৬০ বর্ষ ২৩ সংখ্যা / ২০ জানুয়ারি, ২০২৩ / ৫ মাঘ, ১৪২৯
ভারতের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সুভাষচন্দ্র বসু
সুপ্রতীপ রায়
প্রতি বছর সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিনে অসংখ্য কর্মসূচি হয়। দেশের মন্ত্রীরা সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে ভালো ভালো কথা বলেন। কিন্তু নেতাজি সম্পর্কে সরকারি স্তরে কি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে গবেষণা কতটুকু? এ প্রশ্ন দেশপ্রেমিক মানুষের।
১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি ওডিশার কটক শহরে সুভাষচন্দ্র বসু জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম জানকীনাথ বসু ও মাতার নাম প্রভাবতী দেবী। তিনি ছিলেন পিতা-মাতার নবম সন্তান। বাবা ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী। ফলে সচ্ছল পরিবারেই সুভাষের জন্ম হয়েছিল। পরিবারে দেশজ সংস্কৃতির চর্চা ছিল অনুপস্থিত। শিশু বয়সে সুভাষকে কটকের প্রোটেস্টান্ট ইয়োরোপীয় বিদ্যালয়ে ভরতি করা হয়। এই বিদ্যালয়টি মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত ছিল। এইরকম একটি পরিবেশ থেকে সুভাষচন্দ্র বসু কীভাবে ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে, জীবনের সুখ আর ভোগ ত্যাগ করে দেশের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করলেন তা নিয়ে আরও চর্চার অবকাশ আছে।
নেতাজি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক কিংবদন্তি নায়ক। সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বে দেশের বাইরে আজাদ হিন্দ সরকার গঠন এবং সেই সরকারের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনা দেশপ্রেমিক ভারতবাসী কোনোদিন ভুলে যাবেন না। কংগ্রেসের প্রচলিত ধারার বাইরে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামকে বেগবতী করেছিল। সুভাষচন্দ্রের নির্ভেজাল দেশপ্রেম, নিপুণ দক্ষতায় সংগঠন পরিচালনা, অসীম সাহসিকতা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা সুভাষচন্দ্র বসুকে দেশনেতাতে পরিণত করেছিল। তিনি অখণ্ড ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চেয়েছিলেন।
সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবনবোধ,দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে যাঁদের প্রভাব ছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বেণীমাধব দাস। ১৯০৯ সালে তিনি ভরতি হন কটকের রেভেনশ কলেজিয়েট বিদ্যালয়ে। এখানেই সুভাষচন্দ্রের মনোজগতে বিরাট পরিবর্তন আসে। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাসের ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ, স্বাদেশিকতা সুভাষচন্দ্রকে আকৃষ্ট করেছিল। বলা বাহুল্য, দেশত্যাগ পর্যন্ত বেণীমাধব দাসের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। বেণীমাধব দাসের কন্যা ছিলেন বিপ্লবী বীণা দাস। বীণা দাস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে ভাষণরত অত্যাচারী গভর্নর স্যার স্টানলি জ্যাকসনকে হত্যা করার জন্য গুলি নিক্ষেপ করেছিলেন। বীণা দাসের সাত বছর জেল হয়েছিল।
