E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২ সংখ্যা / ২০ আগস্ট, ২০২১ / ৩ ভাদ্র, ১৪২৮

বহু লড়াই আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ভাইজাগ স্টিল বাঁচাতে শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে

শংকর মুখার্জি


রাষ্ট্রীয় ইস্পাত নিগম লিমিটেড, ভাইজাগ স্টিল নামেই দেশবাসীর কাছে বেশি পরিচিত। রাষ্ট্রায়ত্ত নবরত্ন সংস্থা। বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার গত ২৭ জানুয়ারি ভাইজাগ স্টিলের স্ট্র্যাটেজিক সেল হবে বলে ঘোষণা করেছে।

অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই ইস্পাত কারখানা গড়ে উঠেছিল। ১৯৬৩ সালে এই আন্দোলন শুরু হয়, যা ’৬৬ সাল থেকে রাজ্যে গণআন্দোলনের রূপ নেয়। কারখানা তৈরির দাবিতে অনশন, রাজ্যজুড়ে ধর্মঘট সংঘটিত হয়। যে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন টেন্নেটি বিশ্বনাধম, গৌথু লাচচান্না, পি সুন্দরাইয়া, সি রাজেশ্বর রাও, এন গিরিপ্রসাদ রাও, এন নাগা রেড্ডি এবং ভি গোপালাকৃষ্ণাইয়ার মতো রাজনৈতিক নেতৃত্ব। অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়, অন্ধ্র মেডিক্যাল কলেজ, এভিএন কলেজ সহ গুন্টুর কৃষ্ণা, ওয়ারঙ্গল, পূর্ব গোদাবরী জেলার বহু কলেজের ছাত্রছাত্রী রাজ্যে ইস্পাত কারখানা তৈরির দাবিতে জঙ্গি আন্দোলন গড়ে তোলে। ওই দীর্ঘ সংগ্রামে পুলিশের গুলিতে বিশাখাপত্তনম, বিজয়ওয়াডা, গুন্টুর, ভিজিয়ানাগ্রাম, পলাসা, কাকিন্দা, রাজামুন্দ্রি, ওয়ারঙ্গল, সিলেরু, জাগতিয়াল প্রভৃতি স্থানে ৩২ জন শহিদ হন। এই দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পরিণতিতেই ১৯৭১ সালের ২০ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভাইজাগ স্টিলের শিলান্যাস করেন। প্রায় ২০ বছরের দীর্ঘ লড়াইয়ের শেষে ১৯৮২ সালে ৬৮টা গ্রামের ২২ হাজার একর অধিগৃহীত জমির ওপর ইস্পাত কারখানার কাজ শুরু হয়। ১৯৯০ সালের ২০ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিং কারখানার প্রথম ব্লাস্ট ফারনেস ‘গোদাবরী’র উদ্বোধন করেন। এবং পরিশেষে আন্দোলন শুরু হওয়ার প্রায় ২৯ বছর পর ১৯৯২ সালের ১ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাও দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় এই নতুন সৌধটিকে জাতির উদ্দেশে উৎসর্গ করেন। যদিও উৎপাদনের প্রক্রিয়া ১৯৯০ সাল থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রাথমিক স্তরে ভাইজাগ স্টিলের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল বাৎসরিক ৩.২ মিলিয়ন টন। ২০০৬ সালে এর উৎপাদন ক্ষমতা সম্প্রসারিত করে বাৎসরিক ৬.৩ মিলিয়ন টন করা হয়। এর উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। এই তিন প্রধানমন্ত্রীই ভাইজাগ স্টিলকে বিশাখাপত্তনম শহর, অন্ধ্র রাজ্য এবং দেশের গৌরব বলে বর্ণনা করেছিলেন। বর্তমানে উৎপাদন ক্ষমতা আরও সম্প্রসারিত হয়ে বাৎসরিক ৭.৩ মিলিয়ন টন হয়েছে।

অন্ধ্রপ্রদেশ তো বটেই দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে এই সংস্থার। এই স্টিল প্ল্যান্টের ১০০ শতাংশ মালিকানা রয়েছে ভারত সরকারের হাতে। স্ট্র্যাটেজিক সেলের অর্থ হলো মালিকানার সমস্তটাই এক বা একাধিক করপোরেট সংস্থার কাছে বিক্রি করবে ভারত সরকার। এর বিরুদ্ধে ভাইজাগ স্টিলের শ্রমিকরা বিশাখা উক্কু পরিরক্ষণা পোরাটা কমিটি (স্ট্রাগল কমিটি টু সেভ ভাইজাগ স্টিল) গড়ে লড়াই শুরু করেছেন। ২৯ ও ৩০ জুন তারা সার্বিক ধর্মঘট সংগঠিত করেছেন স্টিল প্ল্যান্টে। সেই লড়াইয়ের প্রতি কৃষক-খেতমজুর সহ গণআন্দোলনের অন্যান্য শক্তি সংহতি জানিয়েছে; এবং যুক্ত কর্মসূচি নিয়েছে। ১৮ এপ্রিল শ্রমিক-কৃষক-কর্মচারী সহ সমাজের সর্বঅংশের মানুষকে নিয়ে বিশাল সমাবেশ হয়েছে বিশাখাপত্তনমে। অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ওয়াই এস জগমোহন রেড্ডি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি দিয়ে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আরজি জানিয়েছেন। কারখানার শ্রমিক প্রতিনিধিদল কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ও ইস্পাত মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন এবং বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানান। তবে সরকার এখনও পর্যন্ত তাদের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে।

