৬০ বর্ষ ২৩ সংখ্যা / ২০ জানুয়ারি, ২০২৩ / ৫ মাঘ, ১৪২৯
সুভাষচন্দ্র - সাধারণতন্ত্র ও ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি রক্ষার শপথ
সুস্নাত দাশ
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন নতুন মোড় নিয়েছিল যখন ১৯৩৮-৪০ এই তিন বছর কাল ভারতবর্ষের জাতীয় রাজনীতি বাম-অভিমুখী হয় এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামের শীর্ষে উপনীত হয়েছিল সুভাষচন্দ্র বসুকে কেন্দ্র করে। কার্যত নেহরুর পরিবর্তে সুভাষচন্দ্রই তখন হয়ে উঠেছিলেন ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থার অন্যতম প্রতীক। কমিউনিস্ট পার্টিও এই পর্যায়ে সম্পূর্ণতই সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে ছিল এবং ফরওয়ার্ড ব্লক গঠিত না হওয়া পর্যন্ত তারা সর্বদাই সুভাষচন্দ্রকে সমর্থন জুগিয়েছেন। লেনার্ড গর্ডন তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, পক্ষান্তরে সুভাষচন্দ্রও কমিউনিস্টদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতিতে উদগ্রীব ছিলেন। তবে সুভাষচন্দ্র বসু তাত্ত্বিকভাবে সে অর্থে সোশ্যালিস্ট ছিলেন না। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, এমনকী কিয়দংশে ফ্যাসিবাদের এক অদ্ভূত রাজনৈতিক সংমিশ্রণ সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক চিন্তাধারার ভিত্তি ছিল। তবে তাৎপর্যময় বিষয় হলো ১৯৩৭-৩৯-এর ওই পর্বে সমগ্র দেশের বামপন্থী-সোশ্যালিস্ট, কমিউনিস্ট সকলেরই রাজনৈতিক চেতনার আইকন বা প্রতীক হয়ে ওঠেন সুভাষচন্দ্র বসু।
সুভাষচন্দ্র বসু গুজরাটের হরিপুরায় ১৯৩৮-এর ১৯-২১ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের ৫১তম অধিবেশনে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন তা বস্তুতই ছিল দেশের বামপন্থী শক্তির মনের কথা। সভাপতির ভাষণে সুভাষচন্দ্র স্বাধীনতার দাবিতে সক্রিয় প্রতিরোধের কথা তুললেন, যদিও তা হবে অহিংস। স্বাধীনতার পর দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো কী হবে তারও রূপরেখা দিলেন তিনি। এমনকী ভাবী স্বৈরতন্ত্রের প্রতিষেধক রূপে তিনি বহুদলের কথা বললেন, গণতান্ত্রিক ভিত্তিও মেনে নিলেন; জাতীয় পরিকল্পনার উপর জোর দিলেন এবং দেশের দারিদ্র্য দূর করতে ভূমি ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার, জমিদারি প্রথা বিলোপ, কৃষিঋণ মকুব, গ্রামীণ অর্থনীতি মজবুত করতে সস্তা মূলধনের ব্যবস্থা, সমবায় প্রথার বিস্তার, বৈজ্ঞানিক কৃষি দ্বারা উৎপাদন বৃদ্ধি, শিল্পায়নের ওপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ সহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা স্থান পেয়েছিল।
৪ঠা মে, ১৯৩৯ মহাজাতি সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ।
হরিপুরা কংগ্রেসে প্রদত্ত সুভাষচন্দ্রের সভাপতির ভাষণ থেকে স্পষ্ট হলো যে, প্রত্যক্ষভাবে সাম্যবাদী বা সমাজতন্ত্রী না হয়েও সুভাষ বসু ক্রমশ সেইদিকেই ঘেঁষেছিলেন এবং সোভিয়েত রাশিয়ার সাফল্যে তিনি যথেষ্টই অনুপ্রাণিত। অমলেশ ত্রিপাঠি সঠিকভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন যে, ‘‘ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল-এর অপরিণত চিন্তাভাবনা ইয়োরোপে কয়েক বছর (১৯৩৪-৩৮) কাটাবার ফলে অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। বারবার রাশিয়ার উল্লেখ, এমনকী শেষ উদ্ধৃতিতে সিপিজিবি-র উল্লেখ; ট্রেড ইউনিয়ন, কিষান সভা, সাম্যবাদী দলগুলির কংগ্রেসে সামূহিক যোগদানে সম্মতি, কংগ্রেস-সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন, সকল বামপন্থী শক্তিকে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে তাকে আরও গণতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী করার আহ্বান - সবই যেন একই রাগিনীর বিচিত্র বিস্তার।’’ বস্তুত জওহরলাল নেহরুর লক্ষ্মৌ কংগ্রেসে সভাপতির ভাষণের সঙ্গে (১৯৩৬) তুলনা করলে সুভাষের ভাষণকেই বেশি স্পষ্টভাবে বামপন্থী বলতে হবে - ‘‘দেশের বামপন্থী শক্তির কাছে আমার আবেদন যে, তাঁরা যেন কংগ্রেসের গণতন্ত্রীকরণ এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ব্যাপক মঞ্চে তাদের টেনে আনার জন্য সর্বশক্তি ও সামর্থ্য নিয়োগ করেন। ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির কার্যাবলিতে আমি সত্যিই দারুণভাবে উৎসাহিত...’’।
