E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২৩ সংখ্যা / ২০ জানুয়ারি, ২০২৩ / ৫ মাঘ, ১৪২৯

প্রসঙ্গ অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘সুরক্ষাকবচ’ কার জন্য?

ঈশিতা মুখার্জি


বছর শুরুর প্রথম দিকে প্রকাশিত একটি তথ্য জানাচ্ছে যে, ২০২৩ সালের মার্চ মাসের শেষে পশ্চিমবঙ্গে মাথা পিছু সরকারি ঋণের বোঝা দাঁড়াবে ৫৯,০০০টাকা। গতবছর যখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্য বাজেট পেশ করে, তখনই ২০২২-২৩ সালে জমে থাকা ঋণের বোঝা ছিল ৫.২৮ লক্ষ কোটি টাকা। সেদিন এই রাজ্য সরকারই বলেছিল যে, ২০২৩ সালে মার্চ মাসে তা আনুমানিক বেড়ে ৫.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা হবে। এই পরিস্থিতি প্রকাশ্যে আসার পড়েই মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে, তিনি রাজ্যবাসীর জন্য সার্বিক প্রকল্প আনছেন ‘সুরক্ষাকবচ’ এবং কার কি প্রয়োজন জানতে বাড়িতে বাড়িতে ‘দূত’ পাঠাবেন। একই সাথে প্রকাশ্যে এলো আরও একটি তথ্য - বিভিন্ন গ্রামীণ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ কেন্দ্রীয় সরকারের পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের অর্থ খরচ করে উঠতে পারেনি রাজ্য সরকার। অন্যদিকে সরকারের আর্থিক দুর্নীতির পরিমাণ তো লুকোনো নেই, তা আজ প্রকাশ্যে এসে গেছে। এই তথ্যগুলো এক সুতোয় গাঁথলে বা যাকে আমরা বলি কতগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিচ্ছিন্ন বিন্দুকে রেখা দিয়ে যুক্ত করলে আমরা কি সদ্য ঘোষিত প্রকল্প ‘সুরক্ষাকবচ’ কার স্বার্থে এবং কী বুঝতে পারি? এই সব তথ্যই কিন্তু রাজ্য সরকারের আর্থিক পরিস্থিতি সঙ্ক্রান্ত বিষয়ে। সরকারের অর্থ আয়-ব্যয় নিয়ে এই তথ্যগুলি হলেও বাজেটের রাজস্ব আয় বা ব্যয় সম্পর্কে সে অর্থে এই তথ্যগুলি কিছু জানায় না।

এখানেই ‘সুরক্ষাকবচ’ নিয়ে যত প্রশ্ন উঠে গেছে। কোথা থেকে আসবে এই প্রকল্পের অর্থ? সরকার তো এমনিতেই ঋণের ভারে নুইয়ে পড়েছে। তাহলে কীভাবে এই ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী? কী তার ভিত্তি? অর্থের যোগান কোথা থেকে হবে? কেন্দ্রের বরাদ্দ অর্থের দাবি কেন করছেন না মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যের অর্থমন্ত্রী? এই প্রকল্প আসলে কার স্বার্থে? এর উত্তর খুঁজতে গেলে জানতে হবে রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্যের কথা এবং জানতে হবে এই প্রকল্প সম্পর্কেও।

