৫৯ বর্ষ ২ সংখ্যা / ২০ আগস্ট, ২০২১ / ৩ ভাদ্র, ১৪২৮
অর্থনৈতিক উদারীকরণের তিন দশক
প্রভাত পট্টনায়েক
১৯৯১ সালে ভারত নয়াউদারবাদী নীতি গ্রহণ করার পর তিরিশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, যদিও কারোর কারোর মতে এর সূত্রপাত ঘটেছে তারও আগে, ১৯৮৫ সালেই। অর্থব্যবস্থার উপর এই নীতিগুলির কী প্রভাব পড়েছে তার মূল্যায়নে খবরের কাগজগুলি ভরে উঠেছে, হঠাৎ করেই মনমোহন সিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন উদারপন্থীদের নিজেদের স্বহস্তকৃত এই কাজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে এবং তার সঙ্গেই যতটা সম্ভব দুঃখপ্রকাশ করে তাঁরা বলছেন নয়াউদারীকরণের সুফলগুলি সমভাবে বণ্টিত হয়নি। সম্প্রতি মনমোহন সিং বলেছেন যে, ‘প্রত্যেক ভারতবাসীর সুস্থ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করাকে অগ্রাধিকার দিতেই হবে’। তিনি নিজেই যখন প্রধান দায়িত্বে ছিলেন তখন এ-কাজ করা থেকে বিরত থাকলেন কেন কে জানে।
নয়াউদারীকরণের ফলে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তার ফলে প্রায় প্রতিটি ভারতবাসীর জীবনযাত্রা উন্নততর হয়েছে, জনসংখ্যার একটা বড়ো অংশ চূড়ান্ত দারিদ্র্যের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে, যদিও এর ফলে দেশে আয় ও সম্পদের বৈষম্য আরও বেড়েছে - এই ধরনের মূল্যায়ন সাধারণভাবে শুধুমাত্র নয়াউদারবাদের পক্ষের মানুষদের কাছেই স্বীকৃতি পেয়েছে এমন নয়। এমনকী যাঁরা এর সমালোচক তাঁদের কাছেও এই ধরনের মূল্যায়ন স্বীকৃতি পেয়েছে, এর মধ্যে রয়েছেন এমনকী কিছু বামপন্থীও। পার্থক্য যা দেখা যায় তা কেবল উন্নয়নের বিপরীতে বৈষম্যকে কে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। নয়াউদারপন্থীরা এমনকী যুক্তি দিয়ে দেখাতে চান যে, এই বৈষম্যের কুপ্রভাবগুলি দূর হবে যদি অর্থনীতিতে বিকাশের হার পুনরুজ্জীবিত হয় ও বৃদ্ধি পায়। আর সেটার জন্য পুঁজিপতিদের ‘জান্তব জিগীষা’ (অ্যানিমাল স্পিরিটস) যা দ্বারা নির্ধারিত হয় তারা কতটা বিনিয়োগ করবেন, তাকে মদত দিতেই হবে। মোদী সরকার দাবি করতে পারে তারা তাদের শ্রমিক-বিরোধী ও কৃষক-বিরোধী নীতিগুলির মাধ্যমে আসলে ঠিক এটাই করতে চাইছে এবং কোনো ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি না থাকা সত্ত্বেও অদ্ভূতভাবে কংগ্রেস এগুলির কয়েকটির বিরোধিতা করছে। এভাবেই ব্রেটন উডস ইনস্টিটিউশনস জানাচ্ছে যে, নয়াউদারবাদী নীতিগুলির বিষয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলি মোটামুটি ঐকমত্যে রয়েছে যা অর্থব্যবস্থায় এর গত তিন দশকব্যাপী প্রভাবের মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত হয়।