নেতাজি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন। আরএসএস’র দর্শনের সঙ্গে নেতাজির দর্শনের বিস্তর ফারাক আছে। নেতাজির অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র ঘৃণা আজকের ভারতের প্রেক্ষাপটে প্রচার হওয়া প্রয়োজন। সুভাষচন্দ্র বসু হিন্দু-মুসলমান-শিখ-ইসাই সবাইকে নিয়েই আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেছিলেন। ১৯২৩-২৪ সালে কলকাতা করপোরেশনে মুসলমান প্রতিনিধিত্ব কম ছিল। এই চিত্র পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে চিত্তরঞ্জন দাস ও সুভাষচন্দ্রের বিশেষ ভূমিকা ছিল। নেতাজির মধ্যে কোনোরকম ধর্মীয় কুসংস্কার ছিল না।
সুভাষ বসু যখন দেশত্যাগ করেন তখন সুভাষকে কারা সহায়তা করেছিলেন? পেশোয়ার থেকে নেতাজি মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে ফ্রন্টিয়ার মেল থেকে যখন নেমেছিলেন তখন তাঁর জন্য অপেক্ষায় ছিলেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের মিঞা আকবর শাহ্। ১৯৪০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন এবং মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশের পোশাক কিনেছিলেন। তিন মাস ডুবো জাহাজে যাত্রা করে সুভাষচন্দ্র যখন ইয়োরোপ থেকে এশিয়াতে আসেন তখন তাঁর একমাত্র ভারতীয় সঙ্গী যিনি ছিলেন তাঁর নাম আবিদ হাসান। আজাদ হিন্দ ফৌজ যখন ইম্ফল-কোহিমাতে যুদ্ধ চালায় তখন প্রথম বিভাগের সেনাপতি ছিলেন মহম্মদ জামান কিয়ানি। মণিপুরের মৈরাঙে ১৯৪৪ সালের এপ্রিলে আজাদ হিন্দ ফৌজের পক্ষে যিনি হিন্দুস্থানের পতাকা তুলেছিলেন তাঁর নাম ছিল সৌকত আলি। ১৯৪৫ সালে নেতাজির শেষ বিমানযাত্রার সঙ্গী ছিলেন হবিবুর রহমান। ১৯৪৫ সালে লাল কেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার শুরুর সময় যে তিনজনকে ব্রিটিশ বেছে নিয়েছিল তাঁরা হলেন - প্রেম কুমার সেহগল, গুরুবক্স সিং খিলান, শাহনওয়াজ খান। গোটা দেশজুড়ে তখন স্লোগান উঠেছিল, ‘লাল কিলে সে আয়ে আওয়াজ, সেহগল-খিলান-শাহনওয়াজ’। সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজের যে স্মৃতিসৌধ গড়ে উঠেছিল, সেখানে লেখা ছিল, ‘এতমাদ-ইত্তেফাক-কুরবানি’। ১৯৪৮ সালের ২৩ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধী নেতাজির জন্মদিনে বলেছিলেন, ‘‘এই মহান দেশপ্রমিকের কথা মনে রেখে আমাদের হৃদয় থেকে সমস্ত সাম্প্রদায়িক বিষ মুছে ফেলতে হবে।’’
সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন চেট্টিয়ার মন্দিরে নেতাজিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, কিন্তু সেই আমন্ত্রণ তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন? কারণ ওখানে অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষ এমনকী তথাকথিত নিচু জাতের মানুষদের প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। নেতাজির এই মনোভাবের কথা জানতে পেরে মন্দির কর্তৃপক্ষ তাঁকে জানান যে, সেখানে একটি জাতীয় অধিবেশন করা হবে। নেতাজি মহম্মদ জামান কিয়ানি ও আবিদ হাসানকে নিয়ে সেই অধিবেশনে গিয়েছিলেন।
নেতাজি প্রদত্ত বিভিন্ন ভাষণে বা বিবৃতিতে তাঁর অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয় মেলে। ১৯২৮ সালে কুষ্টিয়ার এক সমাবেশে নেতাজি বলেছিলেন, ‘‘একমাত্র হিন্দু ও মুসলমানদের যৌথ প্রচেষ্টার ফলেই স্বরাজ লাভ করা সম্ভব হইবে। আর যদি এমন কোনো সমস্যা থাকে যাহাতে হিন্দু ও মুসলমানের মতের অমিল হয় তবে তাহা পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে বা গোল টেবিল বৈঠক বসিয়া সমাধান হইবে।’’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘‘হিন্দু ও মুসলমানদের স্বার্থ পরস্পরের পরিপন্থী একথা যাঁহারা বলেন তাঁহারা খাঁটি কথা বলেন না। ভারতবর্ষের মূল সমস্যাগুলি কী? খাদ্যাভাব, বেকারি, জাতীয় শিল্পের অবক্ষয়, মৃত্যুহার বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যহীনতা, শিক্ষার অভাব - এইগুলিই মূল সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান না হওয়ায় জীবন অসহনীয় হইয়া উঠিয়াছে, বাঁচিয়া থাকাও অর্থহীন হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আর এই সকল বিষয়ে হিন্দু ও মুসলমানদের স্বার্থ অভিন্ন।’’