‘সুরক্ষাকবচ’ বলতে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান বলেছেন এই ‘সুরক্ষাকবচের’ মধ্যে রয়েছে রাজ্য সরকারের ১৫টি প্রকল্প। সেগুলি হলো খাদ্যসাথী, বাংলার আবাস যোজনা, নিজ গৃহ নিজ ভূমি, স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রী, ঐক্যশ্রী, ছাত্রছাত্রীদের ক্রেডিট কার্ড, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কৃষক বন্ধু, সামাজিক সুরক্ষা যোজনা, মানবিক পেনশন, জয় বাঙলা পেনশন প্রকল্প, বিধবা ভাতা ও যুবশ্রী। এর কোনোটিই কোন নতুন প্রকল্প নয়, প্রায় সবই চালু প্রকল্প। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এই যে, এই প্রকল্পের বেশ কিছু তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার আগে চালু ছিল বামফ্রন্টের সময়ে; তৃণমূল কংগ্রেস তার নাম বদল করেছে শুধুমাত্র। এ ছাড়াও রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প। এ রাজ্যে তার নাম বদল করেছে মুখ্যমন্ত্রী। সব কিছুর নাম দিতে ভালবাসেন মুখ্যমন্ত্রী, তাই আগে থেকে চালু প্রকল্প এবং সারা দেশে চালু প্রকল্পগুলিকে আমাদের রাজ্যে নামে চেনা কঠিন। রাজ্যের নতুন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে কয়েকটি। বোঝাই যায় পঞ্চায়েত ভোটের দিকে তাকিয়েই এই চমকপ্রদ নাম নিয়ে হাজির হলেন মুখ্যমন্ত্রী। এই প্রকল্প বাবদ একটি মোবাইল অ্যাপ উন্মোচন করেন তিনি। বহু রাজ্য জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের জন্য মোবাইল অ্যাপ চালু করেছে; এতে এই সরকারের নতুনত্ব কিছু নেই; শুধু চমক আছে। এই সরকারের অতীতের চমকপ্রদ প্রকল্পগুলির পিছনে আর্থিক সংস্থানের তথ্য কিন্তু আশঙ্কার কথাই জানায়। এমনই একটি চমকপ্রদ প্রকল্প লক্ষ্মীর ভাণ্ডার যা এই সুরক্ষাকবচের অন্তর্গত। ২০২১ সালে এই প্রকল্প যখন চালু হলো তখনই জানা গিয়েছিল যে, এই প্রকল্প যদি সার্বিকভাবে চালু হয়, তবে প্রতি বছর প্রয়োজন ১৮,০০০কোটি টাকা। সেখানে সীমিত রাজস্ব আয় থেকে এই প্রকল্প চালানো সম্ভব নয়। কোথা থেকে হবে আর্থিক সংস্থান? ২০২২-২৩ সালে সরকারের মোট রাজস্ব আয় আনুমানিক ১.৯৮ কোটি টাকা। এই রাজস্ব আয় তো শুধুমাত্র প্রকল্পবাবদ ব্যয় করার জন্য নয় - এ তো সরকারের সব ব্যয় মেটানোর জন্য। তাহলে এই সুরক্ষাকবচের টাকা কোথায়?

পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সামনে রেখে এই চমক দেওয়া হলেও মাত্র কয়েকদিন আগে জানা তথ্যে আমরা দেখলাম যে, কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের টাকা আমাদের রাজ্য খরচ করতে পারছে না। চলতি আর্থিক বছর শেষ হতে আর তিন মাস বাকি। পঞ্চদশ অর্থ কমিশন অনুযায়ী গ্রামোন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ অর্থ মাত্র ৪৮.৫৪শতাংশ ব্যয় করতে পেড়েছে রাজ্য সরকার। তিন মাসের মধ্যে ৫০শতাংশের বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে এই সরকারকে। সেই কারণেই কি এই সুরক্ষাকবচের ঘোষণা? গ্রামোন্নয়নের অর্থ সারা বছর ব্যবহার না করে এই উদ্দেশ্যেই কি একসাথে ভোটের আগে চমক দিয়ে পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে? গ্রামোন্নয়নের চিন্তা কিন্তু পরিবারভিত্তিক, ভোটের বুথভিত্তিক নয়। তা অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত। যে তথ্য জানা যাচ্ছে তা হলো রাজ্যের নির্ধারিত প্রকল্পে চলতি আর্থিক বর্ষে ছিল ৪৮৪৮.৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খরচ হওয়া বাকি ২৪৪৬.৪৬ কোটি টাকা। ৩৩৬টির মধ্যে ১২৮টি পঞ্চায়েত সমিতির খরচ ৫০শতাংশের কম। ৬৬৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতেরও তাই। এ ছাড়া ৪টি পঞ্চায়েত সমিতির এবং ৪৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতের খরচ ২০শতাংশের কম। এই প্রকল্পগুলির মধ্যে রয়েছে শৌচালয়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিকাঠামো, এবং প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থা। এ ছাড়া রয়েছে রাস্তা ঘাট, সেতু মেরামত ইত্যাদি প্রকল্প। অর্থাৎ সুরক্ষাকবচ কোনো সামগ্রিক জনকল্যাণ প্রকল্প নয়। স্কুল বা হাসপাতাল তৈরি নয়, উন্নত রেশন ব্যবস্থা নয়, পরিবার পিছু ভোটের স্বার্থে একেবারেই কিছু অর্থসংস্থানের কথা বলা হয়েছে। এই অর্থ পরিবারকে ব্যয় করতে হবে বেসরকারি কোম্পানিজাত পণ্যের জন্য। বিজেপি সারা দেশে যে নীতি নিয়ে জনকল্যাণের কথা বলছে, আদপে সেই নীতির কথাই বলা হয়েছে। ভোটের স্বার্থে পরিবার পিছু আর্থিক অনুদান চিহ্নিত করবে সেই বুথগুলি, যেখানে তৃণমূল কংগ্রেস কিছুটা পিছিয়ে ছিল গত নির্বাচনে বা যেখানে কিছু বিরোধী ভোটার ছিল। ‘দূতেরা’ এই পরিবারগুলি চিহ্নিতকরণ করবে। ইদানীং রাজ্য সরকারের পরিবার সমীক্ষা গ্রামে খুব বেড়ে গেছে। গ্রামের পরিবারের প্রায় সব তথ্য সরকার জানতে চায়। এই জানা তথ্য কিন্তু দলগতভাবে ব্যবহার করবে ভোটে তৃণমূল কংগ্রেস দল। তাছাড়া সরকারি প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে শাসক দলের কর্মীদের কেন নিযুক্ত করা হবে? মামুলি প্রকল্প এই সুরক্ষাকবচ নয়। এই প্রকল্প একেবারেই সাময়িক হলেও শাসক দলের আনুগত্য তৈরি করার কাজে ব্যবহার করা হবে।

কেন লাগছে এই আনুগত্য তৈরি করা? তার কারণ বিগত দিনগুলিতে সরকারের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির কথা শুধুমাত্র সামনেই আসেনি, শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা অভিযুক্ত এই দুর্নীতিতে। এই দুর্নীতির আর্থিক মূল্য একটি সর্বকালীন রেকর্ড। রাজ্যের মানুষ এই বিপুল পরিমাণ আর্থিক দুর্নীতিতে অনভ্যস্ত। তাই আর্থিক দুর্নীতির বিপুল পরিমাণ প্রকাশ্যে আসার পর আনুগত্য তৈরি করার জন্য পরিবার পিছু আর্থিক আনুগত্য সৃষ্টির প্রয়োজন বোধ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এমন প্রয়োজন আমাদের দেশে অনেক রাজ্যেই অনেক সময়েই দক্ষিণপন্থী শাসক দলের বিশেষ করে বিজেপি এবং বিজেপি সহযোগী দলগুলি নির্বাচনের আগে হয়েছে এবং এই ভাবেই তারাও নির্বাচনী বৈতরণি পাড় হওয়ার কথা ভেবেছেন। কাজেই ওই একই পথে সুরক্ষাকবচ প্রকল্প ঘোষণা করলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।

ভোটের আগে হলেও কি আদৌ পরিবারগুলি এই সুরক্ষাকবচ প্রকল্প বাবদ বরাদ্দ অর্থ কিছু পাবে? না কি এর জন্য রাজ্য সরকার আবার বাজার থেকে ঋণ নেবে? পঞ্চম অর্থ কমিশনের অর্থ ছাড়াও এই বিশাল অঙ্কের প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করতে আরও অর্থের প্রয়োজন। তাছাড়া এই প্রকল্প আদপেও গ্রামোন্নয়ন নয়; তা পরিবার পিছু আর্থিক সংস্থান মাত্র। গ্রামের কোনো উন্নয়ন এই প্রকল্পের ফলে হবে না তা স্পষ্ট। সার্বিক গ্রামোন্নয়নে গ্রামীণ পরিবারের কল্যাণ না কি পরিবার পিছু আর্থিক বরাদ্দে পরিবারের কল্যাণ সম্ভব - এই তাত্ত্বিক বিতর্ককে দূরে রেখেও প্রকল্পের আর্থিক সংস্থান ঘিরে রয়েছে নানা প্রশ্ন।প্রকল্পের আর্থিক জোগান কি সরকারকে আরও ঋণগ্রস্ত করবে? এই আশঙ্কা একেবারেই অমূলক নয়।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৭০,০০০ কোটি টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিধানসভায় ঋণের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একটি বিল পাশ করে। কেন্দ্রের সরকার রাজ্যের সরকারগুলির ঋণ নেওয়ার ঊর্ধ্বসীমা ধার্য করেছিল রাজ্যের মোট উৎপাদনের ৩.৫ শতাংশ; অতিরিক্ত ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা রাজ্যের মোট উৎপাদনের ০.৫ শতাংশ। শিল্প বিহীন রাজ্যে করের সুযোগ নেই। রাজস্ব সংগ্রহের সুযোগ একমাত্র পেট্রোল-ডিজেল বাবদ পরোক্ষ কর ও মদ বাবদ আবগারি। মানুষের আয় কমেছে, কাজ নেই, তাই ব্যয় নেই -রাজস্ব সংগ্রহের সুযোগ নেই। সরকারের ভাঁড়ার শূন্য। তাই ২০২২ সালের শেষেই জানা গিয়েছিল যে মোট জনকল্যাণের প্রকল্পের জন্যই প্রয়োজন ৬৯,৫০০ কোটি টাকা যা ঋণ ছাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। সুরক্ষাকবচ ঋণের কবচ ছাড়া বাঁচতে পারবে না পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের থেকে কিছু অর্থ পেলেও। তাই সরকার সরকারি জমি নিলামে বিক্রি করে ৮,০০০ কোটি টাকার সংস্থান করবে বলেছে। কলকাতায় ৩২০ কাঠা জমি বিক্রি দিয়ে শুরু করেছে সরকার। এরপর বিক্রি হবে বর্ধমান, আসানসোল ইত্যাদি স্থানের জমি। অর্থাৎ শিল্পের জন্য জমি পাওয়া আরও কঠিন হয়ে যাবে। কঠিন হয়ে যাবে গরিব মানুষের বাসস্থানের জমি পাওয়াও। একে একে বন্ধ হয়েছে কর্পোরেশন স্কুলগুলি। ২০২২ সালের জুন মাসে প্রকাশিত এক রিপোর্টে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গে এই মুখ্যমন্ত্রীর প্রকল্পগুলি চালাতে রাজ্যকে বিপুল পরিমাণে ঋণ নিতে হচ্ছে এবং রাজ্যের আর্থিক অবস্থা আশঙ্কাজনক। এইভাবে জনকল্যাণ প্রকল্প টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না রাজ্যের পক্ষে। তাই সম্ভবত আবারও ঋণের পথে রাজ্য সরকার। কিন্তু ঋণ নিয়েও প্রকল্প বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখা যায় না; তাই একমাত্র ভোট পর্যন্ত ঘোষণা এবং একবার-দুবার অনুদান দিয়ে আনুগত্যের ফল হয়ত ভোট হতে পারে - এই ভাবনা থেকেই সুরক্ষা কবচের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলা যায়।