E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২ সংখ্যা / ২০ আগস্ট, ২০২১ / ৩ ভাদ্র, ১৪২৮

জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না

অম্বিকেশ মহাপাত্র


কার্টুন, গণতান্ত্রিক দেশে স্বাধীন মতপ্রকাশের একটি বহুল ব্যবহৃত এবং সমাদৃত মাধ্যম। নিউজ মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কার্টুনের ব্যবহার বহু বহু গুণ বেড়ে গেছে। এমনই প্রেক্ষিতে ২০১২ সালে ভারতের সংসদে রেল বাজেট ঘিরে নজিরবিহীন ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির দলের সাংসদ তথা রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী রেল বাজেট পেশ করে নেত্রীর রোষানলে পড়েন। নেত্রীর ইচ্ছায় মন্ত্রী পদ থেকে অপসারিত হন এবং অপর সাংসদ মুকুল রায় সেই পদে অভিষিক্ত হন। অর্থাৎ রেল বাজেট পেশের সময়ের মন্ত্রী বাজেট পাশের সময় ভ্যানিশ!

এই নজিরবিহীন ঘটনায় তৈরি হলো কোলাজ কার্টুন। বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’র শিশু চরিত্র মুকুল এবং চলচ্চিত্রের নির্বাচিত ডায়ালগ ব্যবহার করে। কার্টুনটি সমকালীন, নিরীহ, হাস্যরসাত্মক, বুদ্ধিদীপ্ত এবং দৃষ্টি-আকর্ষণী। সেই কারণেই অনবদ্য কালজয়ী সৃষ্টিকর্ম বা শিল্পকলা। যিনি তৈরি করেছেন তাঁরে সেলাম। কার্টুনটি স্বল্প সময়ের পরিসরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। সেই সূত্রে কার্টুনটি আমার ই-মেল বক্সে হাজির। কার্টুনের মজা বন্ধুদের মধ্যে ভাগ করে নিতে বন্ধুদের গ্রুপ-ই-মেলে ফরোয়ার্ড করলাম।

১২ই এপ্রিল ২০১২। দিনের শেষে ক্লান্ত শরীর মন নিয়ে রাত্রিবেলা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউ গড়িয়া সমবায় আবাসনে বাড়ি ফিরছি। আবাসনের অভ্যন্তরে পথিমধ্যে দুষ্কৃতী, শাসকদল এবং পুলিশের যৌথবাহিনীর অভিযানে শাসানি-চোখ রাঙানি-প্রাণনাশের হুমকি-শারীরিক নিগ্রহের শিকার হলাম, গ্রেফতার হলাম এবং স্থানীয় পূর্ব যাদবপুর থানার লক-আপে নিক্ষিপ্ত হলাম। সঙ্গে আমাদের আবাসনের প্রবীণ আবাসিক, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত পি ডব্লিউ ডি ইঞ্জিনিয়ার সুব্রত সেনগুপ্ত। দুর্গন্ধময় প্রচণ্ড নোংরা ভ্যাপসা গরমে থানার লক-আপের মেঝেতে দু’জনের রাত্রিযাপনের পাকাপাকি বন্দোবস্ত। শাসকদল সমালোচনা, স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার মায় গণতন্ত্রকে সেই রাত্রে গরাদে চিরতরে বন্দি করতে চাইলেন! সবই পরিকল্পনামাফিক, নিখুঁত ছকে পরপর ঘটে গেল।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ গড়িয়া সমবায় আবাসন সহ সকল অংশের মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নামলেন। দুনিয়াব্যাপী নিঃশর্ত মুক্তি এবং মামলা প্রত্যাহারে দাবি সোচ্চারিত হলো। কলকাতা পুলিশ আলিপুর ক্রিমিনাল কোর্টে আমাদের উপস্থিত করে নিজেদের হেপাজতে নিতে চাইলেও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জামিন মঞ্জুর করলেন। শুরু হলো দীর্ঘসূত্রি বিচার প্রক্রিয়া।

আসুন, সংক্ষেপে জেনে নিই গত ৯ বছরের বেশি সময়কালের বিচার প্রক্রিয়ার সালতামামি -

১২ এপ্রিল ২০১২। 114, 500, 509 of IPC এবং 66A (b) of IT Act ধারায় গ্রেফতার এবং লক-আপে রাত্রিবাস।

১৩ এপ্রিল ২০১২। আলিপুর ক্রিমিনাল কোর্ট আমাদের জামিন মঞ্জুর করে।

১৬ এপ্রিল ২০১২। রাজ্য মানবাধিকার কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত তদন্ত শুরু করে।

১৯ জুলাই ২০১২। তদন্তকারী পুলিশ অফিসার মিলন কুমার দাস 114, 500, 509 of IPC বাতিল করে কেবলমাত্র 66A (b & c) of IT Act ধারায় ৯৬ পৃষ্ঠার চার্জশিট আলিপুর কোর্টে জমা করেন।

১৩ আগস্ট ২০১২। মানবাধিকার কমিশন ১২ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্ট সহ দু’টি সুপারিশ রাজ্য সরকারের কাছে পাঠায়। উল্লেখযোগ্য অংশ নিম্নরূপ - “The Commission recommends:
(i) State Govt. shall initiate departmental proceedings against Shri Milan Kumar Das, Addl. O.C., Purba Jadavpur PS and against Shri Sanjoy Biswas, S.I. of Police, Purba Jadavpur PS within a period of six weeks from the date.