১৯২৮ সালের ২৬ মার্চ কুষ্টিয়াতে ভাষণ দিতে গিয়ে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব হইলে কে তাহাতে লাভবান হয়? উভয় পক্ষই হত বা আহত হয়, উভয় পক্ষকেই গারদে পুরিয়া দেয়; তারপর দেখা যায় যে, একই কারাকক্ষে একসঙ্গে তাহারা কারাদণ্ড ভোগ করিতেছে। আর যাহাদের কারাদণ্ড হয় নাই, যাহারা গ্রেপ্তার হন নাই, তাহাদের হয়ত পিটুনি কর গুনিয়া দিতে হয়। সরকার কোনোদিনই দুই সম্প্রদায়ের মতবিরোধ দূর করিতে পারিবে না। উভয় সম্প্রদায়কেই মিলিয়া মিশিয়া এই বিরোধ দূর করিতে হইবে।’’
১৯৩৮ সালের ১৪ জুন কুমিল্লার ভাষণে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নেতাজি বলেছিলেন, ‘‘...হিন্দুরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলিয়া ‘হিন্দুরাজের’ ধ্বনি শোনা যায়। এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা। ...শ্রমসিক্ত জনসাধারণ যে সব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন, সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি তাহার কোনোটির সমাধান করিতে পারিবে কী? কীভাবে বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, দারিদ্র্য প্রভৃতি সমস্যার সমাধান হইবে সে সম্বন্ধে তাহার কোনো পথনির্দেশ করিয়াছে কী?’’
হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে নেতাজির ঘৃণা ছিল। তাই তিনি বলেছিলেন,‘‘সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ত্রিশূল হাতে হিন্দু মহাসভা ভোট ভিক্ষায় পাঠিয়েছে। ত্রিশূল ও গৈরিক বসন দেখলে হিন্দু মাত্রই শির নত করে। ধর্মের সুযোগ নিয়ে ধর্মকে কলুষিত করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। হিন্দু মাত্রেরই তার নিন্দা করা উচিত।’’ (১৪ মে, ১৯৪০, আনন্দবাজার পত্রিকা)
সমস্ত রকম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে ছিলেন নেতাজি। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘‘হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লিগের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি আগের থেকে অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছে। এরই প্রতিক্রিয়ায়, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস তার গণতন্ত্রে একটি ধারা যোগ করেছে, তাতে বলা হয়েছে হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লিগের মতো কোনো সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সদস্য কংগ্রেসের নির্বাচিত কমিটির সদস্য হতে পারে না’’। (৪মে ১৯৪০,‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এ স্বাক্ষরিত সম্পাদকীয়)। ওই একই সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, ‘‘...হিন্দু মহাসভা এবং ‘অমৃত বাজার পত্রিকা’র মত সংবাদপত্রের কৃতিত্ব এই যে, তারা হঠাৎ অত্যুগ্র সাম্প্রদায়িকতা পোষকতা করতে শুরু করেছে, বাংলাদেশের এবং অন্যত্র হিন্দুদের মন বিষিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে দিনের পর দিন সাম্প্রদায়িক বিষ উদ্গার করে চলেছে। ...’’
