৬০ বর্ষ ২৩ সংখ্যা / ২০ জানুয়ারি, ২০২৩ / ৫ মাঘ, ১৪২৯
রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা শিল্পের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে লড়াইকে আরও জোরদার করতে প্রস্তুত এআইআইইএ
শংকর মুখার্জি
রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা শিল্পের কর্মচারীদের সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে পুরনো ট্রেড ইউনিয়ন অল ইন্ডিয়া ইনস্যুরেন্স এমপ্লয়িজস অ্যাসোসিয়েশন (এআইআইইএ)। রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বিমা করপোরেশন (এলআইসি) এবং সাধারণ বিমা কোম্পানিসমূহের সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মচারী রয়েছেন এই বামপন্থী সংগঠনের সাথে। রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা শিল্পের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে যে মহাকাব্যিক লড়াই গত প্রায় তিন দশক ধরে পরিচালিত হচ্ছে তার পুরোভাগে রয়েছে এই সংগঠন। দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের এইরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের সর্বভারতীয় ২৬ তম সাধারণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো পশ্চিমবঙ্গের রাজারহাট নিউটাউনে। ৮-১১ জানুয়ারি এই সম্মেলন হয়েছে নিউটাউনে প্রস্তাবিত জ্যোতি বসু সেন্টার ফর সোশ্যাল স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চের প্রাঙ্গণে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ শুধু শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্মচ্যুতিই ঘটায় না, দেশের স্বনির্ভর অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুতরভাবে দুর্বল করে। সংগঠনের অতীত ঐতিহ্যকে বজায় রেখেই সম্মেলন ঘোষণা করেছেঃ বিমা কর্মচারীরা এআইআইইএ’র নেতৃত্বে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে চলমান লড়াইতে অবশ্যই আরও জোরদারভাবে যুক্ত থাকবে এবং জনগণের বিস্তৃত অংশকে এই লড়াইতে শামিল করবে। শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে আগামীদিনের এই লড়াই খুবই কঠিন। তার জন্য সংগঠনকেও উপযুক্তভাবে তৈরি করতে হবে।
পি ভি নরসিমা রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় গঠিত হয় মালহোত্রা কমিটি। লক্ষ্য ছিল আর্থিক ক্ষেত্রের সংস্কারের রূপরেখা নির্ণয়ের। কমিটির সুপারিশ ছিল, এলআইসি'র মূলধন বাড়িয়ে ১০০ কোটি টাকা করা এবং ৫০ শতাংশ শেয়ারের বিলগ্নিকরণ। পরবর্তী সময়ে কমিটির সুপারিশ মেনে এলআইসি'র মূলধন বৃদ্ধি করা হয়। কর্মচারীদের আন্দোলনের চাপে কোনো কেন্দ্রীয় সরকারই বিমা শিল্পের বিলগ্নিকরণে সফল হয় নি। বিমা কর্মচারী আন্দোলন সহ দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও মোদি সরকার সেই কাজই করল ২০২২ সালের মে মাসে। ইনিশিয়াল পাবলিক অফার (আইপিও)’র মাধ্যমে এলআইসি'র ৩.৫ শতাংশ শেয়ারের বিলগ্নিকরণ হলো। এতেও বিরাট অর্থের দুর্নীতি হয়েছে।
২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের হিসাব অনুযায়ী এলআইসি’র এমবেডেড ভ্যালু হয়েছিল প্রায় ৫ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এমবেডেড ভ্যালু হলো, জীবন বিমা কোপানির করপোরেট ভ্যালু নির্ণয়ের একটা পদ্ধতি। এলআইসি’র মোট শেয়ার সংখ্যা ৬৩২ কোটি ৫০ লক্ষ। এই মূল্যমানে এলআইসি’র প্রতি শেয়ারের বেস ভ্যালু হয় ৮৫৩ টাকা। এলআইসি’র থেকে অনেক অনেক ছোটো বিমা কোম্পানি বেস ভ্যালুর আড়াই থেকে তিনগুণ হারে শেয়ারের দাম নির্ধারণ করে। সেই হিসেবে এলআইসি’র প্রতি শেয়ারের মূল্য হওয়া উচিত ছিল ২১৩৩ টাকা থেকে ২৫৫৯ টাকার মধ্যে। কিন্তু করপোরেট পুঁজির স্বার্থে এলআইসি’র ক্ষেত্রে শেয়ারের দাম বেস ভ্যালুর মাত্র ১.১ গুণ বৃদ্ধি করা হয়। ফলে প্রতি শেয়ারের দাম হয় মাত্র ৯০২ টাকা থেকে ৯৪৯ টাকার মধ্যে। এইভাবে কমদামে শেয়ার বিক্রি করার মধ্য দিয়ে বিশাল টাকার দুর্নীতি হয়। এই বিশাল দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশ্যে আনে এআইআইইএ।