হরিপুরায় কংগ্রেস অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসু সভাপতিরূপে যে ভাষণ দেন তার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য ছিলঃ ১) সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গঠনমূলক কাজের অগ্রগতির প্রভাবে ভারতেও কংগ্রেসের পক্ষ থেকে পরিকল্পনা কমিশন গঠনের প্রস্তাব। হরিপুরা কংগ্রেসকে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী প্রভাব প্রতিষ্ঠা করার প্রধান ক্ষেত্ররূপে দেখে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন। বাংলা থেকে এআইসিসি-তে মুজফ্ফর আহ্মদ ছাড়াও বঙ্কিম মুখার্জি এবং সহ-সম্পাদকদের মধ্যে পাঁচুগোপাল ভাদুড়ি এবং কমল সরকারও মনোনীত হন।
সুভাষচন্দ্রের জীবন যে পথে অগ্রসর হয়েছিল তাতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস তাঁকে নেতাজি রূপে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। তিনি নিছক বাঙালি নেতা মাত্র ছিলেন না - কালক্রমে হয়ে উঠেছিলেন ‘দেশনায়ক’, জাতীয় নেতা। এক মহাজাতি গঠনের প্রয়াস তাঁকে স্বতন্ত্রতা দিয়েছিল। তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আজাদ হিন্দ সরকার ও বাহিনীর মধ্যে ভাষা-ধর্ম-বর্ণ-প্রদেশ নির্বিশেষে ভারতীয়দের যে মহান ঐক্য আত্মপ্রকাশ করেছিল তা এককথায় অতুলনীয়। কলকাতায় ‘মহাজাতি সদন’ প্রতিষ্ঠা এরই সূচনা।
মহাজাতি সদন প্রতিষ্ঠা ছিল সুভাষচন্দ্রের বহুদিনকার এক স্বপ্ন। সুভাষচন্দ্রের পদত্যাগের পর কংগ্রেসের বামপন্থী অনুগামীরা ৪ঠা মে (১৯৩৯) কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে এক জনসভায় সুভাষচন্দ্রের হাতে আন্দোলন পরিচালনার জন্য এক লক্ষ টাকা তুলে দেন। এই অর্থ দিয়ে সুভাষচন্দ্র মধ্যকলকাতায় একটি ‘কংগ্রেস ভবন’ গঠনের প্রস্তাব দেন। কলকাতা পৌরসভা থেকে জমি সংগ্রহ করা হয়। রবীন্দ্রনাথকেও সুভাষচন্দ্র তাঁর পরিকল্পনার কথা জানান। কবি শুধু এতে প্রবল আগ্রহই দেখাননি, জাতীয়স্মারক রূপে এই ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে সুভাষচন্দ্রের আহ্বানে সানন্দ সম্মতিই দেন। ফলে ‘মহাজাতি সদন’ বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের অফিস না হয়ে চিহ্নিত হয়ে ওঠে বাঙলার জাতীয় জাগরণের ও ভারতব্যাপী সুভাষচন্দ্র বসুর এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের ভারত-তীর্থে। এই সদন তাই কোনো মামুলি গৃহ মাত্র নয়; এই ভবনের তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতা ঐতিহাসিক। মহাজাতি সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সেই অনুষ্ঠানে সুভাষচন্দ্রও এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘আজ ভারতের রাষ্ট্রীয় গগন মেঘাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। আমরাও ইতিহাসের এমন এক চৌমাথায় গিয়ে পড়েছি যেখান থেকে বিভিন্ন দিকে পথ বেরিয়ে গেছে। এখন আমাদের সম্মুখে সমস্যা এই যে, নিয়মতান্ত্রিকতার পথ আমরা ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বর্জন করেছিলাম, পুনরায় কি সেই পথে ফিরে যাব? অথবা আমরা কি গণ-আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়ে গণ-সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হব? আমি শুধু এই কথা বলতে চাই যে, নবজাগ্রত ভারতীয় মহাজাতি স্বাবলম্বন, গণ-আন্দোলন এবং গণ-সংগ্রামের পন্থা কিছুতেই পরিত্যাগ করবে না।’’
