৬০ বর্ষ ২৩ সংখ্যা / ২০ জানুয়ারি, ২০২৩ / ৫ মাঘ, ১৪২৯
স্বাগত অ্যালাইদা, এস্তেফানিয়া
দীর্ঘজীবী হোক কিউবা সংহতি আন্দোলন
পঁচিশ বছর পর এরাজ্যে আসছেন বিশ্ববরেণ্য বিপ্লবী চে গুয়েভারার কন্যা ডাঃ অ্যালাইদা গুয়েভারা ও পৌত্রী এস্তেফানিয়া। বিপ্লবী পিতার উত্তরাধিকার বহন করে কিউবার বিপ্লবকে রক্ষা করা ও শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিকতার আদর্শকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে ডাঃ অ্যালাইদা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে চলেছেন। পেশাগতভাবে শিশু চিকিৎসক অ্যালাইদা অ্যাঙ্গোলা, ইকুয়েডর ও নিকারাগুয়াতে কিউবান মেডিক্যাল মিশনের সদস্যা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সমাজতান্ত্রিক কিউবায় নারীদের ক্ষমতায়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতির ক্ষেত্রেও তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ডাঃ অ্যালাইদা ১৯৯৭ সালে কলকাতায় এসেছিলেন। এর পর বেশ কয়েকবার আমাদের দেশে এলেও পশ্চিমবঙ্গে আসতে পারেননি। এ বছর কেরালার তিরুবনন্তপুরমে সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সর্বভারতীয় সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন শহরে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকছেন তিনি ও তাঁর কন্যা অর্থনীতিবিদ এস্তেফানিয়া।
পশ্চিমবঙ্গে এই কর্মসূচির অন্যতম আয়োজক সারা ভারত শান্তি সংহতি সংস্থা (AIPSO)। এছাড়া ন্যাশনাল কমিটি ফর সলিডারিটি উইথ কিউবা, বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন ও নানাবিধ গণ সংগঠন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগঠকরাও অত্যন্ত উৎসাহের সাথে এগিয়ে এসেছেন। ২০ ও ২১ জানুয়ারি চে- তনয়া তাঁর কন্যা সহ থাকছেন কলকাতায়। ১৯৫৯ সালে চে এসেছিলেন এই মহানগরে। প্রথম সফরের পরেই ভালোবেসে ফেলেছিলেন এই শহর ও তার মানুষজনকে। চে-র ক্যামেরায় ধরা আছে পাঁচের দশকের কলকাতার নগরজীবনের চালচিত্র। সে সময় বরানগরে অবস্থিত আইএসআই ক্যাম্পাসে চে এসে প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশের তত্বাবধানে চলা কর্মকাণ্ড দেখেন। তখন অ্যালাইদার জন্ম হয়নি। এবার ৬২ বছরের অ্যালাইদা ও তরুণী এস্তেফানিয়া ২০ জানুয়ারি প্রথমেই যাবেন আইএসআই-তে। এরপর টবিন রোডের মোড়ে গণসংবর্ধনা। পরবর্তী গন্তব্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে তরুণ প্রজন্মের সাথে আলাপচারিতা হবে। এখানেও হবে সংবর্ধনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
২১ তারিখ, সকালবেলা বালি থেকে উত্তরপাড়া গণভবন পর্যন্ত শোভাযাত্রার পর উত্তরপাড়া গণভবনে সম্মাননা জ্ঞাপন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এরপর দুপুরে কলেজ স্ট্রিটে জনসভা, গণসংবর্ধনা ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবেন অ্যালেইদা, এস্তেফানিয়া। যাবেন কফি হাউসে, হেদুয়ার বিজ্ঞান মেলায়, নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে অভিজ্ঞতা বিনিময় করবেন চিকিৎসকদের সাথে। এরপর ফিরে যাবেন নিজেদের দেশে।
অ্যালেইদা, এস্তেফানিয়া আমাদের দেশে এসেছেন সমাজতান্ত্রিক কিউবার প্রতিনিধি হয়ে। যে কিউবা দীর্ঘ ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বহুমুখী আক্রমণকে প্রতিহত করে সারা বিশ্বের সামনে বিপ্লবী দৃঢ়তার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সর্বাধুনিক অস্ত্রের চাইতেও যে মতাদর্শ শক্তিশালী তার প্রমাণ দিয়েছে কিউবা। ফিদেল, চে, ক্যামিলো, রাউলের মতো বিপ্লবীদের নেতৃত্বে বাতিস্তার স্বৈরশাসন থেকে এই দ্বীপরাষ্ট্রকে মুক্ত করবার পর ছয় দশক ধরে মার্কিন অবরোধের মুখে দাঁড়িয়েও মাথা নত করেনি কিউবার সংগ্রামী জনগণ। বরং দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছে ‘‘হয় সমাজতন্ত্র, নয় মৃত্যু’’। ৬৩৮ বার সিআই-এর চক্রান্তকে ব্যর্থ করে কিউবা গোটা লাতিন আমেরিকা সহ সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে সমাজতান্ত্রিক বিকল্প। কিউবা মানে সকলের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা। কিউবা মানে মাথা উঁচু করে মানুষের মতো বাঁচা। আর তাই কিউবা আলোকবর্তিকার মতো বিশ্বের সর্বত্র সমাজ পরিবর্তনের সেনানীদের পথ দেখাচ্ছে।