(ii) The State Govt. must compensate both Professor Ambikesh Mahapatra and Sri Subrata Sengupta, the two arrestees for the manner in which they were arrested from their residential complex and detained in the thana in a case which is about non-cognizable offence. Their compensation is assessed at fifty thousand to be paid to each of them by the State Govt. within a period of six weeks from the date.”

And “The State Govt. is requested to inform this Commission about the action taken on the basis of the recommendations within a period of two months from the date of communication.”

২৬ নভেম্বর ২০১২। দিল্লি নিবাসী আইনজীবী পরিবারের সন্তান, আইনের ছাত্রী শ্রেয়া সিঙ্ঘাল 66A of IT Act বাতিলের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন। সেই মামলায় বিভিন্ন নাগরিক অধিকার মঞ্চ‌ যুক্ত হয়। আমিও সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের সহায়তায় উক্ত মামলায় যুক্ত হই।

৩ মে ২০১৩। রাজ্য সরকার, দীর্ঘ টালবাহানা শেষে, মানবাধিকার কমিশনের দু’টি সুপারিশ বাতিল করে।

১ জুন ২০১৩। আলিপুর কোর্ট চার্জশিট চূড়ান্তরূপে গ্রহণ করে। পরবর্তীতে কেস ডিসচার্জ করার জন্যে আমাদের তরফে পিটিশন দাখিল করা হয়।

৭ নভেম্বর ২০১৩। আমি ও সুব্রত সেনগুপ্ত মানবাধিকার কমিশনের দু’টি সুপারিশ কার্যকর করার দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টে পিটিশন দাখিল করি।

১০ মার্চ ২০১৫। হাইকোর্ট চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে। রায়ের উল্লেখযোগ্য অংশ নিম্নরূপ -
“In the result, the writ petition succeeds in part. Relief claimed is moulded by declaring that the petitioners’ human rights were indeed violated by public servants; consequently, the State Govt. shall adequately compensate the petitioners. They shall be entitled to Rs. 50,000/- each as compensatory relief, to be released within a month from date of service of a certified copy of this judgment and order. Within the aforesaid period, disciplinary proceedings shall be initiated against R-4 (Sanjoy Biswas, SI, Purba Jadavpur PS) and R-5 (Milan Kumar Das, Addl OC, Purba Jadavpur PS) and the same shall be taken to its logical conclusion strictly in accordance with law and without being influenced by any observation made or finding arrived at in this judgment against R-5 and R-4.”

With “The petitioners shall be entitled to costs of this proceeding assessed at Rs. 50,000/- to be paid to them by the State Govt. within the aforesaid period of one month.”

২৪ মার্চ ২০১৫। সুপ্রিম কোর্ট জনস্বার্থ মামলার চূড়ান্ত রায় দেয়। রায়ের নির্যাস - 66A of IT Act অসংবিধানিক। আজ থেকে এই ধারা বাতিল। এই রায়ের প্রেক্ষিতে আলিপুর কোর্টের কেস ডিসচার্জ করার জন্যে আমাদের তরফে আবার পিটিশন দাখিল করা হয়।

১৭ এপ্রিল ২০১৫। রাজ্য সরকার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করে। ৬ বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত। ডিভিশন বেঞ্চ সিঙ্গল বেঞ্চের অর্ডার বাতিল করেনি; অর্ডারের উপর স্থগিতাদেশও দেয়নি। অপরদিকে রাজ্য সরকার সিঙ্গল বেঞ্চের অর্ডার কার্যকরও করে নি। আজ আপিল মামলা কী অবস্থায় আছে? আমাদের জানা নেই!

অপরদিকে আলিপুর কোর্ট কার্টুন-কাণ্ডের কেসে চার্জ গঠন বা ডিসচার্জ না করে বছরের বছর ফেলে রাখে। এমতাবস্থায় আইনজীবীর পরামর্শে আলিপুর কোর্টের কেসের দ্রুত নিষ্পত্তি চেয়ে নভেম্বর ২০১৭ ভীষণ অসুস্থ সুব্রত সেনগুপ্ত হাইকোর্টে পিটিশন দাখিল করেন। হাইকোর্ট প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ায় আলিপুর কোর্টে কেস পড়েই থাকে। ইতিমধ্যে সুব্রতবাবুর জীবনে সেই শেষের দিন ঘনিয়ে আসে। ১১ মে ২০১৯ দীর্ঘ রোগ ভোগের পর সুব্রতবাবু পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্যে বিদায় নেন। ফলশ্রুতিতে আলিপুর কোর্টের কেসের দ্রুত নিষ্পত্তি চেয়ে হাইকোর্টের মামলা বাতিল হয়ে যায়।