এই সম্পূর্ণ বোঝাপড়াটি কিন্তু ভুল এবং তার কমপক্ষে দু’টি কারণ রয়েছে। প্রথমত, এক্ষেত্রে অর্থনীতির পুঁজিতান্ত্রিক ক্ষেত্রটিকে মোটামুটি স্বনির্ভর স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা বাদবাকি অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন, পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর যার প্রধান প্রভাব কেবল আরও আরও বেশি শ্রম টেনে নেওয়ার মধ্যেই সীমিত; এবং ততটা সাফল্যের সঙ্গে এই কাজটা সে করে উঠতে পারেনি সেটাই কেবল দুঃখের কথা। বাস্তবে কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক ক্ষেত্রের অভ্যন্তরস্থ সঞ্চিত পুঁজি তার বাইরের পৃথিবীতে নানাভাবে অনবরত অভিঘাত ঘটায়। বাইরের পৃথিবী থেকে সে কেবল যে শ্রম নেয় তাই নয়, যে অর্থনীতিতে শ্রমের একটি বৃহৎ সঞ্চয় রয়েছে তার পক্ষে এটা তো ভালো, কিন্তু সে নিয়ে নেয় জমি ও অন্যান্য সম্পদও যার মধ্যে রয়েছে আর্থিক সম্পদ (উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কৃষকের ভরতুকি যার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল কৃষিব্যবস্থাকে টেঁকসই করে তোলার ক্ষেত্রে তার বিনিময়ে পুঁজিবাদীদের ভরতুকি দেওয়া হচ্ছে তাদের ‘অ্যানিমাল স্পিরিট’-কে উজ্জীবিত করার জন্য); এবং পুঁজিতান্ত্রিক ক্ষেত্রের বিকাশ প্রথাগত ক্ষেত্রগুলির চাহিদাও কমিয়ে দেয়।
সুতরাং, পুঁজির সঞ্চয় তার পারিপার্শ্বিক ক্ষুদ্র উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতিকে ক্রমাগত ধ্বংস করতে থাকে (মার্কস এই পদ্ধতিকে বলেছেন “পুঁজির আদিম সঞ্চয়”), এমনকি সে যখন অল্প শ্রম নেয় তখনও। পুঁজি সঞ্চয়ের দ্রুত হার সঞ্চিত শ্রমকে শুষে নেয় ফলত বেকারত্ব ও দারিদ্র্য কমে যায় (এবং যদি তা না হয় তাহলে তার দাওয়াই হলো দ্রুততর পুঁজি সঞ্চয়)-বুর্জোয়া অর্থনীতির এই প্রচলিত মতের উল্টোদিকে আসলে যা হয় তা হলো এই ধরনের সঞ্চয় অধিক শ্রম না নিয়ে পারিপার্শ্বিক ক্ষুদ্র উৎপাদনের অর্থনীতির ভিতকে দুর্বল করে দেয়। এর ফলশ্রুতি কর্মহীনতা ও দারিদ্র্যের বৃদ্ধি। পুঁজি সঞ্চয়ের হার বাড়ালে এই প্রবণতাও বাড়ে, সমস্যার সমাধান হয় না।
বাস্তবে ঠিক এটাই ঘটেছে, সরকারের নিজস্ব পরিসংখ্যান দেখলেও তাই দেখা যাবে। নয়াউদারবাদী আমলে কৃষিজীবীদের সুরক্ষাগুলি অপসারিত হলো যা তারা এতদিন পেতেন এবং নিশ্চিতভাবে বলা যায় তার ফলে এই ক্ষেত্রটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই সমস্যা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় কৃষিতে লাভ কমে যাওয়ায়; স্পষ্টভাবে বোঝা যায় এই তথ্যের মাধ্যমেও যে ১৯৯১ ও ২০১১’র সেন্সাসের মধ্যে কৃষিজীবী বা ‘কালটিভেটর’ (সেন্সাসে যেভাবে বলা হয়েছে) - এর সংখ্যা ১৫ মিলিয়নে নেমে গেছে; এবং গত তিন দশকে তিন লক্ষেরও বেশি কৃষকের আত্মহত্যার নিদারুণ বাস্তব চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের এটা দেখিয়ে দিয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই দারিদ্র্যের প্রসার ক্যালোরি গ্রহণ করতে পারার ক্ষমতার মৌলিক ধারণা অনুযায়ী নয়াউদারবাদী সংস্কারের সূচনার