কিউবা মানে আন্তর্জাতিকতাবাদ। আফ্রিকার উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামে ঐতিহাসিক অবদান রেখে গিয়েছেন কিউবার বিপ্লবীরা। কেবল রাজনৈতিকভাবে জনগণের মুক্তি সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করা নয়, বিশ্বের মানুষকে সুস্থ জীবনের সন্ধান দিতে বিশ্বের চল্লিশটি দেশে হাজার হাজার কিউবান ডাক্তার কাজ করেছেন। যখন করোনা অতিমারীর গ্রাসে গোটা বিশ্ব, তখনও কিউবার ডাক্তাররা নিজেদের দেশের মানুষের প্রাণ বাঁচানোর পাশাপাশি অন্য দেশের আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বকে ধ্বংস-মৃত্যু-বিভীষিকা উপহার দিচ্ছে তখন কিউবা মানুষকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। অ্যালেইদা, এস্তেফানিয়া সেই মৃত্যুঞ্জয়ী স্বপ্নের ফেরিওয়ালা।
কিউবার সাথে ভারতের সম্পর্ক চিরকালই সহযোগিতা ও সহমর্মিতার। বিশেষ করে আমাদের রাজ্যের সাথে কিউবার সম্পর্ক দীর্ঘকালের। ‘‘তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম’’ উচ্চারণ করে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ তুলেছিল যে রাজ্য সেই পশ্চিমবঙ্গে কিউবা সংহতি আন্দোলনও ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর এ রাজ্যে তৈরি হয় কিউবা সংহতি কমিটি। তখন কিউবাকে অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ পঙ্গু করে দিয়ে সমাজতন্ত্রের মৃত্যু ঘণ্টা বাজানোর পরিকল্পনা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই কঠিন সময়ে সিপিআই(এম)’র উদ্যোগে ভারত থেকে জাহাজ ভরতি খাদ্যশস্য ও অন্যান্য সামগ্রী যায় কিউবায়। ফিদেল কাস্ত্রো নিজে উপস্থিত হয়ে আন্তর্জাতিক মৈত্রীর স্মারক হিসেবে সেই সমস্ত সামগ্রী গ্রহণ করেন।
এখনো প্রতিনিয়ত আক্রমণের মুখে কিউবা। করোনা অতিমারীর সময়েও আমেরিকায় বাইডেন প্রশাসন বিগত রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতোই কিউবার প্রতি অমানবিক অবরোধ বজায় রেখেছে। কিউবার অভ্যন্তরে অশান্তি সৃষ্টি করতে মদত দিয়েছে আমেরিকা। এই সমস্ত প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে নিজেদের দেশে কোভিডের দুটি কার্যকরী ভ্যাকসিন বানিয়েছে কিউবা। দেশের জনগণকে সুরক্ষিত রেখেছে। এই ব্যতিক্রমী ভূমিকার সুবাদেই গোটা লাতিন আমেরিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে কিউবা। এ দেশের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রভাবে লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে ক্রমাগত নির্বাচনী সাফল্য পাচ্ছে বামপন্থীরা। ওয়াশিংটনের প্রভাব খর্ব হওয়ায় আতঙ্কিত মার্কিন প্রশাসন পেরু, ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা সহ বিভিন্ন দেশের দক্ষিণপন্থী শক্তিকে নানাভাবে মদত দিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি ব্রাজিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী লুলার বিজয়ের পর অতি দক্ষিণপন্থী বলসোনারোর সমর্থকরা গায়ের জোরে সংসদ দখল করার যে অপচেষ্টা করেছে তা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কীভাবে গণতন্ত্রের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে গোটা মহাদেশকে করপোরেটের মুক্তাঞ্চলে পরিণত করতে চায়।
এই সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অনুপ্রেরণা কিউবা - যা শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যহীন এক পৃথিবী গড়ে তুলতে সাহস জোগায়, ভরসা দেয়।
চে-র মৃত্যুর চল্লিশ বর্ষ পূর্তির বছরে কিউবার ডাক্তাররা তাদের আন্তর্জাতিক মিশনের অঙ্গ হিসেবে যখন বলিভিয়ার বিভিন্ন জায়গায় রোগীদের চোখে অস্ত্রোপচার করছিলেন তখন তাঁরা বলিভিয়ার প্রাক্তন সৈনিক মারিও টেরানের চোখের দৃষ্টিও ফিরিয়ে দেন, যিনি চে-কে গুলি করে হত্যা করেন। কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘গ্রানমা’ ঘোষণা করেঃ ‘মারিও টেরান একটি স্বপ্ন, একটি ধারণা ধ্বংসের চেষ্টা করার চার দশক পরে, চে আরও একটি যুদ্ধ জয়ের জন্য ফিরে এসেছেন।’ চে-র আদর্শ অম্লান। অ্যালেইদা, এস্তেফানিয়া সেই আদর্শকেই চির জাগ্রত করে রাখার কথা বলতে এসেছেন।
[অর্ণব ভট্টাচার্য]