এরপর করোনার প্রবেশ। বিশ্বব্যাপী অতিমারী। দেশব্যাপী লক-ডাউন, টোটাল লক-ডাউন। আলিপুর কোর্ট এবং হাইকোর্টের কেস ফাইলগুলো টোটাল লক-ডাউনে। বিশ্ব ২০২০ পেরিয়ে ২০২১ সালে প্রবেশ করে। বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশ ও রাজ্য ধীরে ধীরে সচল হচ্ছিল। আমাদের রাজ্যে বিধানসভার সাধারণ নির্বাচন সংঘটিত হলো। কিন্তু আলিপুর এবং হাইকোর্টের কেস দু’টির কোনও নড়াচড়া নেই। e-Court India সরকারি ওয়েবসাইট থেকে জানা যাচ্ছিল - আলিপুর কোর্টের পরবর্তী শুনানির দিন ২৩ নভেম্বর ২০২১। এই পরিস্থিতিতে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় সংবাদপত্রের সংবাদ শিরোনাম সহ সংবাদ নির্যাস - ‘৬ বছর আগে সুপ্রিম কোর্ট অর্থাৎ শীর্ষ আদালত 66A of IT Act ধারা বাতিল করার পর দেশজুড়ে ঐ ধারায় মামলা ও গ্রেফতার চলছে কী করে? কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপ্রিম কোর্ট হলফনামায় বক্তব্য জানতে চায়।’

১২ আগস্ট ২০২১ বিকেল সাড়ে ৩টে নাগাদ, আলিপুর কোর্টের আমাদের আইনজীবী ফোনে জানান - ‘আলিপুর ক্রিমিনাল কোর্টের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ডেকে জানিয়েছেন আগামীকাল (১৩ আগস্ট) জরুরিভিত্তিতে শুনানি নেবেন। ১৬ আগস্টের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টকে কেস-স্ট্যাটাস জানাতে হবে, সেকারণেই।’ অগত্যা ১৩ তারিখ ক্লাস ফেলে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্ট ঘরে উপস্থিত হলাম বেলা ১২টা নাগাদ। আমার সঙ্গে ‘আক্রান্ত আমরা’ মঞ্চের ৬ জন বন্ধু। প্রায় ১ ঘণ্টার শুনানি। আমাদের পক্ষে ২ জন আইনজীবীর বিপরীতে সরকার পক্ষের ১৩ জন। সরব শুনানি। ভাবলাম, আজই চূড়ান্ত হবে। বিচারক বলবেন - ‘66A of IT Act-এ এই কেস চলতে পারে না।’ অতএব মামলা বাতিল অর্থাৎ ডিসমিসড। শুনানি শেষে কোর্ট ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের আইনজীবী জানালেন - ‘বিচারক অর্ডার রিজার্ভে রাখলেন, ১৬ আগস্ট অর্ডার দেবেন।’ পরের দিন প্রভাতী দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম - ‘সংক্রমিত বিচারক।’ আমাদের কেসের শুনানির পর করোনা সংক্রমিত বিচারক কোর্ট ছেড়ে চলে যান। তাহলে ১৬ আগস্ট অর্ডারের কি হবে? হ্যাঁ আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হলো।

১৬ আগস্ট, ২০২১ আমাদের আইনজীবী চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্ট ঘরে গিয়ে জানলেন, অর্ডার দেওয়া পিছিয়ে গেছে। বিচারক অর্ডার দেবেন ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১। এরপর কি হবে, বলবার অধিকারী আমি নই। কারণ আমি জ্যোতিষী মানি না। আমি শিক্ষক, বিজ্ঞানের শিক্ষক। অভিজ্ঞতা থেকে শিখি এবং সেটাই সঠিক শিক্ষা। অর্থাৎ ‘অভিজ্ঞতাই শিক্ষক’। এখানে আবার বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’র ডায়ালগ বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

“হীরক রাজের কাছে, যদি ধরা হয় সরা, তবে রাত হবে দিন।
এ আর এমন কি কঠিন?
লগ্ন তো সম্রাটের হাতে।
পঞ্জিকা কি বলে, কি এসে যায় তাতে?”


আর বিজ্ঞানের শিক্ষক আমার মত কি? সাধারণের যা মত আমারও ঠিক তাই। যাকে লোকশ্রুতি বলে -
“Justice Delayed, Justice Denied”
“বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে”

মানুষের ঠাকুর রবি ঠাকুরকে উদ্ধৃত করে নিবন্ধের শিরোনাম; রবি ঠাকুরকে উদ্ধৃত করে শেষও করলাম। সবশেষে আবার রবি ঠাকুরকে উদ্ধৃত করি -
“মনেরে আজ কহ যে
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।”