সময় থেকে বেড়েছে। গ্রামীণ ভারতে মাথাপিছু প্রতিদিন ২২০০ ক্যালোরির কম ভোগ করার সামর্থ্য রয়েছে তা (যা ছিল গ্রামীণ দারিদ্র্যের সরকারি সূচক) ১৯৯৩-৯৪- এ ৫৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১১-১২-তে হয়েছে ৬৮ শতাংশ (এনএসএস লার্জ স্যাম্পল সার্ভে ইয়ারস); শহরাঞ্চলে, যেখানে প্রকৃত মাত্রা সূচক ছিল ২১০০ ক্যালোরি জনপ্রতি প্রতিদিন, সেখানে এই সংখ্যাটা হলো যথাক্রমে ৫৭ ও ৬৫।
২০১১-১২’র পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। ২০১৭-১৮ এনএসএস লার্জ স্যাম্পল সার্ভের পরিসংখ্যান এতটাই ভয়াবহ ছিল যে মোদী সরকার সেই তথ্যাবলী চেপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করল এই সার্ভেগুলি বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিছু তথ্য অবশ্য তার আগেই কোনোভাবে প্রকাশ্যে এসে পড়েছিল। সেই তথ্য অনুযায়ী দেখা গেল ২০১১-১২ ও ২০১৭-১৮’র মধ্যে গ্রামাঞ্চলে সমস্ত দ্রব্যে মাথাপিছু ভোগ ব্যয় কমে গেছে ৯ শতাংশ। স্বাধীন ভারতের স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে (ফসলের গুরুতর ক্ষতি ইত্যাদি বাদ দিয়ে) এমন ইতিপূর্বে ঘটেনি।
কৃষিব্যবস্থার উপর এ ধরনের আক্রমণ আসলে নয়াউদারনৈতিক ব্যবস্থায় আরও তীব্রতর হচ্ছে। এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হলো তিনটি কৃষি আইন যার উদ্দেশ্য কৃষকের স্বার্থের বিনিময়ে বৃহৎ পুঁজির স্বার্থ রক্ষা। এটা এতটাই ক্ষতিকর যে, দিল্লির চারপাশের রাজ্যগুলি থেকে বিপুল সংখ্যক কৃষক এই আইন প্রত্যাহারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।
আমি এবার আলোচনা করব নয়াউদারবাদের বোঝাপড়ার দ্বিতীয় ত্রুটিটি সম্পর্কে। পুঁজিপতিদের বিনিয়োগ শুধুমাত্র ‘অ্যানিমাল স্পিরিট’ নামের একটা ধোঁয়াটে ব্যাপারের উপরে নির্ভর করে না, এর শিকড় প্রোথিত রয়েছে বাজারের সম্ভাব্য বিকাশ সম্পর্কে তাদের স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট হিসেব-নিকেশের মধ্যে। এ কথা সত্যি যে, এই হিসেবের সাপেক্ষে তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা তাদের আশা ও হতাশার ভাবের (‘অ্যানিমাল স্পিরিট’ শব্দবন্ধের মধ্য দিয়ে যা বোঝানো হয়) উপর নির্ভরশীল হতে পারে, কিন্তু বাজারের বিকাশ না হলে বা বিকাশ মন্দীভূত হয়ে পড়লে স্পষ্টতই তাদের বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা সে যত ভরতুকিই দেওয়া হোক না কেন।
নয়াউদারবাদ ভারতসহ সর্বত্র আয়ের বৈষম্যকে আরও প্রশস্ত করেছে, পিকেটি এবং চ্যান্সেল দেখাচ্ছেন ১৯৮২ সালে জনসংখ্যার ওপরের এক শতাংশের আয় ছিল মোট জাতীয় আয়ের মাত্র ৬ শতাংশ কিন্তু ২০১৩-১৪-তে তা বেড়ে ২২ শতাংশ হয়েছে (প্রায় এক শতাব্দীর মধ্যে সর্বোচ্চ)। শ্রমজীবী মানুষ যেহেতু বিত্তবানদের তুলনায় তাদের আয়ের বেশি পরিমাণ ভোগে খরচ করেন, আয় বৈষম্যের বিস্তারের ফলে শ্রমজীবীদের পকেট থেকে ধনীদের পকেটে আয় স্থানান্তরিত (শিফট) হয় যার ফলে ভোগ সংক্রান্ত খরচ কমে যাওয়ায় প্রভাব ফেলে ও সমষ্টিগত চাহিদা বৃদ্ধি পায় যার ফলে আবার বিনিয়োগ ও বিকাশ হ্রাস পায়।
এর প্রভাব পড়েছে ভারতীয় অর্থনীতিতেও যেখানে অতিমারীর আগেই ২০১৯ সালে বেকারত্বের হার ছিল ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সাধারণ মানুষের উপরে এর দু ধরনের প্রভাব পড়েছে। এক, শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, প্যান্ডেমিকের আগেই নয়াউদারীকরণের ফলভোগ করছিলেন তাঁরা। সাম্প্রতিককালে কর্মক্ষেত্র ও ভোগে ধস নামায় এই সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। সংক্ষেপে, নয়াউদারবাদ একটা স্থবির প্রবণতার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মার্কিন অর্থনীতিতে, যা গোটা পুঁজিবাদী দুনিয়ায় প্রথমে নব্বইয়ের দশকে ‘ডট কম বুদবুদ’ এবং পরে এই শতাব্দীর প্রথম দশকের ‘আবাসন বুদবুদে’র দরুন থমকে গিয়েছিল।
আবাসন বুদবুদের চুপসে যাওয়ার দরুন বিশ্ব অর্থনীতিতে এক দীর্ঘ সঙ্কট তৈরি হয় যার দাওয়াই নয়াউদারবাদের কাছে ছিল না (যা রাষ্ট্রকে ‘চাহিদা ব্যবস্থাপনায়’ হস্তক্ষেপ করতে ইঙ্গিত করে)।
দ্বিতীয়ত, এই সংকটের ফলে বৃহৎ পুঁজি ও ফ্যাসিস্ট হিন্দুত্ববাদী দলগুলির মধ্যে একটি মিত্রতা স্থাপিত হয়েছে যা মোদী সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে। এইরকম একটি জোট বিশেষভাবে ভারতেই হয়েছে তা নয়। সংকটকালে বৃহৎ পুঁজি ফ্যাসিস্ট দলগুলির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়, তাদের রাজনৈতিক উত্থানকে উজ্জীবিত করে ও তার জন্য অর্থের জোগান দেয় যাতে অর্থনৈতিক দুরবস্থার দিক থেকে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে, আলোচনার অভিমুখ পালটে ফেলে, একটি ‘অপর’ নির্মাণ করে তার উপরে দোষারোপ করা যায়। ক্ষমতায় থাকা এই দলগুলি বৃহৎ পুঁজির নির্দেশ মেনে চলে এবং তারা রাজনৈতিক শক্তি লাভ করে সংকটের অর্থনৈতিক সমাধানের মধ্য দিয়ে নয় বরং অর্থনীতির ক্ষেত্র থেকে সম্পূর্ণভাবে মানুষের মনোযোগ সরিয়ে ফেলে।
সংক্ষেপে, নয়াউদারবাদ, যা শ্রমজীবী মানুষকে নিষ্পেষিত করেছে যেমন উন্নত বিকাশের পর্যায়ে থাকাকালীনও, তা যখনই সংকটের মুখোমুখি হয়েছে তখনই শোষণ আরও তীব্রতর করে তুলেছে এবং তার পাশাপাশি এমন একটি ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটিয়েছে যা ভারতের সংবিধানের প্রাথমিক ধারণাগুলির যেমন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সামাজিক সাম্যের বিরোধী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নয়াউদারবাদের সমর্থকরা এই কথাটা ভুলে যান যে, উদারনীতির ফলে যেমন হয়ত জিডিপি বৃদ্ধির হার বেড়েছে তেমন খেটে খাওয়া মানুষের অবস্থাও শোচনীয় হয়ে উঠেছে, এবং আঘাত নেমে এসেছে সেই মূল নীতিগুলির উপরে যার উপর ভিত্তি করেই আধুনিক ভারত গড়ে উঠতে পারে।
অনুবাদঃ শিঞ্জিনী সরকার