৫৯ বর্ষ ২ সংখ্যা / ২০ আগস্ট, ২০২১ / ৩ ভাদ্র, ১৪২৮
সোচ্চার চিন্তা
জাতিভেদ আর বর্ণবিদ্বেষঃ মূঢ়তা? মুর্খতা? শয়তানি? না-কি সবই!
পল্লব সেনগুপ্ত
এই গল্পের শেষটা দুঃখজনক হলেও, এটা কিন্তু একটা সামাজিক বিদ্রূপ বা সোশ্যাল স্যাটায়ার হিসেবেও গণ্য হওয়া উচিত। কেন, তা একটু পরে আপনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে।... এই কাহিনিটা আসলে তামিলনাড়ুর একটা প্রচলিত লোককথা। গল্পের শুরুতে আছে যে, বিশাল ফোঁটা-তিলক-টিকিধারী একজন দোর্দণ্ড-ধার্মিক আয়ার কিংবা আয়েঙ্গার ব্রাহ্মণ খালের ওপরে পাতা একটা বাঁশের সাঁকোর ওপর দিয়ে এপার থেকে ওপারে যেতে গিয়ে পা ফস্কে জলে পড়ে গেছেন। ভক্ত ব্রাহ্মণটি সাঁতার-টাতার জানতেন না আদৌ - বরাবরই ধর্মকর্ম নিয়ে থেকেছেন। খালটা কিন্তু একটু - বেশ একটু গভীরই, ফলে জলে পড়ে উনি আঁকুপাকু করছেন। এমন সময়ে সাঁকোর ওপরে আসেন জাল কাঁধে নিয়ে একজন ধীবর - স্থানীয় সামাজিক সংস্কারে, যাঁরা ‘তিয়র’ নামে পরিচিত এবং অস্পৃশ্য!
বিপন্ন ব্রাহ্মণ বটুকে উদ্ধার করার জন্যে তিয়র ছেলেটি জালটার একদিক জলে ছুঁড়ে দেয়। প্রবীণ বামুনঠাকুর তো হাতে জাল পেলেন না, যেন আকাশের চাঁদটাই নাগালে পেলেন! জালবন্দি অবস্থায় জল থেকে ডাঙায় উঠে তো দু’হাত তুলে অনেক আশীর্বাদ-টাশির্বাদ করলেন জীবনদাতা তিয়রকে। তারপরেই ওঁর মাথায় চাগিয়ে উঠল ‘গুরুতর’ একটি প্রশ্ন : উনি তিয়র ছেলেটিকে শুধোলেন, ‘‘হ্যাঁ রে, তোর জালটা ক’হাত লম্বা?’’ সে-ছেলে সরল মনে জবাব দিল ‘‘আজ্ঞে ৪৮ হাত!’’ শুনেই বটুপ্রবর ‘‘হা হতোস্মি!’’ বলে ফের ঝাঁপ দিলেন ওই খালের জলেই।
স্থানীয় বিশ্বাসে, স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যের মধ্যে ছোঁয়াছানির প্রটোকল ছিল যে, ‘অচ্ছুৎ’ বলে যাঁদেরকে দেগে-দেওয়া হয়েছে পরম্পরাক্রমে, ঘটনাচক্রে তাঁদের কেউ যদি ব্রাহ্মণ-টাহ্মণদের ৫০ হাতের মধ্যে এসে পড়েন, তাহলে হয় সেই দুর্ভাগাকে চূড়ান্ত শাস্তি পেতে হবে, আর নয়তো বামুন মশাইকে ঘোরতর প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে ওই আয়ার কিংবা আয়েঙ্গারের পক্ষে তক্ষুণি কোনওটাই করা সম্ভব ছিল না যেহেতু তাই - তিয়রের ছোঁয়া এই দেহটা রেখে আর কী লাভ?...