কেন্দ্রীয় সরকার ২০২১-২২ সালের বাজেটে বিমা ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বৃদ্ধির ইচ্ছাপ্রকাশ করে। সরকার বলে, ইনস্যুরেন্স অ্যাক্ট ১৯৩৮-কে সংশোধিত করে এফডিআই'র ঊর্ধ্বসীমা ৪৯ শতাংশ থেকে ৭৪ শতাংশ করা হবে। এর ফলে বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলির পরিচালনভার সম্পূর্ণ বিদেশি পুঁজির হাতে চলে যাবে। বর্তমানে দেশে ২৩টি বেসরকারি বিমা কোম্পানি কাজ করছে। ইনস্যুরেন্স রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (আইআরডিএ)’র ২০২০-২১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ২৩টি বেসরকারি জীবন বিমা কোম্পানিতে এফডিআই'র গড় পরিমাণ ৩৫.৫৬ শতাংশ। এবং বেসরকারি অ-জীবন বিমা কোম্পানিতে এর গড় পরিমাণ আরও কম, মাত্র ২৭.৬৮ শতাংশ।
দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে চারটি সাধারণ বিমা কোম্পানি আছে। এই কোম্পানিগুলি হলো - নিউ ইন্ডিয়া অ্যাসুরেন্স, ন্যশনাল ইনস্যুরেন্স, ওরিয়েন্টাল ইনস্যুরেন্স এবং ইউনাইটেড ইন্ডিয়া ইনস্যুরেন্স। এই চার কোম্পানি সম্মিলিতভাবে ২০২০-২১ আর্থিক বছরের তুলনায় ২০২১-২২ আর্থিক বছরে এবং ২০২২ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ব্যবসা বৃদ্ধি করেছে। দেশে মোট অ-জীবনবিমা ব্যবসায় তাদের অংশ এই সময়কালে সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বাস্তবে এই চারটি কোম্পানি নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার দরুন বাজার হারাচ্ছে। ২০১৯ সালে দেশে মোট সাধারণ বিমা ব্যবসার ৪২.৫ শতাংশ ছিল এই চার কোম্পানির দখলে। কিন্তু সেটাই ২০২২ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬.৮২ শতাংশ। ২০১৮ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ঘোষণা করেছিলেন, নিউ ইন্ডিয়া অ্যাসুরেন্স বাদে বাকি তিনটি কোম্পানিকে একত্রীকরণ (মার্জার) করা হবে। ২০২০ সালে সরকার এই একত্রীকরণের ভাবনা পরিবর্তন করে। ২০২১ সালের বাজেটে কেন্দ্রীয় সরকার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বিমা কোম্পানিকে বেসরকারিকরণের প্রস্তাব রাখে। সাধারণ বিমা ক্ষেত্রে এই চার রাষ্ট্রয়ত্ত বিমা কোম্পানির ব্যবসা বৃদ্ধি করতে এবং কাজকর্ম উন্নত করতে এই চার কোম্পানির একত্রীকরণের দাবি এআইআইইএ সব সময়ে জানিয়ে এসেছে।
জেনারেল ইনস্যুরেন্স বিজনেস (ন্যাশনালাইজেশন) অ্যাক্ট ১৯৭২ (গিবনা)-র একটা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তা হলো - রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারাণ বিমা কোম্পানিগুলিতে রাষ্ট্রের অংশীদরিত্ব কমপক্ষে ৫১ শতাংশ থাকতে হবে। ২০২১ সালের জুলাই মাসে সরকার জেনারেল ইনস্যুরেন্স বিজনেস (ন্যাশনালাইজেশন) বিল ২০২১ সংসদে পেশ করে। বহু বিরোধী দল আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য জেনারেল ইনস্যুরেন্স বিজনেস (ন্যাশনালাইজেশন) বিল ২০২১-কে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু সরকার সংসদে মার্শাল নামিয়ে বিরোধীদের প্রতিবাদকে স্বৈরতান্ত্রিক পথে দমন করে; এবং বিল পাশ করে। এই নতুন আইনের ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলিতে সরকারের অংশীদারিত্ব আর ৫১ শতাংশ থাকা বাধ্যতামূলক নয়।