বাস্তবে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ কিংবা বেসরকারিকরণ ভারতে গত তিন দশকের নয়াউদারবাদী জমানায় নতুন কিছু নয়; শুধু এ জমানায় বেসরকারিকরণের নাম বদলিয়ে হয়েছে স্ট্র্যাটেজিক সেল, আর আরও আগ্রাসী হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া। বিজেপি সরকারের নীতিগত অবস্থানই হচ্ছে, স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রে কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ছাড়া সব বেচে দেওয়া হবে। রাষ্ট্রীয় ইস্পাত নিগম লিমিটেডের (আরআইএনএল) বেসরকারিকরণের পরিকল্পনা সেই লক্ষ্যের প্রতি অগ্রসর হওয়ারই একটা ধাপ।

এটা সত্য যে, ভাইজাগ স্টিল ২০১৬ সাল থেকে লোকসানে চলছে। প্রথমদিকে কয়েক বছর লাভের মুখ না দেখলেও, তারপর দীর্ঘদিন লাভ করেছে এই সংস্থা।সম্প্রতি এই লোকসানের পেছনে অনেক কারণ আছে। সেগুলি অতিক্রম করাও শক্ত নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন, যা দেখাতে অপারগ আজকের কেন্দ্রীয় সরকার। সে আলোচনায় আমরা পরে আসছি। পাশাপাশি এটাও সত্য যে, গত ২৮ বছরে এই লাভ-লোকসানের হিসেবে পাল্লা লাভের দিকেই ভারী। সম্মিলিত লাভের অঙ্ক ১৮ হাজার ৬৯ কোটি টাকা এবং সম্মিলিত লোকসান ১২ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এই হিসেবে লাভের দিকে অঙ্কটা ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।

১৯৭১ সালে যখন এই প্রকল্পের শিলান্যাস হয় তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৯০০ কোটি টাকার মতো। কিন্তু বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে এই প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে ভারত সরকার দিয়েছিল ৪ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা, বাকিটা বাজার থেকে সংগ্রহ করেছিল সংস্থা। শিলান্যাসের সময় ঠিক হয়েছিল এটা স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া করবে। পরবর্তী সময়ে ১৯৮২ সালে একটি নতুন কোম্পানি রাষ্ট্রীয় ইস্পাত নিগম লিমিটেড তৈরি করে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে দুবার সম্প্রসারণের কাজ হয়েছে। প্রথমবার ৬.৩ মিলিয়ন টনে বাৎসরিক উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং পরে উৎপাদন ৭.৩ মিলিয়ন টনে নিয়ে যাওয়ার জন্য ৯ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়। এই দুই ক্ষেত্রেই বিরাট পরিমাণ টাকা বাজার থেকে ঋণ নিয়ে অর্থ সংস্থান করেছে আরআইএনএল নিজেই। বিভিন্ন সময়ে এই নির্মাণের জন্য বাজার থেকে যে ঋণ নিয়েছিল তার সুদ বাবদ বহু টাকা দিয়ে চলতে হচ্ছে আরআইএনএল’কে। ২০১৯-২০ সাল পর্যন্ত এ বাবদ আরআইএনএল খরচ করেছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে সংস্থার আার্থিক দায় বেড়ে যাবার পেছনে এটাও একটা কারণ।

