E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২৩ সংখ্যা / ২০ জানুয়ারি, ২০২৩ / ৫ মাঘ, ১৪২৯

শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করো লড়াই করো জনমুখী নীতির জন্য

এই আহ্বান জানিয়ে শুরু সিআইটিইউ’র সপ্তদশ সর্বভারতীয় সম্মেলন

শংকর মুখার্জি ● বেঙ্গালুরু


‘ঐক্যবদ্ধ হও এবং জনমুখী নীতির জন্য লড়াই করো, শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করো, তীব্র করো সংগ্রাম। সাম্প্রদায়িক শক্তি, নয়া-উদারনীতিকে পরাস্ত করো’ - এই আহ্বান জানিয়ে শুরু হলো সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় সপ্তদশ সম্মেলন। ১৮ জানুয়ারি বেঙ্গালুরুর প্যালেস গ্রাউন্ডে শুরু হয়েছে এই সম্মেলন। চলবে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত। ওই দিন হবে প্রকাশ্য সমাবেশ।

সমাবেশকে সামনে রেখে সমগ্র শহরের নামকরণ করা হয়েছে কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী নগর। প্রতিনিধি অধিবেশন হচ্ছে কমরেড রঞ্জনা নিরুলা এবং কমরেড রঘুনাথ সিং মঞ্চে। কমরেড নিরুলা ছিলেন দেশের শ্রমজীবী মহিলা আন্দোলনের একজন সামনের সারির নেত্রী। শ্রমজীবী মহিলাদের সিআইটিইউ মুখপত্র ‘ভয়েস অব ওয়ার্কিং ওমেন’র প্রাক্তন সম্পাদিকা। কমরেড রঘুনাথ সিং ছিলেন সিআইটিইউ পাঞ্জাব রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক। এই তিন নেতৃত্বই কোভিডে মারা গেছেন।

বাগিচার শহর বলে খ্যাত বেঙ্গালুরুতে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় সম্মেলনের আসর বসল। ঠিক পনেরো বছর আগে ২০০৭ সালের ১৭-২১ জানুয়ারি সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় দ্বাদশ সম্মেলন হয়েছিল এই শহরে।

সম্মেলনে ২৫টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে প্রায় ১৫০০ প্রতিনিধি উপস্থিত আছেন। এঁরা সিআইটিইউ’র প্রায় ৬২ লক্ষ সদস্যের প্রতিনিধিত্ব করছেন।

প্রসঙ্গত, সিআইটিইউ’র বিগত সম্মেলন হয় ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে, দেশে কোভিড মহামারী শুরু হওয়ার ঠিক আগে।

সম্মেলনে রক্তপতাকা উত্তোলন করছেন সর্বভারতীয় সভাপতি কে হেমলতা।

বর্ণাঢ্য উদ্বোধন

সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় সম্মেলনে শ্রমিকশ্রেণির কাস্তে হাতুড়ি খচিত রক্তপতাকা উত্তোলন করেন সর্বভারতীয় সভাপতি কে হেমলতা। হেমলতা, সাধারণ সম্পাদক তপন সেন সহ নেতৃবৃন্দ শহিদ স্তম্ভে শ্রদ্ধা জানান। এর আগে সংক্ষিপ্ত অথচ এক নজরকাড়া আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান হয়। কর্ণাটকের অঙ্গনওয়াড়ি শ্রমিকদের ড্রাম বাজিয়ে নৃত্য এবং কোরাস সঙ্গীতের মধ্যদিয়ে এর সূচনা হয়। শহিদভূমি কোলার স্বর্ণ খনি অঞ্চল থেকে আসা শ্রমিকদের জাঠা ‘কেজিএফ শহিদ মশাল’ বহন করে আনে। সেই মশাল হেমলতার হাতে তুলে দেওয়া হয়। রেড ভলান্টিয়াররা গার্ড অব অর্নার দেন হেমলতাকে। বেঙ্গালুরু শহর সহ আশেপাশের অঞ্চল থেকে কয়েক হাজার শ্রমিক এই স্লোগান মুখরিত বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে যোগ দেন। অন্যদিকে এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ভারতের সিলিকন ভ্যালি এক নতুন রূপে সেজে উঠেছে। সারা শহরকে সম্মেলনের বার্তাবহ দেওয়াল লেখা, পতাকা-চেন ফ্ল্যাগ, পোস্টার-ফেস্টুনে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।

