরিকত্ব হরণ (সংশোধনী) আইন পাশ করে বিশ্ব নিন্দিত হয়েছে। বিজেপি’র সেই হন্তারকেরা, এখন হাতের খড়্গ লুকিয়ে এসেছে কমণ্ডলু - সাধুর ছদ্মবেশে। উদ্ধারকর্তা সেজে। এই বর্ণ হিন্দুত্ববাদী ভয়ঙ্কর শক্তিকে একজোট হয়েই রুখতে হবে।