১৯২৮ সালের ৩মে মহারাষ্ট্র প্রাদেশিক সম্মেলনের ভাষণে সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘...সাম্প্রদায়িক ক্ষত নিরাময়ের জন্য জোড়াতালির নিন্দা না করিয়াও আমাদের সাম্প্রদায়িক বিরোধ মীমাংসায় গভীরতর প্রতিকারের প্রয়োজনীয়তার উপর আমি জোর দিতেছি। ...অন্যান্য সকল ধর্মের ন্যায় ইসলামের স্থানও ভারতে রহিয়াছে। প্রত্যেক ধর্মীয় গোষ্ঠীরই ঐতিহ্য, আদর্শ ও ইতিহাসের সহিত পরিচিত হওয়া প্রয়োজন। কারণ (ইহা) পারস্পরিক সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা, সাম্প্রদায়িক শান্তি ও ঐক্যের পথ সহজ করিয়া তুলিবে। ...এই সাংস্কৃতিক সহযোগ স্থাপন করিতে হইলে কিঞ্চিৎ বিজ্ঞানভিত্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তা রহিয়াছে। ধর্মান্ধতার গোঁড়ামি সাংস্কৃতিক সহযোগের পথে গুরুতর প্রতিবন্ধক এবং ধর্মনিরপেক্ষ বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যতীত কোনো উৎকৃষ্টতর প্রতিকার নাই।’’
নেতাজি আন্তরিকভাবেই হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের পক্ষে ছিলেন। ১৯২৭ সালের ১২ নভেম্বর কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি একটি সভা আহ্বান করেছিল। ওই সভায় নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি কর্তৃক গৃহীত হিন্দু-মুসলমান ঐক্য সম্পর্কিত প্রস্তাব আলোচিত হয়েছিল। ওই সভায় সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, ‘‘...স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যতীত আমাদের দেশের মানুষদের ধর্ম রক্ষা পাবেনা। কেননা পশ্চিমের এবং পশ্চিমি প্রতিষ্ঠানগুলির চাপে আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধ্বংস হতে চলেছে’’। নেতাজি ওই সভায় বলেছিলেন - যে সমস্ত ব্যক্তি বাংলার পুলিশদের প্রহরায় মসজিদের সামনে শোভাযাত্রা পরিচালনা করেছিলেন তাদের লজ্জাবোধ হওয়া উচিত। কেননা যে সমস্ত ব্রিটিশ বেতনভুক কর্মচারী নিরস্ত্র মুসলমানদের উপর গুলিচালনা করছে, আগামীকাল তারাই নিরস্ত্র হিন্দুদের উপর গুলিচালনার মহড়া নেবে। উল্লেখিত সভায় সুভাষচন্দ্র বলেন যে, ‘‘...নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির এই প্রস্তাব হিন্দু ও মুসলমানদের গোঁড়ামিতে ছেদ টানবে এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে। সকলের সামনে আজ একটি মাত্র সমস্যা রয়েছে,সে সমস্যাটি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ...’’।
নেতাজি যে সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ছিলেন তা আজাদ হিন্দ ফৌজের গঠন ও আজাদ হিন্দ সরকারের পদক্ষেপগুলির দিকে নজর দিলেই বোঝা যাবে।
১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ওই দিন আজাদ হিন্দ সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সিঙ্গাপুরের এক প্রকাশ্য সভায়। এ কারণে যে ঘোষণাপত্র জারি হয়েছিল, তাতে সুস্পষ্টভাবে অন্যান্য বিষয়ের সাথে বলা হলো,স্বাধীন ভারতে ধর্মীয় এবং চাকুরি ক্ষেত্রে সমান সুযোগের কথা। এছাড়া ঘোষণাপত্রে তিনি জাতি,ধর্ম এবং লিঙ্গ বৈষম্যের ঊর্ধ্বে ওঠার কথাও বললেন। বাস্তবে দেখা গেছে পরবর্তী সময়ে তিনি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন।