ইস্পাত কারখানার নিজস্ব আকরিক লোহার খনি থাকলে উৎপাদন ব্যয় কম হয়, সর্বোপরি অনেক মসৃণ হয় উৎপাদন প্রক্রিয়া। ভাইজাগ স্টিলের নিজস্ব খনি অর্থাৎ ক্যাপটিভ মাইনস নেই। যেখানে টাটা, মিত্তল, আদানিদের ইস্পাত কারখানার ক্যাপটিভ মাইনস রয়েছে। দেশের সরকারই এসব ব্যবস্থা তাদের করে দিয়েছে। কিন্তু ভাইজাগ স্টিল দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ক্যাপটিভ মাইনসের আবেদন করে আসছে। সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটিও একই সুপারিশ করেছে। ইস্পাত ও খনি মন্ত্রকের অধীনে আরআইএনএল একটি সংস্থা হওয়া সত্ত্বেও এইসব আবেদন ও সুপারিশে কর্ণপাত করছে না কেন্দ্রীয় সরকার। আরেকটি ঘটনার কথা শুনলে সবাইকে অবাক হতে হবে। আজ থেকে ১০ বছর আগে ভাইজাগ স্টিল ওডিশা মাইনিং ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনকে আকরিক লোহা খনির জন্য ৩৬০ কোটি টাকা দিয়েছিল। এখনও এক টুকরো লোহাও সেই খনি থেকে পায়নি ভাইজাগ স্টিল। কেন্দ্রীয় সরকার সামান্য উদ্যোগ নিলেই এটা সম্ভব হতো। কিন্তু এর জন্য ভাইজাগ স্টিলকে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বাইরে থেকে বেশি দাম দিয়ে সংস্থাকে প্রধান কাঁচামাল আকরিক লোহা কিনতে হচ্ছে। যদি নিজস্ব খনি থাকত তাহলে প্রতি টনে উৎপাদন ব্যয় ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা কম হতো। এখন খোলাবাজারে ইস্পাত বিক্রি করতে গিয়ে দামের যে প্রতিযোগিতার মধ্যে ভাইজাগ স্টিলকে পড়তে হচ্ছে সেখানে তারা অনেকটা এগিয়ে থাকত। গত কয়েক বছরে এই ইস্পাত কারখানার লোকসানের পেছনে এটা একটা বড়ো কারণ। এই সমস্যা সমাধানের উপায় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই ছিল। তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেই তারা তা করতে পারত। আর ভাইজাগ স্টিলকেও লোকসানের মুখ দেখতে হতো না।

ভাইজাগ স্টিলের নির্মাণ কার্যের সময়ে ওই ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়া এই ইস্পাত প্রকল্পে গত ২৯ বছরে ভারত সরকার এক টাকাও বিনিয়োগ করেনি। কিন্তু আরআইএনএল এই সময়কালে লভ্যাংশ ও বিভিন্ন কর ও রাজস্ববাবদ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় কোষাগারে ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি জমা দিয়েছে। ২০১৮-১৯ এবং ১৯-২০ সালে এই সংস্থার মোট আয় হয়েছে যথাক্রমে ২০ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা এবং ১৫ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। এসব বিবেচনায় না এনেই শুধুমাত্র সম্প্রতি কয়েক বছরের লোকসানকেই সামনে আনা হচ্ছে।

ভাইজাগ স্টিলের ১৯ হাজার একরেরও বেশি ফাঁকা জমি আছে। যার বর্তমান বাজারমূল্য ১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। স্ট্র্যাটেজিক সেলের মধ্য দিয়ে এই বিশাল সম্পদকে জমি হাঙরদের হাতে তুলে দেওয়ারও ভাবনা রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের।

নয়াউদারবাদী জমানার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে কর্মসংস্থানহীন উন্নয়ন। কিন্তু ভাইজাগ স্টিলে গত ২৯-৩০ বছরে কর্মসংস্থান বেড়েছে। ১৯৯০-৯১ সালে অর্থাৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার প্রথম বছরে এই ইস্পাত কারখানায় কাজ করত ১৪ হাজার ৪৩৩ জন, আর ২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষে তা বেড়ে হয়েছে ১৭ হাজার ৫৬৬ জন। এই কারখানার যখন বেচে দেওয়ার কথা ঘোষণা করল কেন্দ্র ঠিক তার আগের মাসে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদন সর্বোচ্চ স্তরে (৭.৩ মিলিয়ন টনের মধ্যে ৬.৩ মিলিয়ন টন) পৌঁছতে পেরেছে এবং মাসিক মুনাফার পরিমাণও প্রায় ২০০ কোটি টাকা ছুঁয়েছে।

এই পরিপ্রক্ষিতে ভাইজাগ স্টিলের শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে এই রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ বাঁচাতে ক্যাপটিভ মাইনস বরাদ্দ করা এবং ঋণের অঙ্ককে ইক্যুইটিতে পরিবর্তন করার দাবি জানিয়েছে। এটা রূপায়ণ করা কেন্দ্রের পক্ষে খুব একটা শক্ত কাজ নয়, শুধু দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছার। কিন্তু সেই সদিচ্ছা তারা যে দেখাবে না তা আমরা জানি। শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনে গণআন্দোলনের অপরাপর শক্তিগুলিকে শামিল করাতে হবে আরও ব্যাপকভাবে শাসককুলের এই দেশবিরোধী মনোভাব পরিবর্তনে বাধ্য করতে। সেই দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। আর রাজ্যের জনগণকেও এই আন্দোলনে নিয়ে আসতে হবে। এই ইস্পাত কারখানা তৈরিতে গত শতকের ষাটের দশকে অবিভক্ত অন্ধ্রের জনগণের লড়াই, আত্মত্যাগ অবিস্মরণীয়। সেই ইতিহাসকে সামনে নিয়ে এসে নবীন প্রজন্মকে এই রাষ্টায়ত্ত সম্পদ বাঁচানোর লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এই রাজনৈতিক দায়িত্ব কারখানার শ্রমিকদের নিতে হবে, নিতে হবে বৃহৎ অংশের মেহনতি জনগণকে।