।। দুই ।।
গল্পটার মধ্যে যে-তির্যক বিদ্রূপ নিঃশব্দে ফুটে উঠেছে, তা তো বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতের জাতিভেদ-প্রথার নির্বোধ চরিত্রটি এতে সুস্পষ্ট। জাতিভেদ-বিশ্বাস এবং অস্পৃশ্যতার ঘটনা তো এদেশে অবিরল। তবু হঠাৎ এই লোককাহিনিটিকে আলোচনায় আনলাম, তার কিন্তু দু’টো-একটা খুব সাম্প্রতিক উপলক্ষ আছে, যেগুলি হয়তো আপনারা জেনেছেন, অথবা খেয়াল করেন নি। অথচ, আমাদের জাতিগত মানসিকতার দৈন্যের চোখে-আঙুল-দেওয়া সূচক সেগুলো।
বন্দনা কাটারিয়া
এবারের অলিম্পিকে এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে ভাল ফল করেছে ভারত সোনাসহ ৭টি মেডেল জিতে। এবং এই কৃতিত্বের একটা খুব বড়ো ভাগ আমাদের মেয়েদের। তাঁদেরই একজন, মহিলা হকি দলের বন্দনা কাটারিয়া - যিনি একমাত্র ভারতীয় মহিলা অলিম্পিকে গোলের হ্যাটট্রিক করার ক্ষেত্রে এবং এবারেও দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা। ভারতীয় মহিলা দল দুর্দান্ত খেলেও শেষ পর্যন্ত হেরে যাওয়ায় তাঁর বাড়ির সামনে একদল হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী দ্বিপদ-শ্বাপদ হামলা করে। তাদের বক্তব্য বন্দনাদের মতো ক’জন ‘অস্পৃশ্যবর্গীয়া’ মেয়ে হকি দলে ছিল বলেই না-কি, তারা শেষ পর্যন্ত হেরে গেছে। সুতরাং, বাড়ি ভাঙচুরের চেষ্টা করে, বন্দনার বাড়ির লোকদের মেরেধরে ওই নরশ্বাপদগুলি হিঁদুয়ানির বিজয়বার্তা ঘোষণা করেছে। খবরে প্রকাশ যে, ওই গুন্ডাদের মধ্যে একজন না-কি হকি প্লেয়ারও ছিল, যে উত্তরাখণ্ডের হয়ে খেলেওছে।... ঘটনাচক্রে, বন্দনা এখন ন্যাশনাল আইডলদের একজন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিও অর্জন করেছেন রাতারাতি, সুতরাং দায়ে পড়ে উত্তরাখণ্ডের বিজেপি সরকারের পুলিশ গুন্ডাগুলোকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু অচেনা কোনও ‘তথাকথিত অস্পৃশ্য’ মেয়ের ক্ষেত্রেও কি পুলিশ এটা করত?...না।
পি ভি সিন্ধু
দ্বিতীয় ঘটনা, পি ভি সিন্ধুকে নিয়ে - যিনি একমাত্র ভারতীয় - পুরুষ-মহিলা-নির্বিশেষে - পরপর দু’টি অলিম্পিকে মেডেল জিতেছেন। এই অসামান্য কৃতিত্বের পর ফেসবুক, টুইটার - ইত্যাদিতে তাঁর যাবতীয় তথ্য জানতে উৎসাহের ঝড় উঠেছে। এবং প্রশ্নগুলির মধ্যে ৮৬ ভাগ হলো, সিন্ধু ভারতীয়-বর্ণবিভেদী-সমাজের কোন্ জাতিবর্গের মানুষ? ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র, বৈশ্য, না দলিত ওরফে অচ্ছ্যুৎ? তাঁর সাধনা, একাগ্রতা ইত্যাদি নিয়ে ১০% মতো, রূপের ব্যাখ্যানা জানতে চেয়ে ৩% মতো এবং পড়াশুনোর ব্যাপার জানার ব্যাপারে মাত্র ১%!... এখানেও এই প্রতিভাময়ীর জাতপাতটাই বড়ো হয়ে উঠল, এমনই আমাদের সমাজ!
।। তিন ।।
খেলাধুলোর ক্ষেত্রে এমন স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যভেদ খুব প্রকট না হলেও, একেবারে অপ্রচ্ছন্নও নয়। শতাব্দীপ্রাচীন একটা প্রসঙ্গ এখানে স্মরণ করা যায়। ১৯ শতকের শেষদিকে এবং ২০ শতকের শুরুতে বালু নামে একজন খুব নামি ক্রিকেটার ছিলেন। জন্মসূত্রে তিনি ‘তথাকথিত অস্পৃশ্য’-বর্গীয় ছিলেন বলে তাঁর ওপর অন্য ক্রিকেটাররা অবিচার (প্রায় অত্যাচারও, অনেক সময়ে!) করতেন হামেশাই। প্রতিভাবান ওই খেলোয়াড় দিনের পর দিন বসে থাকতেন, টিমের প্লেয়িং ইলেভেনে চান্স পেতেন না। বরং অন্যরা তাঁকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ফাই-ফরমাসও খাটাতেন। টিমে তখন, রাজা-মহারাজাদের ভিড় - খেলতে পারুন, আর না-ই পারুন তাঁরা।