মনে রাখতে হবে জার্মানির কিয়েল বন্দর থেকে তিনি জাপানের পথে প্রায় তিন মাসের মতো যে ডুবোজাহাজে জলের ভেতর দিয়ে গিয়েছিলেন, তাতে তাঁর একমাত্র সঙ্গী ছিলেন আবিদ হোসেন, যিনি ধর্মের দিক থেকে ছিলেন মুসলমান। অন্যদিকে তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত জেনারেলরাও ছিলেন মুসলমান। যেমন, শাহনওয়াজ খান, এমজেড কিয়ানি এবং আবিদ হোসেন। আইএনএ’র যুদ্ধ সঙ্গীত ‘কদম কদম বাঢ়ায়ে যা’র রচয়িতা ছিলেন একজন মুসলমান। অন্যদিকে সুভাষচন্দ্রকে অভিনন্দন জানিয়ে সেই বিখ্যাত গানের রচয়িতা ছিলেন মুমতাজ হুসেনঃ ‘সুভাষজি! সুভাষজি! ও জানে হিন্দ আগ্যায়ে।’ ‘‘...আজাদ হিন্দ সরকার পরিচালনায় আর্থিক সাহায্যের ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন রেঙ্গুনের এক নামকরা ধনী ব্যবসায়ী মিস্টার হাবিব। তিনি নেতাজির গলার মালার মূল্য স্বরূপ তাঁর হাতে এক কোটি টাকা মূল্যের সমস্ত সম্পত্তি তুলে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে জেনারেল শাহনওয়াজ খান তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণে লিখিতভাবে নেতাজির এই অ-সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কথা প্রশংসার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।’’ (প্রবন্ধঃ সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিতে ধর্ম - শ্যামাপ্রসাদ বসু / ‘কোরক’ সাহিত্য পত্রিকাঃ জানুয়ারি-এপ্রিল, ২০২১ / পৃষ্ঠাঃ ২১৫)।
সুভাষচন্দ্র বসু ধর্ম আর জাত-পাত নিয়ে ভণ্ডামি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি মাত্র সতেরো বছর বয়সে গ্রীষ্মের ছুটিতে হৃষিকেশ, হরিদ্বার, মথুরা, বৃন্দাবন, কাশী, গয়া প্রভৃতি স্থান বেড়াতে গিয়েছিলেন। উল্লেখিত ধর্মীয় স্থানগুলিতে তিনি জাত বৈষম্য ও আচার-অনুষ্ঠানে জাতপাতের বিচার লক্ষ করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র দেখেছিলেন জল পিপাশা পেলে ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য জাতের মানুষকে কুয়ো থেকে জল তুলতে দেওয়া হয় না। বাঙালিরা মাছ খায় বলে বাঙালিদের অন্যত্র খেতে দেওয়া হতো। এসব দেখে নেতাজি বলেছিলেন - এঁরা অদৈতবাদের কথা বলেন, আবার কাজের সময় জাতপাতের বিরোধিতা করছেন - এ এক আশ্চর্য স্ববিরোধিতা। অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠবার পিছনে বিবেকানন্দের প্রভাব ছিল। তিনি যখন রেভনেশ স্কুলের ছাত্র (তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৫) তখন সুহৃদচন্দ্র মিত্রের বাড়িতে প্রথম স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলির সঙ্গে পরিচিত হন। বিবেকানন্দের রচনাবলি থেকে তিনি দুটি বিষয়ে প্রেরণা লাভ করেছিলেনঃ (ক) সেবার মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত রাখা, (খ) জাত-পাত আর গোঁড়ামির প্রতিবাদ করা।
সুভাষচন্দ্র বসু সারাজীবন ধরে অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে লড়েছেন। ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। আজকের ভারতে অন্যতম সমস্যা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। আসুন আমরা সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিনে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইকে আরও শানিত করার শপথ গ্রহণ করি।