উদ্বোধনী অধিবেশন

উদ্বোধনী অধিবেশনে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্ব উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭০ সালে সিআইটিইউ’র কলকাতায় প্রতিষ্ঠা সম্মলনে স্লোগান ছিল ‘ঐক্য এবং সংগ্রাম’। সেই স্লোগানকে ভিত্তি করেই সিআইটিইউ বাহান্ন বছর ধরে চলছে। দীর্ঘ লড়াই এবং মতাদর্শগত সংগ্রামের মধ্যদিয়ে আজ দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এক মঞ্চে শামিল হয়েছে। কয়েকটি সাধারণ দাবির ভিত্তিতে ২০০৯ সাল থেকে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি দেশজুড়ে প্রচার আন্দোলন এবং একাধিক সফল সর্বভারতীয় ধর্মঘট সংগঠিত করেছে। যদিও এই মঞ্চে আরএসএস’র শ্রমিক শাখা ভারতীয় মজদুর সংঘ নেই। তারা এই মঞ্চের ডাকা ধর্মঘটের বিরোধিতাই করে। শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে এই ঐক্য শিল্পভিত্তিক আন্দোলনেও প্রসারিত হয়েছে।কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সেই যৌথ আন্দোলনকে আরও জোরদার করারই ডাক দিয়েছেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।

এই অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন, আইএনটিইউসি’র আর চন্দ্রশেখরন, এআইটিইউসি’র অমরজিত কাউর, এইচএমএস’র নাগানাথ, এআইইউটিইউসি’র কে সোমা শেখর, টিইউসিসি’র রাজেন্দ্রন নায়ার, ইউটিইউসি’র অশোক ঘোষ, এসইডব্লিউএ’র সোনিয়া জর্জ, এআইসিসিটিইউ’র ক্লিফটন এবং এলপিএফ’র ভি ভেলুস্বামী। এই অধিবেশন পরিচালনা করেন হেমলতা। তপন সেনও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন এই অধিবেশনে। সম্মেলনে স্বাগত ভাষণ দেন অভ্যর্থনা কমিটির সম্মানীয় সভাপতি নবতিপর কে সুব্বা রাও। তিনি বেঙ্গালুরুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের এক প্রসিদ্ধ ব্যক্তি।

খসড়া প্রতিবেদন পেশ করছেন তপন সেন।

সভাপতির অভিভাষণ

নয়া-উদারনীতির প্রয়োগ ক্রমশ আগ্রাসী হচ্ছে। একইসাথে গত কয়েক বছরে দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রভাব বেড়েছে। এখন জরুরি হলো, নয়া-উদারবাদী নীতির সাথেই সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের সর্বক্ষেত্রে লড়াই চালানো। কেন না নয়া-উদারনীতির আগ্রাসী প্রয়োগে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভের জন্ম দেয়, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তাকে অন্যদিকে চালনা করে। - সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় ১৭তম সম্মেলনের সূচনাপর্বে সভাপতির অভিভাষণে এ কথাগুলি বলেন কে হেমলতা। তিনি এই সূত্রেই বলেন, আর এ লড়াইতে সফল হতে গেলে শুধু শ্রমিকশ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করলেই হবে না, কৃষকদের সাথে যৌথ সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। এই যৌথ সংগ্রামের লক্ষ্যই হবে, বিকল্প জনমুখী নীতিসমূহের রূপায়ণ। প্রসঙ্গত, সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় সম্মেলনের প্রতিনিধি অধিবেশন সভাপতির অভিভাষণ দিয়ে শুরু হয়।

শ্রমিকশ্রণিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা শুধু কর্মস্থলেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। হেমলতা বলেন, বসতি এলাকায়ও, যেখানে শ্রমিক থাকবে সেখানেই একাজ চালাতে হবে। আসলে নয়া-উদারবাদের আক্রমণ কর্মস্থলেই শেষ হয়ে যায় না। শ্রমিক ও তাঁর পরিবারের বাসস্থান বিশুদ্ধ পানীয় জল, শৌচালয়, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক পরিষেবাগুলি পাওয়ার অধিকারের ওপরও আঘাত নামিয়ে আনে। তাদের জীবনমানের ধারাবাহিক অবনমন ঘটায়। স্থানীয়ভিত্তিতে অন্যান্য গণসংগঠনের সাথে যৌথভাবে এই ইস্যুগুলিকে তুলে ধরতে হবে। একাজ যদি আমরা করতে পারি, তাহলেই শ্রমিকদের মধ্যে এই আস্থা গড়ে উঠবে যে, তাঁরা যে সমস্যায় পড়ুক না কেন, ইউনিয়ন তাঁদের পাশে সবসময় আছে। অসংগঠিত শ্রমিক, গৃহভিত্তিক শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে আনতে এবং তাঁদের ইস্যুগুলিকে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে এটা সাহায্য করবে।

এ প্রসঙ্গেই হেমলতা বলেন, সাম্প্রদায়িক প্রচারকে তীব্র করতে এই বসতি এলাকাগুলিকেই পাখির চোখ করেছে আরএসএস। তারা স্থানীয়ভাবে হওয়া ঘরোয়া অনুষ্ঠানগুলিকে পরিকল্পনা নিয়ে প্রবেশ করে, মানুষকে সমবেত করতে এগুলিকে ব্যবহার করে। বসতি এলাকায় আমাদের সক্রিয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মধ্যদিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির এই কৌশলকে পরাস্ত করতে পারব। জনগণের মধ্যে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচারও সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে মোকাবিলায় হাতিয়ার হতে পারে।

প্রতিনিধি অধিবেশনে সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পামবিশ কিরিটসিস।

সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন

সম্মেলনের প্রথমদিনে সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন পেশ করেন তপন সেন। দুইভাগে সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন পেশ করা হবে। এটি ছিল প্রথম ভাগ। সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: যে পরিস্থিতির আমরা মুখোমুখি তা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু অলঙ্ঘ্যনীয় নয়। অর্থনীতি, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং সমাজে এক আগ্রাসী বিনির্মাণের সাক্ষী এই সময়। আরও বেপরোয়া দক্ষিণপন্থী স্বৈরতান্ত্রিকতার অভিমুখেই এই বিনির্মাণ। এ শুধু আমাদের দেশের বৈশিষ্ট্য নয়, সারা বিশ্বেই এই প্রবণতা চলছে। এটা নয়া-উদারনীতির শক্তির পরিচায়ক নয়, এই ব্যবস্থার সংকট ও দুর্বলতারই প্রকাশ। তাই নয়া-উদারবাদের অ্যাজেন্ডার বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধেরও সাক্ষী এই সময়। প্রশাসন ও সমাজেও তার প্রতিফলন পড়েছে। এই প্রতিরোধ-আন্দোলনের ফলেই কৃষি ক্ষেত্রে দানবীয় আইন প্রত্যাহার করতে সরকার বাধ্য হয়েছে। জাতীয় স্তরে চার শ্রম কোডকে গত তিন বছর ধরে কেন্দ্রীয় সরকার রূপায়ণ করতে পারেনি। দেশে নয়া-উদারবাদ প্রয়োগের তিন দশক হয়ে যাওয়ার পরও এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।

অন্যদিকে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতেও শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহের খরচ বেড়েছে। এর বিরুদ্ধেও বিরাট বিরাট আন্দোলন হচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের সমাবেশ ঘটছে। দেশ-বিদেশের এইসব ঘটনাপ্রবাহ আমাদের উৎসাহিত করছে, আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে।

আন্দোলন-সংগ্রামের এই প্রবাহকে আরও গতি প্রদান করতে গেলে কী করতে হবে সে ব্যপারেও আলোচনা করা হয়েছে সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে। বলা হয়েছে, কাজের ধারাকে পুনর্গঠিত করতে হবে। উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে সংগ্রামকে। তখনই যৌথ লড়াই কার্যকরী হবে, শাসকশ্রেণি পিছোতে বাধ্য হবে। এই সময় সেই সম্ভাবনার কথাই বলছে। সংগ্রামকে উচ্চস্তরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ীগত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আমরা শোষিত অংশের মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারলে তাঁরা যে আন্দোলন-সংগ্রামের আহ্বানে বিরাটভাবে সাড়া দিচ্ছে, তা দেখা যাচ্ছে। তাই এটা একেবারেই অসম্ভব কাজ নয়। যদি রাজনৈতিক-মতাদর্শগত-সাংগঠনিকভাবে পুনর্গঠিত করার আহ্বানে সঠিকভাবে সংগঠনের সর্বস্তরে যোগদান করাতে পারি, তাহলেই আমরা কাজের ধারাতেও পরিবর্তন আনতে পারব।

সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদনে আটদফা আন্দোলনগত, চোদ্দ দফা সাংগঠনিক এবং দশ দফা আশু কর্মসূচির প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এই সমস্ত বিষয় নিয়ে আগামী কয়েকদিন বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিরা এবং সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শিল্পভিত্তিক প্রতিনিধিরা আলোচনা করবেন। সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদনের দ্বিতীয় অংশটি পেশ করা হবে ১৯ জানুয়ারি।

সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের একাংশ।

শহিদ কমরেড মনীশ শুল্কা

সম্মেলন হলের প্রবেশদ্বারের নামকরণ করা হয়েছে শহিদ কমরেড মনীশ শুল্কার নামে। কমরেড মনীশ শুল্কা ছিলেন মধ্যপ্রদেশে সিআইটিইউ অনুমোদিত সিমেন্ট মজদুর একতা ইউনিয়নের সভাপতি। এই ইউনিয়ন ছিল ওই রাজ্যের সাতনা জেলার কেজেএস সিমেন্টসের মইহার কারখানায়। কোম্পানি ম্যানেজমেন্ট কমরেড মনীশকে খুন করতে ‘সুপারি কিলার’ নিয়োগ কর। তাদের হাতেই ২০২২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি খুন হন।

প্রথমদিনেই সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন, ব্যাঙ্ক, বিমা, প্রতিরক্ষা, রেল, বিএসএনএল, পোস্টাল, কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী ও রাজ্য সরকারি কর্মচারী সংগঠনের নেতৃত্ব। দ্বিতীয় দিনে বক্তব্য রাখেন সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির নেতৃত্ব।

কে হেমলতা, এ কে পদ্মনাভন, ডঃ কারাড, কে কে দিবাকরণ, জে এম এস কুট্টি আম্মা-কে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী সম্মেলন পরিচালনা করছেন।