দেশের শৃঙ্খলমোচনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পরবর্তীকালের (১৯৪০-৪৫) কঠোর সাধনা তাঁর বাণীর সত্যতা প্রমাণ করেছিল। যেদিন কলকাতায় সাম্রাজ্যবাদের স্মারক হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলন শুরুর ডাক তিনি দেন, তার আগের দিনে ২রা জুলাই (১৯৪০) মঙ্গলবার, সকাল ১১টার সময় সুভাষচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এটাই তাঁদের মধ্যে শেষ কথোপকথন। এই সাক্ষাৎকারের মাত্র দু-তিন ঘণ্টা পরে, বেলা আড়াইটা নাগাদ গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি কমিশনার এলগিন রোডের বাড়িতে গিয়ে সুভাষচন্দ্র বসুকে ভারতরক্ষা আইনের ১২৯ ধারা মতে গ্রেপ্তার করে প্রেসিডেন্সি জেলে প্রেরণ করে। মর্মাহত চিত্তে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে এই নিন্দনীয় ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রেসবিবৃতি দিয়ে সুভাষচন্দ্রের পক্ষ সমর্থন করেছিলেন। সন্দেহ নেই যে, ভারতে বহুত্ববাদী সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ছিলেন গান্ধীজি ও জওহরলাল নেহরু সহ দেশের কমিউনিস্ট এবং মার্কসবাদীরা। সুভাষচন্দ্র বসুও এই মানবতাবাদী আদর্শের একজন প্রকৃত অনুরাগী ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক পন্থা নিয়ে প্রতর্ক থাকলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে তার একনিষ্ঠ অবস্থান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গৌরবোজ্জ্বল ধারা ছিল।
সুভাষচন্দ্র বসু ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগাল সহ আইএনএ'র অফিসারদের সঙ্গে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুত্ববাদী সংস্কৃতি ও সমাজতন্ত্রের প্রতি সুভাষচন্দ্রের এই নিষ্ঠা প্রতিফলিত হয়েছিল স্বাধীন ভারতের সংবিধান প্রণয়নেও। জাতির জনক গান্ধীজির হত্যাকারীরা দীর্ঘ সময় ধরে বাধা দিয়ে এসেছে যাতে ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের ওই মহৎ সেক্যুলার আদর্শগুলি বাস্তবে রূপায়িত হতে না পারে। সংখ্যালঘু ও দলিত দলনের যে মতাদর্শ ঔপনিবেশিক ভারতের সময় থেকেই সাভারকর, গোলওয়ালকর থেকে মোহন ভাগবত, লালকৃষ্ণ আদবানী হয়ে বর্তমানের মোদি-শাহ পর্যন্ত বলবৎ আরএসএস-এর সেই নির্মম, অমানবিক ও অগণতান্ত্রিক ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার অপপ্রয়াস। বিগত তিন দশক ধরে ধীরে ধীরে পাঁচশো বছরের ঐতিহাসিক সৌধ বাবরি মসজিদ ধ্বংস থেকে সংসদ ভবনের চূড়ায় অশোক স্তম্ভের বিকৃতি সাধন ঘটিয়ে ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির সর্বনাশ ঘটানো হয়েছে।
আজ উগ্র জাতীয়তাবাদী কট্টর ও হিংস্র সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী আরএসএস-বিজেপি দেশের শাসন ক্ষমতা দখল করে সংবিধান প্রদত্ত গণতন্ত্রের তিন স্তম্ভ প্রশাসন, আইনসভা ও বিচারবিভাগ - সব কিছুই কুক্ষিগত করতে উদ্যত হয়েছে। নিজেদের দলীয় আদর্শ ও কপট রাজনীতির স্বার্থে এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে গণতন্ত্র, সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে। নবনির্মীয়মাণ সংসদ ভবনের উপরে স্থাপনের জন্য জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভের চিরায়ত রূপ পরিবর্তন করে যে বিকৃতি ঘটিয়েছে, তার মধ্য দিয়ে ওদের উগ্র সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্তধর্মী হিংস্র মনোভাব আরও একবার প্রকট হয়ে উঠেছে। সরকারের এই সর্বনাশা উদ্যোগ ওদের হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র গঠনের একটি পদক্ষেপ কিনা - তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বলা বাহুল্য, দেশে এত বড়ো একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণের আগে অতীতের মতো সংসদে, সংসদের বাইরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ, ইতিহাসবিদ - কারও সঙ্গেই বিন্দুমাত্র আলোচনার ধার ধারেনি প্রধানমন্ত্রী মোদি ও তাঁর সরকারের প্রতিনিধিরা। উল্লেখ্য, রাজধানীর বুকে প্রাথমিকভাবে নির্দিষ্ট ১৩,৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মীয়মাণ সেন্ট্রাল ভিস্তার মাঝখানে গড়ে উঠতে চলেছে নতুন জাঁকজমকপূর্ণ সংসদ ভবন। এই নতুন সংসদ ভবনের উপরে নরেন্দ্র মোদি সরকার বসাতে চলেছেন ৯৫০০ কিলোগ্রাম ওজন বিশিষ্ট, ৬.