বেসরকারি জীবন বিমা কোম্পানিগুলি জাতীয়করণ হয় ১৯৫৬ সালে। সাধারণ বিমা ব্যবসার জাতীয়করণ হয় ১৯৭২ সালে। ১০৭ টি দেশি ও বিদেশি সাধারণ বিমা কোম্পানিকে জাতীয়করণ করা হয়। বিমা ব্যবসার জাতীয়করণের মূল লক্ষ্য ছিল, বেসরকারি কোম্পানিগুলির প্রতারণামূলক কাজকর্ম থেকে জনগণকে রক্ষা করা; এবং সমাজের দুর্বলতর অংশের কাছে বিমা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া। এই লক্ষ্যপূরণে অনেকটাই সফল রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা কোম্পানিগুলি। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলির মূলধনের পরিমাণ প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা। ১ লক্ষ ৭৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিমাণ। প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষা বিমা যোজনা রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলি দ্বারা পরিচালিত হয়। এই প্রকল্পে ১০০ টাকা প্রিমিয়ামে ২৬৫ টাকা দাবিপূরণ হয়। স্বাভাবিকভাবেই এটা একটা অলাভজনক প্রকল্প। কোনো বেসরকারি বিমা কোম্পানি এই প্রকল্পে কাজ করবে না। একইকথা প্রযোজ্য আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্পেও। এটাও পরিচালিত হয় রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলি দ্বারা। এই প্রকল্পও ৯০ শতাংশ অলাভজনক। অন্যদিকে এলআইসি’র বিক্রীত পলিসির গড় প্রিমিয়ামের পরিমাণ ২০২০-২১ সালে ছিল ১৬ হাজার ১৫৬ টাকা। যা বেসরকারি বিমা সংস্থার বিক্রীত পলিসির গড় প্রিমিয়ামের থেকে অনেক কম। বেসরকারি বিমা সংস্থার ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৮৯ হাজার ৪ টাকা। যেটা সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ তা হলো, এলআইসি’র ক্ষেত্রে এই অঙ্ক ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে; বেসরকারি বিমা সংস্থার ক্ষেত্রে যা বেড়েই চলেছে। একইসাথে বিমার দাবি মীমাংসার ক্ষেত্রেও এলআইসি’র ট্রাকরেকর্ড ঈর্ষণীয়। দেশে-বিদেশের জীবন বিমা কোম্পানিগুলি তার ধারেকাছে নেই। তাই এখনো দেশে জীবন বিমা ব্যবসার ৭০ শতাংশের বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত এলআইসি'র দখলে।
বিমা ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণকারী সংস্থা হলো আইআরডিএ। তারাও নানাভাবে এলআইসি-কে দুর্বল করার চেষ্টা করছে। এলআইসি’র মোট ব্যবসার ৯৩.৮৭ শতাংশ হয় ব্যক্তিগত এজেন্টদের মারফত। এলআইসি সহ সাধারণ বিমা সংস্থাগুলিতে এজেন্ট রয়েছে প্রায় ২৪ লক্ষ। শুধু এলআইসি'তেই আছে ১৩ লক্ষের বেশি এজেন্ট। বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলি তাদের ব্যবসার সিংহভাগ করে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির (ব্যাঙ্কঅ্যাসুরেন্স) সাহায্যে। আইআরডিএ সেই ফরমুলা প্রয়োগ করতে চাইছে এলআইসি’র ক্ষেত্রেও। এলআইসি'র এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে যে লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয় তাকে মারাত্মভাবে আঘাত করবে এই পদক্ষেপ।
উদার অর্থনীতির একটা মূল অভিমুখই হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ বেসরকারিকরণ। বিশেষকরে, লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি। আমাদের দেশে গত তিন দশক ধরে সেই অভিমুখেই দেশের অর্থনীতিকে চালনা করছে কেন্দ্রীয় সরকারগুলি। এখন নজর পড়েছে অতি লাভজনক, বিরাট সম্পদের মালিক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ও বিমা শিল্পের ওপর।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা শিল্পের ওপর উদার অর্থনীতির এই আক্রমণের বিভিন্নদিকের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা হয়েছে এআইআইইএ’র সর্বভারতীয় সম্মেলনে। এই আক্রমণের হাত থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা শিল্পকে রক্ষা করতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সুনির্দিষ্ট কর্মসূচিও নির্ধারিত হয়েছে সম্মেলনে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা শিল্পের সুরক্ষা ও এই শিল্পের ওপর সার্বিক আক্রমণকে রুখতে আগামীদিনে লড়াই-আন্দোলনকে আরও তীব্র করার লক্ষ্যে এই সম্মেলন থেকে ১৬৫ জনের ওয়ার্কিং কমিটি এবং ২২ জনের সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয়েছে। ভি রমেশ সভাপতি, শ্রীকান্ত মিশ্র সাধারণ সম্পাদক এবং বিএস রবি কোষাধ্যক্ষ হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন।