৬০ বর্ষ ২৩ সংখ্যা / ২০ জানুয়ারি, ২০২৩ / ৫ মাঘ, ১৪২৯
কমরেড প্রদীপ মুখার্জির জীবনাবসান
‘দেশহিতৈষী’ পত্রিকার কর্মাধ্যক্ষ কমরেড প্রদীপ মুখার্জির জীবনাবসান হয়েছে। ১৪ জানুয়ারি শনিবার সকাল ছ’টায় বেলঘড়িয়া নিমতা কলাবাগানের বাড়িতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। তাঁর প্রয়াণে গভীর শোকপ্রকাশ করে পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। শোক জানিয়েছেন ‘দেশহিতৈষী’ পত্রিকার সম্পাদক পলাশ দাশ, পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদকদ্বয় প্রণব চট্টোপাধ্যায়, অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় সহ পত্রিকার সহকর্মীরা। প্রয়াত কমরেডের স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, নাতনি, ভাই সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা বর্তমান।
জীবনাবসানের সংবাদ পেয়ে এদিন সকালে প্রয়াত কমরেডের বাসভবনে গিয়ে পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান পত্রিকার সহকর্মীরা। পত্রিকা সম্পাদকের পক্ষে এখানে মরদেহে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এম) নিমতা দক্ষিণ এরিয়া কমিটির সম্পাদক শিবশঙ্কর ঘোষ, পার্টি নেতা তারক কুণ্ডু সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
এদিন বরানগর রতনবাবুরঘাট শ্মশানে কমরেড প্রদীপ মুখার্জির শেষকৃত্য-র অব্যবহিত আগে মরদেহ রক্তপতাকায় আচ্ছাদিত করে ও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান পত্রিকা সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ঈশিতা মুখার্জি সহ সহকর্মীরা।
কমরেড প্রদীপ মুখার্জি ১৯৫৩ সালের ২৫ জুলাই বেলঘড়িয়া পঞ্চাননতলায় জন্মগ্রহণ করেন। যুব আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তিনি সিপিআই(এম)’র সংস্পর্শে আসেন। ১৯৭৭ সালে তিনি পার্টি সদস্যপদ অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে ‘দেশহিতৈষী’র কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি আমৃত্যু পার্টি সদস্য ছিলেন। তাঁর জীবনাবসানে দেশহিতৈষী’র সাথিরা একজন আদর্শনিষ্ঠ ও নিষ্ঠাবান সহযোদ্ধাকে হারালো।
প্রয়াত কমরেড প্রদীপ মুখার্জিকে মনে রেখে
সংযোজনঃ মাধব ভট্টাচার্য‘প্রদীপ’ নিভে গেছে। কমরেড প্রদীপ মুখার্জি আর নেই। এটা অমোঘ এবং কঠিন বাস্তব। পার্টিজীবনে একসাথে পথ চলার একটা স্মৃতিমেদুর অতীত উদ্ভাসিত হচ্ছে। শুরু থেকে শেষ দীর্ঘ চল্লিশ বছরের বিরামহীন বন্ধনের ছন্দপতনে অনাবিল আবেগে অনুরণিত হচ্ছি। স্মৃতিগুলো কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। ১৪ জানুয়ারি শনিবার সকালে অব্যক্ত বেদনায় দূরভাষে শুনতে হয়েছে একটি আকস্মিক দুঃসংবাদ। শব্দবন্ধ ‘‘বাবা আর নেই’’। সদ্য পিতৃহারা পুত্রের মর্মস্পর্শী কণ্ঠস্বর! কমরেড প্রদীপ মুখার্জির প্রয়াণ সংবাদ! আমরা হতবাক! মনে হয়েছে ‘‘এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার’’। সংশ্লিষ্ট সকলেই শোকস্তব্ধ, গভীর মর্মাহত। নীরব অনুভূতি নিয়ে সেই বিষণ্ণ সকালে সহকর্মীরা পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। সমবেদনা জানাবার ভাষা খুঁজে পাইনি। পরক্ষণে মনে হয়েছে কমরেড প্রদীপ আমৃত্যু যে মতাদর্শে লালিত হয়েছে তার অনির্বাণ আলো তো শোককে সংহত করে শপথে প্রদীপ্ত করে। উচ্চারণ করতে পারি - ‘‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে, তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।’’ আমাদের অনন্ত তো অসীমের সন্ধান। পার্টি জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য পূরণ। সমাজ বদলের লাগাতার লড়াই। প্রয়াত সাথির ভাবনাকে প্রসারিত করা। তাঁর অসম্পূর্ণ কাজকে বিকশিত করা।
কমরেড প্রদীপ মুখার্জি যুব আন্দোলনের মধ্য দিয়েই পার্টির সংস্পর্শে আসেন। দীর্ঘ পরিচিতির সুবাদে জেনেছি সাতের দশকের রাজনৈতিক উত্তাল আবহে তাঁকে বেশ কিছুদিন এলাকা ছাড়া থাকতে হয়। পার্টির রাজ্য দপ্তরের অদূরেই তখন অবস্থান করতেন। পরবর্তীতে পুনরায় এলাকার রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মসূচিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮২ সালে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে ‘দেশহিতৈষী’ পত্রিকার সাথে যুক্ত হন। কর্মাধ্যক্ষ হিসাবে পরবর্তী সময়ে তিনি দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তাঁর তাৎক্ষণিক তৎপরতা এবং প্রশ্নাতীত দায়বদ্ধতা প্রশংসার দাবি রাখে। বিভিন্ন জেলার সাথে পত্রিকা সম্পর্কিত কথোপকথন, পত্রিকা প্রকাশ এবং সরবরাহের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং রূপায়ণে তাঁর মুখ্য ভূমিকা থাকতো। ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করার পরও সহকর্মীদের কাজে নিরলসভাবে সহযোগিতা করতেন। শারীরিক অসুস্থতা উপেক্ষা করে নিয়মিত দপ্তরে যাতায়াত করতেন এবং অন্যান্যদের উৎসাহিত করতেন, কর্মবিমুখতার বিপরীত মেরুতে অবস্থান করতেন। কমরেড প্রদীপ দায়বদ্ধতার অনন্য নজির রেখে গেছেন। একটি জেলার শারদসংখ্যা সরবরাহের জন্য ‘দেশহিতৈষী’র দপ্তর সারা রাত খোলা রাখতে হয়েছিল। কমরেড প্রদীপের উদ্যোগেই ব্যবস্থাপনা বিভাগের সবাই সেদিন বিনিদ্র রাত্রি যাপন করেছিলাম।
আক্ষরিক অর্থেই কমরেড প্রদীপ মুখার্জি একজন প্রাণচঞ্চল মানুষ ছিলেন। আচরণে অমায়িক, বন্ধুবৎসল, নিরহংকার এবং সংবেদনশীল ছিলেন। অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত থেকে নিতান্তই প্রচার বিমুখ ছিলেন। আরোপিত গাম্ভীর্যে বিশ্বাস করতেন না। ভুল করলে শিশুসুলভ সরলতায় অকপটে স্বীকার করতেন। কমরেড প্রদীপ মুখার্জির মৃত্যু দেশহিতৈষী এবং সমগ্র পার্টির পক্ষে বিরাট ক্ষতি।