৫ মিটার দীর্ঘ ব্রোঞ্জের অশোক স্তম্ভ। এই স্তম্ভ বসানোর আগে প্রধানমন্ত্রীর ধর্মীয় উপাচার ও অশোক স্তম্ভটির কদর্য বিকৃতি নিয়ে তুমুল প্রতিক্রিয়া, প্রতিবাদসহ আইন ও সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে গোটা দেশ আলোড়িত হচ্ছে। সরকারের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যখন দেশের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে - ঠিক তখনই সংসদ প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করা যাবে না বলে ফতোয়া জারি হয়েছে। সরকারের অপদার্থতা, ব্যর্থতা, জনবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে এভাবে অবদমিত করার অপচেষ্টা গণতন্ত্রের ওপর আঘাত বলেই অভিমত প্রকাশ করেছেন বিরোধীরা। একই সঙ্গে সরকারের এই পদক্ষেপ প্রকারান্তরে ফ্যাসিস্টধর্মী মনোভাবেরই প্রকাশ বলেও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ অনেকেরই ধারণা।
নতুন করে জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভ বসানোকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং যে আকৃতিতে স্তম্ভটি তৈরি করা হয়েছে - তা যে সব দিক থেকে ভারতের সংবিধান ও আইনের পরিপন্থী - সে বিষয়ে প্রথমে আলোকপাত করা যেতে পারে। গত ১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে হিন্দু ধর্মের নানা উপাচারে তিলক কেটে, যজ্ঞ করে, মন্ত্র পড়ে রাষ্ট্রের প্রতীককে পুজো করেন। তারপর এটির আবরণ উন্মোচন হয়। অন্যান্য অনুষ্ঠানের মতো এভাবে প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভবনের মাথায় জাতীয় প্রতীক বসাতে পারেন কিনা, সেই সঙ্গে সংবিধানে লিপিবদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্রকে ধর্মীয় আচার থেকে দূরে রাখার যে সাংবিধানিক বিধি রয়েছে, তা লঙ্ঘন করতে পারেন কিনা - সে সব গুরুতর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ভারতের সংবিধানে প্রত্যেক ভারতীয়র নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস পালন ও প্রচারের অধিকার ও সুরক্ষা রয়েছে। এই অধিকার অলঙ্ঘনীয়। একই সঙ্গে সংবিধান স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, রাষ্ট্র কোনো ধর্ম বিশ্বাসের অনুশীলন বা প্রচার করবে না। এই অবস্থায় সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন তুলেছে, শুধু একটি ধর্মের অনুষ্ঠান করা হলো কেন? রাষ্ট্র ও সংসদ কি অন্য ধর্মের মানুষের জন্য নয়? রাষ্ট্রের অনুষ্ঠান থেকে ধর্মকে পৃথক রাখা কঠোরভাবে মান্য করা উচিত। উল্লেখ্য, এর আগেও প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদি প্রকাশ্যে হিন্দু ধর্মীয় আচারের জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শন করেছেন। তাঁর এই কার্যকলাপ দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন দেশের বুকে করোনার ভয়াবহ সংক্রমণকালে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের সূচনায় এবং কাশীতে বিশ্বনাথ করিডোরের উদ্বোধনে। অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করেন মোদির এই সমস্ত উদ্যোগ পরিকল্পিত। ভারতে তাঁর নেতৃত্বে আরএসএস-বিজেপি’র শাসনে হিন্দুত্বের আধিপত্য থাকবে এবং রাষ্ট্র তা প্রকাশ্যে অনুমোদন করবে - এই রাজনৈতিক বার্তাই তাদের মতাদর্শগত অবস্থানের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। কিন্তু দেশের সংবিধানের বিপদ হলো যে, কী রাজ্যে বা কী কেন্দ্রে সর্বত্রই এই জাতীয় গণতন্ত্র বিধ্বংসী ঘটনা সরকার ঘটিয়ে চলেছে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার, কিংবা অধ্যাপক ইরফান হাবিবের মতন পণ্ডিতগণ মোদি-শাহের বর্তমান শিক্ষানীতি ও বেপরোয়া ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। মিথ, পুরাকথা তথা কল্পনাকে ইতিহাস বলে চালানোর আরএসএস - পরিকল্পনা যে দেশের ঐক্য ও সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে তা সম্প্রতি চেন্নাইয়ে অনুষ্ঠিত ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসেও ঘোষিত হয়েছে।