পালওয়ানকার বালু
ঘটনাচক্রে, একবার ইংল্যান্ডে ওই রকম একটি দল গড়ে নিয়ে যাওয়া হলে - দায়ে পড়ে বালুকে মাঠে নামাতে বাধ্য হন তাঁরা - লোক কম্তি ছিল! তারপর থেকে অন্তত, মাঠে আর তাঁকে পিছিয়ে পড়ে থাকতে হয়নি। নিজের প্রতিভা এবং দক্ষতার জোরে বালু তাঁর প্রতিষ্ঠা কেড়ে নেন স্বার্থপর ‘উচ্চবর্ণীয়’-দের হাত থেকেই। তবে, মাঠের বাইরে স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যের প্রভেদটা কোনও দিনই ঘোচেনি তাঁর জীবনে।
আমির খানের ‘লগান’ সিনেমার কথা মনে আছে? ব্রিটিশ আর্মির সঙ্গে ‘খাজনা’ বাজি রেখে ভুবনের নেতৃত্বে গাঁয়ের মানুষদের সেই ক্রিকেট ম্যাচে কাচ্রা নামে একটি পোলিওগ্রস্ত দলিতবর্গীয় ছেলেকে খেলানো নিয়ে প্রচুর অশান্তির ছবি সেখানে দেখানো হয়েছে। পরে অবশ্য কাচ্রার বিচিত্র-গুগলি বল এবং ভুবনের অকুতোভয়, অপরাজেয় ব্যাটিঙের সুবাদেই গ্রামের দল জেতে, ব্রিটিশ আর্মি টিম হারে। মনে করা যায়, আর্মি দলকে হারানোর ঘটনাটা ১৯১১ সালে মোহনবাগানের ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে হারিয়ে আই এফ এ শিল্ড জেতার ইতিহাসের প্রেরণাজাত। আর কাচ্রা, বালুরই আদলে তৈরি!
।। চার ।।
স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যের ব্যাপারটা আরেকভাবে প্রকট হয়েছিল ১৯৩৬-এর বার্লিন অলিম্পিকে। ৪টি গোল্ড মেডেল বিজয়ী অসাধারণ এক অ্যাথলেটের সঙ্গে পুরস্কার বিতরণের সময় জার্মান ফুয়েরার হিটলার হ্যান্ডশেক করতে অস্বীকার করেন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সেই বিশ্ববরেণ্য ক্রীড়াবিদের নাম জেসি ওয়েন্স। তিনি ‘ব্ল্যাক আমেরিকান’ বলে তাঁর হাত স্পর্শ করতে হিটলারের অত আপত্তি ছিল!
জেসি ওয়েন্স
এই ব্যাপারটাই উত্তরকালে ক্রীড়াক্ষেত্রে ‘বর্ণবিদ্বেষ’ রূপে আখ্যাত হয়েছে। নিজেদের দেশের কালো মানুষদের প্রতি ঘৃণা এবং অত্যাচার দক্ষিণ আফ্রিকার কুখ্যাত ‘অ্যাপার্থেইড’ নামে পরিচিত ছিল। ক্রিকেটের ক্ষেত্রে এটা ‘সাদা’-রা চালু করেছিল বলে, দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বক্রিকেটে বহু বছর নির্বাসিতও ছিল।
কিন্তু আজও কি ক্রিকেটের মাঠে বর্ণবিদ্বেষ (যা, প্রকারান্তরে স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যতার প্রভেদই) কমেছে? সদ্য সদ্যই, খাস লর্ডস মাঠে ভারত-ইংল্যান্ডের টেস্টম্যাচের সময়ে ওই খেলায় সেঞ্চুরিকারী ভারতের তারকা ব্যাটসম্যান কে এল রাহুলকে বোতলের ছিপি ছুঁড়ে মারা হয় বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্যসহ। গত অস্ট্রেলিয়া সফরের সময়ে ভারতীয় বোলার সিরাজকেও ঠিক একইভাবে অপমান করা হয়। এবং ‘‘সেই (অপ) ট্র্যাডিশন আজও সমানে চলিতেছে।’’
আসলে, বিশ্বজুড়েই সাদা-কালোর যে-চোরা দ্বন্দ্ব আছে, সেটা ভাবতে এসে স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যের অপহ্নবে পরিণত হয়েছে। এদেশে এনিয়ে মূর্খতা বা অন্ধতা প্রবল, আর তাকে ধুনোর ধোঁয়া দিচ্ছে বর্তমানের শাসকগোষ্ঠী। রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে, দলমত-নির্বিশেষে ধর্মের বিধানের নামে মানবধর্মের এই অবমাননার বিরুদ্ধে এখন লড়াই করতে হবে তো! জাতিভেদ প্রথা আর বর্ণবিদ্বেষ তো একই কদর্য মানসিকতার এপিঠ-ওপিঠ। সেটা খেলার মাঠেও, মাঠের বাইরেও। প্রচ্ছন্ন সরকারি মদতে এদেশে এটার আজও রমরমা। কিন্তু আর কতদিন এটা চলতে দেবেন?